শিল্পচর্চাকে আঁকড়ে স্বপ্ন দেখেছি ভবিষ্যতের


আলমগীর কবির , আপডেট করা হয়েছে : 30-11-2022

শিল্পচর্চাকে আঁকড়ে স্বপ্ন দেখেছি ভবিষ্যতের

সালাউদ্দিন লাভলু বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের পরিচিত নাম। অভিনয়, নির্মাণ উভয় জায়গাই তাঁর শক্ত বিচরণ। ‘ভবের হাট’, ‘রঙের মানুষ’, ‘সাকিন সারিসুরি’, ‘হাড় কিপ্টে’ নাটকগুলো দিয়ে গ্রামীণ জীবনের নানা গল্প তুলে এনেছেন। সম্প্রতি তার অভিনয় করা ‘পাতালঘর’ সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়েছে ভারতের গোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে। ওই উৎসব এবং জীবনের নানা বাঁক বদল নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। স্বাক্ষাতকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: সম্প্রতি ভারতের গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আপনার চলচ্চিত্র ‘পাতালঘর’ প্রদর্শিত হয়েছে। কেমন প্রতিক্রিয়া পেলেন?

সালাউদ্দিন লাভলু: আমি যখন দেখলাম ছবিটা বাইরে উৎসবে গিয়েছে তখন খুব ভালো লেগেছে। দর্শক প্রতিক্রিয়া তো এখান থেকে বুঝতে পারছি না। তবে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা হবে। এটা শুটিংয়ের সময় মনে হয়েছে।

প্রশ্ন: এই সিনেমার শুটিং অভিজ্ঞতা কেমন?

সালাউদ্দিন লাভলু:  সিনেমার অভিজ্ঞতা খুব ভালো। এখানে আমি নুসরাত ফারিয়ার বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছি। পরিচালক নূর ইমরান মিঠু সবসময় ভিন্নধর্মী চিন্তা করেন। তার মধ্যে আলাদা একটা ভাবনা আছে। যে জিনিসটা সে কল্পনা করে কাজে সেটা ফুটিয়ে তুলে। গল্পের প্লটটা ভীষণ ভালো লেগেছে। রাজবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হয়েছে। আমার চরিত্রটা বেশ জটিল। কারণ চরিত্রের মানুষটা একজন কবি। পরিবারের কারও কথা শোনে না। একসময় উন্মাদ আখ্যা দিয়ে তাকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়। মাঝেমধ্যে ছুটে বের হয়ে রেললাইনে শুয়ে কবিতা পাঠ করতে থাকে। অদ্ভুত একটা চরিত্র।

প্রশ্ন: নাটক-সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে আপনি গ্রামীণ পটভূমির গল্পে দুর্বল। এর কারণ কী?

সালাউদ্দিন লাভলু : কারণ তো অবশ্যই আছে। আমি যখন আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে নাট্যচর্চা শুরু করি তখন আমাদের বোধের জায়গাটা এমন হয়েছে যে, শিল্প হবে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কথা বলা। আর সেই সাধারণ মানুষের বেশিরভাগেরই অবস্থান হচ্ছে গ্রামে। গ্রামই হচ্ছে আমার কাছে বাংলাদেশ। মানুষের হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুভূতিগুলো বোঝার জন্য গ্রামের বিকল্প নেই।

গ্রাম হচ্ছে আমাদের শিকড়। আমার নির্মাণ গ্রামীণকেন্দ্রিক হওয়ার এটা প্রধান কারণ। আমি যখনই শহরমুখী হলাম তখন আমি আমার গ্রাম, গ্রামের মানুষ, গ্রামীণ প্রকৃতির অভাব অনুভব করতে শুরু করলাম। গ্রামের মানুষের সরলতা, আবেগ, অনুভূতি প্রকৃতির সরল প্রবহমানতার বহমান চিত্র আমায় দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। আমি যদি নাটক নির্মাণ না করে শিল্পচর্চায় অন্য কোনো মাধ্যমেও জড়িত থাকতাম তাহলেও আমি গ্রামকেই বেছে নিতাম। কারণ গ্রাম হচ্ছে আমার কাছে আমার আবেগ, অনুভূতি এবং আমার বেড়ে ওঠার শিকড়। তাই শিকড় বাদ দিয়ে আমার মাঝে অন্য কোনো চিন্তা কাজ করে না।

প্রশ্ন: অভিনয় নাকি পরিচালনা কোনটাতে নিজেকে খুঁজে পান?

