কথার কথকতা


মাইন উদ্দিন আহমেদ , আপডেট করা হয়েছে : 01-09-2022

কথার কথকতা

লিখতে বসেছি দু’ঘণ্টার মতো হলো, কিন্তু এখনো লেখা শুরু করতে পারিনি। অদৃশ্য চরিত্র বিবেক সাহেব যথারীতি ওনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা ‘নীরবতা’ দিয়ে আমার মধ্যে আওয়াজ করলেন, ‘তুইতো এতোক্ষণ ফেসবুক দেখছিলি!’ কথাটা ঠিক কিন্তু তারপরও আমি মাইন্ড করলাম। কারণ তিনি আমাকে ‘তুই’ বলেছেন। আমার খুব লেগেছে। মাইন্ড করেছি। আমি বললাম, কি যে একটা সময় এসেছে, আল্লাহই জানে, এটাকে কলিকাল বললেও বিশেষণ সঠিক হবে না, বিবেক সবসময় যুক্তিপূর্ণ উচিত কথাই বলতো আর এখন দেখি তুই-তোকারি শুরু করেছে! বিবেকের নিজেরই কি বিবেক নষ্ট হয়ে গেছে?

তিনি বললেন, তুই মিছেমিছি মাইন্ড করছিস, অনেক্ষণ চেষ্টা করেও লেখা শুরু করতে না পারায় তোর মেজাজ গরম হয়ে আছে তো তাই তুই রাগ হচ্ছিস। আমার কাছে তো তুই শিশুই, তোর বাবা এবং দাদা ওরাও আমার কাছে শিশু ছিলো। বিভিন্ন সিনেমার বিবেকের গানগুলো মনে করে দেখ, সবসময় বিবেক সবাইকে তুই বলেই কথা বলে। ওই যে, ‘মনোরে, ভুলের মাঝে আর কতকাল তুই থাকবি ডুবে,  মনের আঁধার দূর করে দেখ সূর্য ওঠে পুবে।’ এরকম সব গানেই আমি সবাইকে তুই বলি, কিন্তু তুই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিস বলে ভুলে গিয়েছিস। এখন মনে পড়েছে তো? তাহলে শান্ত হয়ে যা। স্বীকার কর, তুই এতোক্ষণ ফেসবুক চালাচ্ছিলি। আমি বললাম, ঠিক আছে, স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তো তুই একজন বুড়া মানুষ, দুই ঘণ্টা ধরে ফেসবুক চালাস ক্যান, তুই কি পোলাপাইন? আমি বললাম, ফোনটা তো হাতে নিয়েছিলাম লেখার জন্য মানে লেখা কম্পোজ করার জন্য, বিষয় পাচ্ছিলাম না বলে ফেসবুকেই পড়ে থাকতে হলো। তিনি বললেন, তা ভালো তবে নিজের ফেসের কথা ভুলে যাসনে। এরই মধ্যে ফোনে রিং এলো। তিনি বললেন, আমি গেলাম, ফোন ধর।

এক বন্ধু ফোন করলো। কুশলাদি জানার পর জানতে চাইলো, কি করছিস? উত্তর দিলাম, বিবেকের সাথে ঝগড়া করছিলাম। বন্ধুতো শুনে অবাক। বললো, মানে কি? বিবেকের সাথে ঝগড়া? ঠিক আছিস তো? বন্ধুকে বললাম, লিখতে বসেছিলাম কিন্তু লেখা আসছে না, আগে থেকে বিষয় নির্ধারণ করা ছিলো না, দু’ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করছি। লিখতে পারছিলাম না বলে বিবেক আমাকে বকা দিচ্ছিলো!

বন্ধু বললো, ছেলেবেলা থেকে যতো দুঃখ-কষ্ট পেয়েছিস সেগুলো নিয়ে লিখতে শুরু কর, দেখবি ইহকালেও লেখা শেষ করতে পারা যাবে না। আমি বললাম, কিছু দুঃখ আছে এগুলো এতো তীব্র যে সেগুলো লিখে প্রকাশ করা যায় না, শুধু কাঁতরাতে হয়, তাতেই কিছুটা প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রকাশ কখনো শেষ হয় না। কারণ কষ্টটি কখনো বিলীন হয় না। ভাষার চেয়ে কাঁতরানিটাই কষ্ট প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, এ পর্যন্ত আমার কাছে এরকমই মনে হয়েছে। বন্ধুটিও সাহিত্যের ছাত্র ছিলো তা না হলে আমাকে পাগল খেতাব দিয়ে অনেক আগেই ফোন কেটে দিতো। সে বললো, কাঁতরানিটাকে ভাষায় কতটুকু প্রকাশ করা যাবে? বললাম, না, তেমন কিছু প্রকাশিত হবে না, উহ্ আহ্ করে হয়তো বিশ-ত্রিশ পার্সেন্ট কষ্ট প্রকাশ করা যাবে, সত্তর ভাগের বেশি অপ্রকাশিত থেকে যাবে। কষ্ট দিতেই থাকবে। বন্ধু বললো, মাইন, আমি বুঝতে পারছি, তুই আসলেই খুব মুশকিলে আছিস। তো আমি তোকে রিকোয়েস্ট করবো, চালডালের দাম এবং মানবতার আহ্বান জাতীয় কিছু একটাকে বিষয় করে নিয়ে তুই আজকের লেখাটা চালিয়ে নে, কিন্তু বিষয় নিয়ে ভাববার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করিস না। এরকম করলে তো একসময় পোশাক-আশাক ঘরবাড়ি ভুলে যাবি। আমি ঘণ্টাখানেক পর আবার তোকে ফোন দেবো অগ্রগতি জানার জন্য। ওকে? ওকে। আচ্ছা, খোদা হাফেজ।

