জাতীয় পার্টিতে সংকট নয় অন্য খেলা


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 22-09-2022

জাতীয় পার্টিতে সংকট নয় অন্য খেলা

হঠাৎই আলোচনায় জাতীয় পার্টি। সরকারের শরিক এ দল নিয়ে মূলত কারো মাথাব্যথা নেই। দলটির পেছনের ইতিহাস সার্বক্ষণিক ক্ষমতার কাছেই থাকা। ভবিষ্যতে যে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করবেন, ধারণা করা যেতেই পারে জাতীয় পার্টি সে সরকারের কাছাকাছি থাকতে প্রস্তুত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা বর্তমান সরকারের কিছুটা দুর্দিন আঁচ করতে পেরে সেখান থেকে মধ্যম পন্থায় চলে আসার চেষ্টায় রয়েছেন তারা। জিএম কাদের ইদানীং সংসদ ও বাইরে সরকারের প্রচ- বিরোধিতা করার চেষ্টা করছেন, কথা বলছেন। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়মের দায়ভার তারা নেবে না জাতীয় পার্টি। আবার ক্ষমতাসীনরা যদি ভালো হয়, কথা দিয়ে কথা রাখে, ঠিকমতো রাষ্ট্রপরিচালনা করেন, তাহলে ছেড়ে যাবেন না সেটাও বলছেন। এ কথাগুলোর অর্থ কী সেটা এখন আর বোঝানোর প্রয়োজন নেই। ফলে এ মুহূর্তে কিছুটা নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে এগোনোর চেষ্টা তাদের। এতেও একটা হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন। 

সম্ভবত সেসব সুযোগ-সুবিধা বুঝে যেদিকে বাতাস বইবে, সেদিকে যাতে পাল তুলে দেয়া যায়, সে দেনদরবার নিয়ে কিছুটা অভ্যন্তরীণ সংকট। জাতীয় পার্টি মূলত সুবিধাভোগী তালিকায়ই থেকে আসছে। সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর নেতৃত্বে একটা সংকট আসবে সেটা জানা কথাই। রওশন এরশাদ ও তার ভাই জিএম কাদেরের মধ্যে সে দ্বন্দ্ব। কিন্তু এটা নিছক সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বাসার ড্রয়িংরুমের দেনদরবার বলছেন কেউ কেউ। 

আসলে সেটা অস্তিত্ব সংকট, নাকি জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্য খেলার হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত সেটাইবা কে বলবে? অনেকেই মনে করছেন নেতৃত্ব সংকটও একটা বিষয়। গ্রুপে গ্রুপে কোন্দল। এমনকি কার হাতে এ দলটি নিরাপদ সেটাও। তবে হ্যাঁ, তৃণমূলে নেতাদের এ প্রশ্নে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃতুর পর সবচেয়ে বাজে এক পরিস্থিতিতে এখন জাতীয় পার্টি। আসলে দলের নেতৃত্ব দেবেন কে? এ নিয়েই যতো দ্বন্দ্ব। ২০১৯ সনে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ভাই জিএম কাদের ও এরশাদের প্রথম স্ত্রী রওশন এরশাদে দ্বন্দ্ব চরম আকারে। এই বিভক্তিতে সরকারের ইন্ধনও রয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। জিএম কাদের যদি সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়, সেখানে রওশন এরশাদকে দিয়ে জাতীয় পার্টির একটি অংশকে জোটে রাখার চেষ্টা করা হবে। এই দুই নেতার মধ্যে তৃণমূল মূলত কাকে বাছাই করবে? কার সঙ্গে থাকবে। কাকে নেতৃত্বে রাখা নিরাপদ, সে ভাবনাতেই ব্যাকুল। 

এর মধ্যে এরশাদের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর থেকে নতুন জাতীয় পার্টি নিয়ে আগানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন বিদিশা ও পুত্র এরিখ। জাতীয় পার্টিকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ঢেলে সাজিয়ে এরশাদের স্বপ্নের যথার্থ বাস্তবায়ন করবেন তার পুত্র এরিখ এরশাদকে নিয়ে। সে তৎপরতাও রয়েছে। এর মধ্যে জিএম কাদের ও তার বড় ভাবী রওশনের দ্বন্দ্বটা ভেতরে ভেতরে ছিল। জিএম কাদের অবশ্য এ দ্বন্দ্বটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলেন। সামনেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। ফলে সেটাকে কেন্দ্র এ দ্বন্দ্ব না মেটালে বড় চাপটা পড়ে যাবে তারই ওপর। কিন্তু সেটা মেটানোর মধ্যেই ঘটলো নতুন ঘটনা। যা অবশ্য দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণেই হয়েছে। কিন্তু সুযোগটা নিয়েছে তৃতীয়পক্ষ এটাই মনে করছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

