আবারও আলোচনায় ওয়ান ইলেভেন


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 19-10-2022

আবারও আলোচনায় ওয়ান ইলেভেন

আবারও আলোচনায় ওয়ান ইলেভেন। রাজনীতিবিদ তো বটে, ব্যাবসায়ীদের জন্যও ২০০৭ সনের ওয়ান ইলেভেন ছিল বিভীষিকাময় ও দুঃস্বপ্নের। সে ওয়ান ইলেভেন আবারও ফিরে আসুক সেটা মনে প্রাণে তারা কেউই চাইবেন না। কারণ ওয়ান ইলেভেনের মূল থিম ছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা।’ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীসহ সকল ধরনের লোক যারা রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনে, জনগণকে পুঁজি করে সে জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মে নিমগ্ন বিভিন্নভাবে। অথচ আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাবার সুযোগে তারা বেঁচে চান বারবার। সে সকল মানুষদের শায়েস্তা করতেই আর্মি নিয়ন্ত্রিত সরকার। যে ভীতি তৈরি করে দিয়েছিল ওয়ান ইলেভেন সেটা আজো দুঃস্বপ্ন সংশ্লিষ্টদের জন্য। 

যদিও কিছুটা অতিরঞ্জিত ছিল। তবে সাধারণ মানুষ সেটাকে প্রথম প্রথম বেশ সাপোর্ট দিয়েছেন। পরে অবশ্য তিক্ততায় রূপ নেয় বাড়াবাড়িতে। ফলে সে ওয়ান ইলেভেন কেউই হয়তো চাইবেন না। আবার কেউ কেউ চাইবেনও। কারণ রাজনীতিতে আবারও দুর্বিত্তায়নের মহড়া চলছে। 

হঠাৎ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপি আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির দুঃস্বপ্ন দেখছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি আর কখনো হবে না।’

এ কথা তিনি বলেছেন অবশ্য একটা প্রেক্ষাপটে। সেটা হলো বিএনপির চলমান সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি- দাওয়া আদায়ে বাধ্য করা প্রসঙ্গে। এর মধ্যে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে এখন বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মেলন করছে তারা একের পর এক।  

গত ১৭ অক্টোবর সোমবার সংসদ ভবন এলাকায় নিজ বাসভবনে ব্রিফিংকালে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে মন্তব্য করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, কয়েকটি সমাবেশ করলেই সরকার পড়ে যাবে এমনটি যাঁরা ভাবেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। আওয়ামী লীগ জলের স্রোতে ভেসে আসা কোনো দল নয়। এ দেশের মাটি ও মানুষের অনেক গভীরে প্রথিত আওয়ামী লীগের শেকড়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন উচ্চ আদালত, এটি আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নয়, এ কথা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ২০৪১ সাল পর্যন্ত কে ক্ষমতায় থাকবে, কে থাকবে না থাকবে, একমাত্র আল্লাহ এবং দেশের জনগণই জানেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, জনগণের আস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির সমালোচনা করে ওবায়দুল কাদের বলেন, দুনিয়ার কোথাও যা নেই, তা নিয়ে কেন বিএনপি অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করে? সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন হবে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো, জনগণের জন্য রাজনীতি করলে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে।

কথায় কথায় সরকারের পদত্যাগ দাবি করার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি মহাসচিবের উদ্দেশে বলেন, যদি পদত্যাগ করতেই হয়, তাহলে আন্দোলন ও নির্বাচনে টানা ব্যর্থতার জন্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরই সবার আগে পদত্যাগ করা উচিত। যাদের দলের অভ্যন্তরেই গণতন্ত্র নেই, তারা দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে কীভাবে?