এরপর আমি ফোন হাতে নিয়ে বসে আছি তাও পনেরো মিনিটের বেশি হলো। আমার মনে হলো, বিবেক সাহেব দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে মাঝেমাঝে আমাকে দেখছেন। নিশ্চিত ছিলাম না তারপরও বললাম, আপনি কি উঁকি দিচ্ছেন? তিনি এগিয়ে এলেন এবং বললেন, আবার ফাউল করেছিস! আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, আমাকে ফাউল বলেছেন?

আরে চিল্লাচ্ছিস কেন, আমিতো মানুষের দরজার ওপাশে সবসময়ই থাকি, কিন্তু এখন আমি তোকে উঁকি দিয়ে দেখিনি, তুই আন্দাজ করে বলেছিস তাই আমি তোকে ওই কথা বলেছি। আচ্ছা আমি হালকা সত্য বললেও সইতে পারিস না, মানুষের বিরাট বিরাট অপমান সহ্য করিস কি করে?

আমি কোনো উত্তর দেই না। তিনি আরো বলেন, আচ্ছা এখন যদি কোনো মানুষ এসে তোকে বলে যে, লেখা আসে না আসে না বলেন, আসলে আপনি লিখতে পারেন না, ভাব ধরা ছেড়ে দেন, লেখা বন্ধ করেন, তখন তুই কি করবি? আমি ওনার কথা শুনে আরো বিস্মিত হলাম। ওনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকার জন্য চোখ বন্ধ করলাম।

বেশ কিছুটা সময় নীরব থাকার পর আমি বললাম, আজ আমি ঠিকই আপনার কথায় মাইন্ড করেছি, কষ্ট পেয়েছি। আপনার বৈশিষ্ট হচ্ছে মানুষের কষ্টের সময় আপনার গান দিয়ে মানুষের দুঃখটাকে হালকা করা। অথচ আজ আপনি আমাকে বারবার অপমান করছেন! আমার কষ্টগুলো প্রকাশ করার জন্য কোনো ভাষাই যথেষ্ট নয়। আমি নীরবে কাঁতরাতে থাকি, কষ্টদাতাকে অভিশাপও দিতে পারি না। সেটা আরো কষ্টের বিষয়! লিখতে শুরু করে লিখতে না পারলে সভ্যতার অভাবে ক্লিষ্ট কোনো মানুষ আমাকে ওই রকম একটা অপমানজনক কথা বললে আমি অবাক হবো না, কিন্তু আপনার মুখে শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। তিনি অনেক্ষণ নীরব থাকলেন। আমি কিছুটা শান্ত হবার পর প্রশ্ন করলাম, আছেন না কি চলে গেছেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমাকে যেতে হয়নারে, থাকাটাই আমার ব্রত। আমি তোকে কষ্ট দেয়ার জন্য কথাগুলো বলিনি। আমি ভেবেছিলাম, তোর সাথে খানিকটা সময় কাটাবো, ভাব বিনিময় করবো, পরে তুই এটা নিয়ে লিখবি। লেখার বিষয় পাবার সমস্যাটি সমাধান হয়ে যাবে। আমি ওনার কথাগুলো শুনে লজ্জিত হয়ে পড়লাম। বললাম, স্যরি, আমি আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, ক্ষমা করবেন। তিনি বললেন, অস্থির হবার কিছু নেই। আমিতো আর রাগ করবো না। মাইন্ড করে চলেও যাবো না। আমাকে থাকতেই হবে। আমি অনুপস্থিত হলে মানুষ বিবেকহীন হয়ে পড়ে যেটা মানবজাতির জন্য এক বিপজ্জনক অবস্থা। যে কোনো নেতিবাচক অবস্থাতেই মাথা ঠান্ডা রেখে ধৈর্যের সাথে ভাবতে হবে যে, এরপরই আছে কোনো শুভ সংবাদ। বিধাতা বড়ই দয়ালুরে পাগলা, তিনি সীমাহীন দয়ালু। ভালোবেসে তিনি মাটির পুতুল বানিয়ে নিজেই ফুঁ দিয়ে সচল করে দিয়েছেন। এখন কি তোর মুখে হাসি ফুটবে? আমি বললাম, হাসি, তুমি আমার মুখে ফুটে ওঠো। তিনি মুচকি হাসলেন। বললাম, আপনি কি যাচ্ছেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমাকে যেতে হয়নারে, গেলে মানুষ যে বিবেকহীন হয়ে পড়ে!


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)