সরকারে এখন বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। কীভাবে হয়েছে সে ইতিহাস নতুন করে বলার কিছু নেই। ২০১৪ সন থেকেই ক্ষমতাসীনদের গৃহপালিত জাতীয় পার্টি। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে, সংসদের স্বার্থে আবার বিরোধীদলের আসনে। এমন হাস্যকর পরিস্থিতি সাধারণ মানুষ দেখে আসছে বহুদিন থেকেই। তখনই জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২০১৪ সনের জাতীয় নির্বাচনে বেঁকে বসেছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। পরে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার সে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। কারণ বিএনপিবিহীন সে নির্বাচন যখন অকার্যকরের দিকে যাচ্ছিল, তখন জাতীয় পার্টি সে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করে প্রশ্নগুলোতে কিছুটা হলেও স্বচ্ছতার প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা হয়। জাতীয় পার্টির ওই ক্ষমতাসীনদের হাতের পুতুল হয়ে যাওয়া নিয়ে দলটির অভ্যন্তরে ভীষণ দ্বন্দ্ব। বুঝতেই পারছিল না তারা কী করবে। সরকারের পক্ষে, নাকি বিপক্ষে। এখন অবশ্য কিছুটা হলেও মানিয়ে নিয়েছেন তারা এবং একটা বড় লাভ হয়েছে নেতাকর্মীর। বিএনপির নেতাকর্মীদের মতো ক্ষমতাসীনদের হাতে মার খেতে হয়নি। মামলা হচ্ছে না। ক্ষমতা ও ভাগবাটোয়ারার যেটুকুই হোক না কেন, পেয়ে বেশ নিরাপদ ও বলিষ্ঠই দলটি। এভাবেই চলে আসছেন তারা। সুখের সংসার। 

সেই জাতীয় পার্টি আবারো রহস্যময় আচরণ শুরু করেছে কিছুদিন ধরে। ক্ষমতাসীনদের সাথে থেকে সমঝোতার বিরোধী আসনে বসে নতুন খেলা শুরু হয় দলে। বিএনপি ও তার মিত্ররা যখন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলে কঠোর আন্দোলনে মাঠে নেমেছে, ঠিক তখনই জাতীয় পার্টির কিছু তৎপরতা। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গা-ঝাড়া দিয়ে নিজেদের অস্থিত্ব প্রকাশের জন্য ও শো ডাউনের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় নিয়ে তৎপর তারা। এতে অবশ্য লাভ রয়েছে। জাতীয় পার্টি যে এখন আর গৃহপালিত নয়, সেটা প্রকাশে মরিয়া। ভেতরে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা ছাড়াও ভবিষ্যতের হিসাব-নিকাশেও কিছু দ্বন্দ্ব। এমনিতেই রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরপন্থীদের মধ্যে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ রয়েছে। আগামীর একটা বিশ্লেষণ তো ইতিমধ্যে শুরু। সে দ্বন্দ্বটা এখনই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। 

তবে মূল সমস্যা অন্যখানে। অনেকেই ভাবেন, জিএম কাদের হঠাৎ করে সরকারের কিছু কিছু বিষয়ে সমালোচনা করায় তৃতীয়পক্ষের কেউ জিএম কাদের ও তার সমর্থিতদের বিরুদ্ধে আরেকটা গ্রুপ (রওশন এরশাদ, মশিউর রাঙ্গা) দাঁড় করিয়ে তাকে কিছুটা দমন-পীড়নের চেষ্টা এবং সে লক্ষ্যে প্রায় এক বছর ধরে ভীষণ অসুস্থ ও দেশের বাইরে হাসপাতালে থাকা রওশন এরশাদকে কাজে লাগিয়ে একটি কাউন্সিল করে জিএম কাদেরপন্থীদের দমনকরণ বা তার মুখ বন্ধ করার জন্য কেউ সম্ভবত কলকাঠি নাড়ছে।

দিনশেষে জাতীয় পার্টি সব এক। এক ঘরের লোকজনই নেতৃত্বে। এরশাদের প্রথম স্ত্রী ও আপন ভাই। এই তো। দু’জনই কিন্তু এরশাদ ও তার নীতিকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছে। রওশনের চাওয়া-পাওয়া আর কী। ভীষণ অসুস্থ তিনি। যিনি ৮০ বছরে পা রেখেছেন। বার্ধক্যজনিত অনেক রোগে আক্রান্ত। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। জনসমক্ষেও যাচ্ছেন না দীর্ঘদিন। কীভাবে তিনি দল পরিচালনা করবেন। গত ৩০ আগস্ট তারই আহ্বানে যে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, সেটাতে রয়েছে আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির জাতীয় সম্মেলন। একইসঙ্গে রওশন নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে ও ৮ সদস্যের একটি কমিটিও ঘোষণা দেন। সমস্যার সূচনা সেখানেই। 

