সারাবিশ্বে চলছে মুদ্রাস্ফীতি রোধে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে, সেন্ট্রাল ব্যাংকগুলো বা রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের আপাত কষ্টসাধ্য সিদ্ধান্ত। যেমন গত সপ্তাহে আমেরিকায় ফেডারেল রিজার্ভ গত ৬ মাসে তৃতীয়বারের মতো ইন্টারেস্ট রেট ০.৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। জাপান গত ২৪ বছরে ইয়েনের দাম প্রথমবারের মতো বাড়িয়েছে। জাপান এ ব্যবস্থা নিয়েছে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ত্রয়ী বুনিয়াদি দেশ- যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও নরওয়ে তাদের মুদ্রামান বাড়িয়েছে। একমাত্র তুরস্ককে দেখা যাচ্ছে, মুদ্রামান কমাতে যদিও মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে আর বর্তমান বাড়ন্ত ৮০ শতাংশ।
প্রধান প্রধান ধনী দেশসমূহের এহেন মুদ্রামান বাড়ানোর পেছনে চলতি মুদ্রাস্ফীতির কারণে যাতে ভোক্তার নাভিশ্বাস না হয়, এই যুক্তি সবচেয়ে বড় যুক্তি। কিন্তু এই মুদ্রামান বাড়ানোর কারণে সর্বত্র স্টক মার্কেটে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কারণ মার্কেটের দোদুল্যমানতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। বাজার অস্থিশীলতার কারণে এ অবস্থা ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে স্টক মার্কেটে। জাপান এতোদিন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে এ বছর ডলারের বিপরীতে ইয়েনের মুদ্রামান এক-পঞ্চমাংশ কমেছে। আর তাতে ইমপোর্ট প্রাইস বেড়ে গিয়েছিল এবং একইসঙ্গে ভোক্তাদের খরচও বৃদ্ধি পায় ৮ বছরের মধে সর্বোচ্চ। আর গত আগস্টের হিসেবে খাদ্যের দাম বাড়ে ২.২ শতাংশ। এখন এক ডলার সমান ১৪২.৩৯ ইয়েন করা হয়েছে। আর জাপান এই রেটে ডলার বিক্রি করেছে। সুইস ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ০.৭৫ শতাংশ রেট বাড়ালেও জাপান তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে আমেরিকাও তারপর মুদ্রামান বাড়িয়েছে; কিন্তু জাপান বাড়ায়নি। গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ব্রিটেনও মুদ্রামান ০.৫ পার্সেন্ট থেকে ২.২৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। নরওয়ের সেন্ট্রাল ব্যাংক তার রেট ০.৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। গত সপ্তাহে বিশ্বের সেন্ট্রাল ব্যাংক তাদের পলিসি রেট ৬ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়েছে। এই বৃদ্ধিতে সরকারি বন্ড বিক্রি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি গত ১০ বছরে বিশ্ব লেনদেনের ব্যয় বাড়িয়েছে। আর ডলার ০.১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩.৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সাল থেকে তা সর্বোচ্চ। ব্রিটেনের বন্ড একইভাবে ১০ বছরে ৩.৫ শতাংশ বেড়েছে।
দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা
বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে এই ডলারের ও অন্যান্য মুদ্রার দাম বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। ডলারের দাম খোলাবাজারে এখন ১১২ টাকা থেকে ১১৩ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যদিও সরকারি মূল্য ৯৬ টাকা ধার্য হয়েছে। এই মূল্যে কেউ ডলার কেনাবেচা করে না। আর বর্তমানে জাপানের অর্থায়ন রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের অর্থায়ন তো আছেই। কিন্ত বাংলাদেশে এই ডলারের মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশি টাকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করবে। যদিও বাংলাদেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক এখনো জানায়নি কি ব্যবস্থা নেবে। তারপরও খোলাবাজারে ডলারের দাম যে আবারো বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশকে এখন থেকে এই মুদ্রামান বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় সদা খাপ খাইয়ে নিতে হবে। গতবার ডলারের দাম বাড়ার পর খোলাবাজারে বাংলাদেশে ডলার বেড়েছে ২০ টাকার বেশি। আর এবারের বিদেশি মুদ্রার দাম যে হারে বেড়ছে, বিশেষ করে জাপানের মুদ্রামান যেভাবে বেড়েছে, তাতে বাংলাদেশের টাকার বরাতে যে দুঃখের প্রভাব পড়বে তা বলাবাহুল্য।
আমেরিকার ডলারের দাম বাড়ানোর পেছনে বা ইন্টারেস্ট রেট বাড়ানোর পেছনে যুক্তি হচ্ছে- মুদ্রাস্ফীতির কবল থেকে অর্থনীতিকে ধপাস করে না ফেলে দিয়ে নমনীয়ভাবে ল্যান্ড করা, যাতে মন্দা সৃষ্টি না হয়। অবশ্য তাতে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাবে। সমালোচকরা অবশ্য তা করা যাবে কিনা তা নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলেনি। অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ফেডারেল নমনীয়ভাবে এই মন্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে গত ৬০ বছরে মাত্র একবার। তবে চেষ্টা করেছে ১১ বার আর তা ঘটেছে ১৯৯৪-৯৫ সালে। এসব সমালোচক বলেন যে, ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে ফেডারেল ইন্টারেস্ট রেট খুব কম বাড়ালে মুদ্রাস্ফীতিকে পরাস্ত করতে পারবে না। আর তাতে মন্দা প্রকট হয়ে পড়বে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি থেকে ‘হার্ডল্যান্ডিং’ হবে। অর্থাৎ ক্র্যাশ করতে পারে অর্থনীতি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র মন্দা থেকে মাত্র একবার বেরিয়ে এসেছে মুদ্রামান বাড়িয়ে। তারপরও ১১ বারের প্রয়াসের মধ্যে ৬ বার তার কাছাকাছি পৌঁছেছে। অন্য পাঁচবারে ফেডারেল সফট ল্যান্ডিংয়ের কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। কারণ তখন হার্ডল্যান্ডিংয়ের প্রয়োজন ছিল মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য অথবা ফেডারেলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা। এ কথা সত্য যে, অর্থনীতি নমনীয় রাখা এক দীর্ঘ পরিক্রমা; কিন্তু তাতে সফলতা অচিন্তনীয় নয়। ইতিপূর্বে ফেডারেল তা অনেকবার করেছে।