এদিকে হঠাৎ করে ওয়ান ইলেভেনের নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনেকটাই বিএনপির উপর দোষ চাপানো অর্থাৎ বিএনপি ওয়ান ইলেভেনের সৃষ্টি করেছিল বলেই ইঙ্গি মেলে। 

কিন্তু আসলেই কী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল ২২ জানুয়ারি ২০০৮-এ। কিন্তু হঠাৎ তত্ত্বাধায়ক সরকার প্রধানের বয়সবৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনায় তার পদত্যাগের পর অন্য কেউই যখন রাজি হচ্ছিল না, তখন জোট সরকারের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হন। সেটা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না জানিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর যে চরম অচলাবস্থার তৈরি হয়। 

ওয়ান ইলেভেন কী কিভাবে এসেছিল? 

তখন ২০০৬ সালের শেষ প্রান্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সংঘর্ষ অবসান ঘটে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের জরুরি অবস্থা জারি করার মধ্য দিয়ে এবং চাপের মুখে বাধ্য হয়ে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দেন তিনি। বাতিল করা হয় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির পূর্ব নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি। অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় সে নির্বাচন। 

এরপর সেনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যার প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদ এই সরকার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আবার গণতন্ত্রে ফেরে দেশ।

এর আগে (ইয়াজদ্দিনের সরে দাঁড়ানোর পর) সে সময় অর্থাৎ জানুয়ারি ক্ষমতার পালাবদলের জরুরি ক্ষমতা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শুরুতে দেশের মানুষেরা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করলেও একসময় তা কমে আসে এবং নির্বাচনে সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর দাবি বাড়তে থাকে। আলোচিত-সমালোচিত সেই ঘটনা প্রবাহের শুরুর দিনটি পরিচিত উপায় ওয়ান-ইলেভেন নামে। 

ওয়ান ইলেভেনের সূচনালগ্ন

দেশব্যাপী চলতে থাকে নানা গুজব ও গুঞ্জন। দেশজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে, কী হবে, কী হবে ভেবে। সেদিন বিকেলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং ইউরোপীয় কমিশন ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা। এরপর একই স্থানে বৈঠক করেন তারা বিএনপি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। 

এদিকে ওই দিন দুপুরে তখনকার প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ আইনশৃংখলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন সব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানগণ। এরপর বঙ্গভবনে তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গভবনের বৈঠক শেষে বিমানবাহিনী প্রধান নৌবাহিনী প্রধান পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়ে বৈঠক করেন তখনকার সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ।

সন্ধ্যার পর উপদেষ্টাদের নিয়ে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সভা করে এর পরপরই ইয়াজউদ্দিন আহমেদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা আসে। পদত্যাগ করেন উপদেষ্টারাও। দেশজুড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা মধ্যে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয় জনগণের জানমাল নিরাপত্তায় অর্থনীতির স্বার্থে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।

সেদিন থেকেই জরুরি বস্থা কার্যকর হয় রাত ১১টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। ঢাকাসহ সব মহানগরী ও সব জেলায় কারফিউ ঘোষণা করা হয়। গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ফখরুদ্দিন আহমেদ। এই পরিবর্তনগুলো মধ্যে সেনানিয়ন্ত্রিত সরকারের দুই বছরের ভাঙ্গা গড়ার খেলা চলে। সে সময় দুর্নীতির মামলায় বহু রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী গ্রেফতার করা হয়। একপর্যায়ে গ্রেফতার হয় দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগুতে হয় সেই তত্ত্বাধায়ক সরকারকে। যে নির্বাচন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। 

পরবর্তিতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, ওয়ান ইলেভেন তাদের (আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি) আন্দোলনের ফসল। 

সে সময় এমন কোনো রাজনীতিবিদ বাকি ছিল না যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নিজ দলের সবার মামলা প্রত্যাহার করা হলেও বিএনপি নেতৃবৃন্দের মামলা প্রত্যাহার হয়নি অজ্ঞাত কারনে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যে মামলায় জেল খাটছেন বা এখনও গৃহবন্দি সেটা ওয়ান ইলেভেনে সেনা সমর্থিত সরকারের দেয়া মামলাতেই।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)