এর পেছনে দলের শীর্ষনেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা ও ওই পন্থী আরো রয়েছেন। ফলে এদের অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত জিএম কাদের গ্রপের। সে সম্মতিতে প্রায় সব সংসদ সদস্যেরই। আসলে পর্যবেক্ষক মহলের চোখের আড়ালে ঘটছে কী সেদিকে। 

ক্ষমতাসীন দল, তাদের অধীনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে দেশ-বিদেশের চাহিদা মোতাবেক একটি সর্বদলের অংশগ্রহণ ও সচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আপ্রাণ চেষ্টা করছে দীর্ঘদিন থেকেই। সেখানে বিএনপির একটা গ্রুপকে অংশগ্রহণ করানো ও জাতীয় পার্টিটাকে আরো স্ট্রং করে সেখানে বিএনপির চেয়েও জাতীয় পার্টিকে বড় করে দেখানো- নানান প্ল্যান চলছে। এর উদ্দেশ্য নির্বাচনে বহুদল অংশ নিচ্ছে, এটার প্রমাণ দেয়া। বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা যেহেতু (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) সাজাপ্রাপ্ত। তাই এ বিষয়টা কাজে লাগিয়ে দলটির একটা অংশকে যদি নতুন বিএনপি নামে আলাদা প্লাটফর্ম করে নির্বাচনে নিয়ে আসা যায় অনেকটা ভাগবাটোয়ারার হিসেবে সেটাতে সরকার ভীষণ লাভবান। জাতীয় পার্টির হঠাৎ সরকারের সমালোচনা করা ও সরকারের পক্ষ থেকেও এরশাদ ও জাতীয় পার্টির ওই সরকারবিরোধী সমালোচনা করনের পেছনে বা আড়ালে ওই একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে বলেই ধারণা। এতে আপাতত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে থাকা বিএনপিকে আড়ালের চেষ্টা থাকবে।

কারণ আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ে ইদানীং একটা কথা প্রায় শোনা যায়, তারা বলছেন বিএনপির নেতৃত্বে কে? শীর্ষ দুই মানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দু’জনই তো সাজাপ্রাপ্ত। ক’দিন আগেও ওবায়দুল কাদেরকে বলতে শোনা গেছে, তারেক রহমান কী রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে বিদেশ (ইংল্যান্ড) থেকে দেশ চালাবেন? 

এদিকে জাতীয় পার্টির নেতারা যতোই সরকারের দুর্নীতি ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে কঠোর সমালোচনা করুক না কেন, এটা যে তাদের লোক দেখানো সেটার প্রমাণ গত ১৬ সেপ্টেম্বরে পার্টি মহাসচিব জিএম কাদেরের একটা অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্য। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে হিন্দু মহাজোটের প্রতিনিধি সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জিএম কাদের বলেন, আস্থা হারালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাও (জাতীয় পার্টি) থাকতে পারি। জিএম কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ভালো কাজ করলে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে পারি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি গণমানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে আগামীতে আমরা তাদের সঙ্গে নাও থাকতে পারি।’ দুদলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘জাতীয় পার্টি কোনো জোটে নেই। গত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির কোনো জোট ছিল না। ওই নির্বাচনে কিছু আসনে নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল। তখন আসনভিত্তিক আমাদের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছেন আবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টির পক্ষে কাজ করেছে।’ 

একইসঙ্গে জিএম কাদের বর্তমান সময়ে বিএনপি ও তার সমমনাদের যে দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন। ইভিএম তো পরের ইস্যু। সেখানে জাতীয় পার্টির এ নেতা ইতিমধ্যে বর্তমান ইসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং সম্প্রতি ইভিএমের বিপক্ষে কিছুটা অবস্থান নিলেও জাপা এখনো নির্বাচনের ঘোষণা দেয়নি বলেও জানান জিএম কাদের। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিইনি। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা অত্যন্ত কঠিন। আমরা বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবো। আমরা দেশ ও সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।’ 

ফলে জাতীয় পার্টির অবস্থান প্রেমের সম্পর্কে কিছুটা বিরহ। সেটাও কিছুটা আদর যতœ করলে ঠিক হয়ে যাবে এমনটাই ভাব। তাহলে পার্টির অভ্যন্তরে কী হলো, না হলো এ নিয়ে জনগণের যে ভোটের অধিকারের দাবি তার সঙ্গে তাদের নীতির মিলটা কোথায়?


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)