প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র নিয়ে তোলপাড়


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 24-11-2022

প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র নিয়ে তোলপাড়

২০২০ সনের সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এক খবর সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ‘খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন শিখতে বিদেশ যাচ্ছেন বেশ কিছু কর্মকর্তা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের আওতায় এসব কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করবেন বলে খবর সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় খাবার হিসেবে রান্না করা খিচুড়ি পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সে আলোকে প্রকল্প পরিচালক তথ্য দেন, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় কীভাবে খিচুড়ি রান্না করা হয়, এর পরিবেশ ও পরিবেশন দেখতে এই প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু কর্মকর্তা বিদেশ সফর করবেন। জানানো হয়, এক হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে খিচুড়ি রান্না শিখতে বা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। যাতে ব্যায়ের পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৫ কোটি টাকার মতো। তবে সংখ্যা নিয়ে পরে আবার দ্বিমতও হয়। ৮ থেকে ১০ জনের কথাও বলা হয়। কিন্তু বাজেট অমনই। এর সঙ্গে ট্রেনিংয়ের আওতায় ছিল আরো অনেক কিছু। পরে ব্যাপক হৈ চৈ এর কারণে সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি। 

এবার সেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়ার একটা নির্দেশনা স্কুলসমূহে পাঠিয়েছে। আগামী মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২২ এ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বার্ষিক পরীক্ষা সংক্রান্ত ওই নির্দেশনায় ‘শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দেয়া হবে আর বাড়ি থেকে উত্তরপত্র নিয়ে আসবে শিশুরা। এরপর বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেবে।’ এভাবেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন করতে চায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। দেশে ৬৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগামী ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বার্ষিক পরীক্ষার জন্য ওই নির্দেশনা।’ 

প্রাথমিক অধিদফতরের ওই নির্দেশনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য অনেক।

এক. প্রশ্নপত্র সব তো আর বোর্ডে একসঙ্গে লিখে দেয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে লিখতে হবে। কিন্তু এখানে দুর্বল ছাত্র ও ভালো ছাত্রের উত্তর লিখতে সমস্যা হবে। কারণ ভালো বা মেধাবী ছাত্ররা দ্রুত লিখে অন্য প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু দুর্বলদের তো সে প্রশ্নের উত্তর লিখতে সময়ের প্রয়োজন পড়বে। সে ক্ষেত্রে মেধাবীকে সুযোগ করে দিলে দুর্বলতা পিছিয়ে যাবে পরীক্ষায়। তাছাড়া ব্ল্যাকবোর্ডে তো বারবার প্রশ্ন লিখে দেয়া যাবে না। 

দুই. কোনো কোনো স্কুলে কোনো কোনো ক্লাসে দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রীও থাকে। সেখানে এক ব্ল্যাকবোর্ড কতটা কার্যকরি ভূমিকা রাখবে। কীভাবে এগুলো মেইনটেইন করা সম্ভবপর হবে। কারণ একইসঙ্গে তো সব ক্লাসেরই পরীক্ষা। এতে ব্যাপক ঝামেলার তৈরি।

তিন. প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে দেখে কোনটা সে দেবে, কোনটা সে দেবে না এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত। তারা হঠাৎ করে ব্ল্যাকবোর্ডে দেখে উত্তর লিখলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। সেটা কী কোমলমতি শিশুদের মন মানসিকতার ওপর কোনো রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে কি না। 

চার. উত্তরপত্র বাড়ি থেকে ছাত্র ছাত্রী নিয়ে আসার নিয়ম করা হয়েছে। যেহেতু স্কুল কোনো ফি নেবে না। তাই তাদের উত্তরপত্রও সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাগজের রকমভেদে উত্তরপত্র দেখতে ভালমন্দ হওয়ার বিষয়। কাগজের সাইজ একেকজন একেক রকম নিয়ে এলে সেটাও একসঙ্গে মেলানো একটা সমস্যার কারণ। তাছাড়া শিশুরা যে উত্তরপত্র নিয়ে এসেছে, প্রশ্ন অনুসারে যদি সে বেশি তাৎক্ষণিক উত্তরপত্রের প্রয়োজন হয়। তখন ওই কাগজ কে সরবরাহ করবে। কোথায় পাবে শিশু সে উত্তরপত্র? স্কুলের তো বাজেট নেই, সে ওই বাজেট কোথা থেকে সংগ্রহ করবে? 

পাঁচ. প্রাথমিক অধিদফতরের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উত্তরপত্র ব্ল্যাকবোর্ডে লিকে দিতে সমস্যা হলে হাতে লিখে সেটা ফটোকপি করে ছাত্র ছাত্রীদের সরবরাহ করা যাবে। কিন্তু সে খরচ স্কুলের তহবিল থেকে খরচ করতে হবে। এখানে প্রশ্ন, এমনিতেই শিক্ষকদের পরীক্ষার সময়ে বাড়তি সময় দিতে হয়। সেসময় আবার ওই বাজেট কী স্কুল সরবরাহ করতে পারবে? প্রাথকিম স্কুলে কী তেমন কোনো বাজেট থাকে? 

জানা গেছে, প্রত্যেকটি স্কুলেই বছরে একটি ফান্ড দেয়া হয়। স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুপাতে হয় হয় সে ফান্ড। যা থেকে পরীক্ষার ব্যয়সহ চক, ডাস্টারের খরচ বহন করা হয়। কিন্তু এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সেই বরাদ্দের টাকা দেয়া হয়নি। এতে করে স্কুলের আরো কয়েকটি পরীক্ষাও কখনো ব্ল্যাকবোর্ড বা কখনো সিটের মতো করে একটি ফটোকপি দিয়ে পরীক্ষা নিয়ে আসছে এ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। এতে ছাত্রছাত্রীরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বোর্ডে লেখা ঠিকমতো না বোঝার জন্য ঠিকমতো উত্তর দিতে পারছে না। মার্কস কম পাচ্ছে। কোমলমতি শিশুরা বারবার প্রশ্ন বোঝার জন্য শিক্ষককেও বলতে পারেন না। শিক্ষকই বা ক’জনের কথা শুনবেন। এতে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষক বিব্রতবোধ করেন। শিশুরাও নিজেদের আড়ালে রাখেন, বলে কোনো কোনো শিক্ষার্থী অভিবাভকদের কাছে অভিযোগ করেন।  

এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের গার্ডিয়ানের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তারা তাদের জাতির ভবিষ্যত কোমলমতি শিশুদের মনের ওপর একটা অন্য ধরনের প্রভাব পড়বে বলে হতাশা ব্যক্ত করছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর গত বছরও কোটি কোটি টাকা খরচা করে খিচুড়ি রানার অভিজ্ঞতা নিতে বিদেশে যাবার মনস্থির করেছিল, তাদের হঠাৎ কেন এমন অসহায়ত্ব। কেন সামান্য প্রশ্ন ও উত্তরপত্র কোমলমতি শিশুদের বার্ষিক পরীক্ষায় সরবরাহ করতে অপারগতা। গলদ কোথায়?   

অথচ বিগত সময়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধায়নে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের সমন্বয়ে প্রশ্ন তৈরি, মডারেশন ও প্রশ্ন ছাপানো হতো। স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষার উত্তরপত্রের খাতা বানাত। এভাবেই চলে আসছে প্রথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন। উন্নয়ন ফান্ড থেকে এ ধরনের খরচ মেটানো হতো। কিন্তু এখন হঠাৎ সবকিছুতে পরিবর্তন।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)