প্রথম মনিটারি পলিসিতে মুদ্রামান বাড়ানোর প্রয়াস চলছে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চালাতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট লিনডেন জনসন একই সময়ে অস্ত্র ও ভোগব্যবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতি ছিলেন। আর সে জন্য প্রতিরক্ষা ও অপ্রতিরক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হয়। আর তা এমন একসময় করা হয়, যখন তা পরিপূর্ণভাবে নিয়োগ করা হয়। তাতে সুদের হার ৪ শতাংশ থেকে ৫.৭৫ শতাংশ বাড়ানো হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি আবার বাড়ে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৬৯ সালে তা ৬ শতাংশ হয়। ৯.২ শতাংশ পর্যন্ত ইন্টারেস্ট রেট বাড়িয়ে সে সময় মুদ্রাস্ফীতি কমানো যায়নি। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসকে কর বাড়ানোর কথা বলেন প্রেসিডেন্ট জনসন, ১৯৬৮ সালে কর বাড়ানো হয়। ১৯৭১ সালে মুদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশ হয়। সে বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর। কিন্তু ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ সর্বোচ্চ ছিল বাংলাদেশও তার অংশীদার ছিল। পাকিস্তানের মুদ্রার সাথে সম্পৃক্ততা ছিল ডলারের, তখন প্রতি ডলার সমান ছিল ৪.৫০ রুপি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এই মুদ্রামান বজায় ছিল। ডলারের মান আর্টিফিশিয়ালি কমিয়ে রাখা হয়েছিল আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য। পাকিস্তানে তখন চলছিল মাঝারি ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠার সময়। পূর্ব পাকিস্তানেও শুরু হয় শিল্প উদ্যোগ সরকারি ও বেসরকারি খাতে। সে জন্য প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশের মধ্যেও ডলারের মূল্যের সাথে টাকার মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি ১৯৭৫ সালে ১২ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৮০ সালে এসে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। ফেডারেল তখন প্রায় ১০ শতাংশ ডলারের রেট বাড়ায়। আর সে সময় বাংলাদেশে সরকার ১৯৭৭ সালে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের টাকার মূল্য ৪.৫০ টাকা থেকে ১৫ টাকায় উত্তীর্ণ করে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ আমেরিকায় যে মন্দা তা অপরিহার্য ছিল। নিক্সনের পতনের অন্যতম কারণ সেই অর্থনৈতিক মন্দা। সে সময় আমেরিকায় শস্য উৎপাদন যেমন কমেছিল, ওপেকের তেলের দাম বাড়ানোর কারণে তেলের মূল্যও বৃদ্ধি হয়েছিল। বাদশাহ ফয়সলের মৃত্যু হয় ২৫ মার্চ ১৯৭৫। সে সময়ে বাংলাদেশেও চলে অস্থিরতা, পতন হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ১৫ আগস্ট। তবে সর্বপ্রথম বিদায় নেয় ক্ষমতা থেকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ৯ আগস্ট ১৯৭৪ সালে। ১৯৮০-৮১ সালে ১০ শতাংশ সুদের হার বাড়ায় আমেরিকায় সে সময় পতন হয় প্রেসিডেন্ট জিয়ার। এসব পতনের পেছনে অর্থনৈতিক অস্থিরতা অনেকাংশে ংংদায়ী। বাংলাদেশে এই অস্থিরতা এখন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। আইএমএফ দেখছে, কৃচ্ছ্রতার বিষয়টি। কৃচ্ছ্রতা কি যেভাবে প্রধানমন্ত্রী বলে চলেছিল সেভাবে হচ্ছে? এরপর হাওয়ার্ড বুশের দ্বিতীয় টার্ম নির্বাচন সম্ভব হয়নি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ক্ষমতায় আসে, আমেরিকার ইতিহাসে তিনজন প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে পররাষ্ট্রনীতি নয়. বরং অর্থনীতিই বুশের পরাজয়ের জন্য দায়ী। সে সময় বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতন হয়। পতন হয় সাদ্দাম হোসনেরও ২০০০ সালে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে আমেরিকায় বেদনাদায়ক মন্দার প্রকোপ হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে রদবদল হলেও এরপর আর তেমন কিছু হয়নি।
আমেরিকায় এখন একদিকে যেমন মন্দার ছোবল আসছে, অন্যদিকে চাকরির ঘাটতি নেই। বাংলাদেশে চাকরির ঘাটতি প্রবল। আইএমএফ-এর দ্বারস্থ সরকার। স্থিতিশীলতা টলটলায়মান। সরকার চিন্তায় রয়েছে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট নিয়ে। চারদিকে যাদের কারেন্সির ওপর বাংলাদেশের উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কারেন্সি মান বাড়ছে দিন দিন। বাংলাদেশ যদি কারেন্সি মান না কমায়, তাহলে রফতানি খাতে স্থিতিশীলতা আনতে পারবে না। কাজেই কাণ্ডারী সাবধান!