সালাউদ্দিন লাভলু : অবশ্যই পরিচালনা। পরিচালনা আমি অনেক বেশি উপভোগ করি। পরিচালনার মাধ্যমে আমার ভাবনার প্রতিটা মুহূর্ত প্রতিটি ফ্রেমে আমি আমার মতো করে দেখাতে পারি। এই সৃষ্টি আনন্দ কিংবা ভালো লাগা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

প্রশ্ন: আপনাকে ইদানিং ধারাবাহিক নাটক নির্মাণে কম দেখা যায়। এর কারণ কি? 

সালাউদ্দিন লাভলু : নাটকের জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য যে রুচি সেটা কিন্তু এখন পরিবর্তন হয়েছে। করোনার সময় মানুষ অবসরে ইউটিউবের কল্যাণে ‘রঙের মানুষ’, ‘সাকিন সারিসুরি’, ‘হাড়কিপ্টে’ মতো ধারাবাহিকগুলো দেখেছে, পছন্দ করেছে। তাছাড়া সেই সময়ের নাটকের একটা ধাঁচ ছিল। সে সময় নাটকগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা বা শিল্পীদের একাত্ম হয়ে কাজ করার ব্যাপার ছিল। শিল্প সৃষ্টির যে তাড়না ভেতর থেকে আসে তা এখন খুব একটা নেই। বাজেট কমেছে। তাই এখন বলা যাচ্ছে না কোন নাটক দর্শকপ্রিয়তা পাবে। ওই সময়ের শিল্পী ছিল ডলি জহুর, আ খ ম হাসান, এটিএম শামসুজ্জামান, আনিসুর রহমান মিলন এদের তারুণ্যে ভাটা পড়েছে। নতুনরা এসব জায়গায় কখনো যেতে পারবে না। তাই জনপ্রিয়তার ব্যাপারটা এখন বলা মুশকিল।

প্রশ্ন: নতুন কোনো নাটক পরিচালনা করছেন?

সালাউদ্দিন লাভলু: ‘ষণ্ডা পাণ্ডা’ নাটকটি জানুয়ারি মাসে চ্যানেল আইতে প্রচার শুরু হবে। জানুয়ারিতে নতুন শুটিং শুরু হবে একটা ধারাবাহিকের। তা ছাড়া ওটিটির জন্য একটা স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছি।

প্রশ্ন: আপনার অভিনীত ‘চিরকুমার সংঘ’ ধারাবাহিক নাটকটি মানুষ পছন্দ করছে। কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

সালাউদ্দিন লাভলু : যখন মানুষের একটা জিনিস ভালো লাগে ধরেই নিতে হবে ভালো লাগার কিছু আছে। চিরকুমার সংঘের মজার কিছু দৃশ্য আছে, যেটা তরুণরা দেখে খুব মজা পাচ্ছে। সারাক্ষণ অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা, সামাজিক চিন্তার মধ্যে এসব কিছুটা হলেও প্রশান্তি দেয়।

প্রশ্ন: দ্বিতীয়বার ‘ডিরেক্টর গিল্ড’ সভাপতি হয়েছেন। নতুন কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কি?

সালাউদ্দিন লাভলু: আমরা কিছু জিনিস ফোকাস করার চেষ্টা করেছি। সরকারি প্রক্রিয়ার সবকিছু যেন হয় সেই জায়গায় নিয়ে গেছি। সরকারি নীতিমালায় কিছু যোগ-বিয়োগ করতে গেলে ‘ডিরেক্টর গিল্ড’ ডাকা হয়। তাছাড়া সবার জন্য উপযোগী করে শুটিং এ নিয়মকানুন তৈরি, মানার জন্য উৎসাহ, শিল্পীদের উন্নয়ন, শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: অনেক পেশা থাকতে শিল্পচর্চাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ কী?

সালাউদ্দিন লাভলু: শিল্পচর্চার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করব এমন কোনো ভাবনাই আমার কখনও ছিল না। এইচএসসি পাস করার পর আমি যখন ঢাকায় আসি তখন আমার গুরু মামুনুর রশিদের সঙ্গে পরিচয় হয়। শিল্পের প্রতি তার একাগ্রতা আমাকে মোহিত করেছে বেশ। একজন মানুষ জন্মগ্রহণের পর সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, অন্য মানুষের প্রতি এমনকি এই পৃথিবীর প্রতি কী দায়িত্ব হওয়া উচিত এসব যাবতীয় কথা তার মুখ থেকে শোনার পর সিদ্ধান্ত নিই এ কাজটিই আমি করব। তবে কোনো শিল্পী কিংবা পেশা হিসেবে নয়। একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে। তারপর থেকেই যুক্ত হই নাটকের সঙ্গে। তবে নাটকের সঙ্গে যুক্ত না হলেও শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ভালোলাগার কারণে আমি তখন শিল্পের যে কোনো মাধ্যমেই নিজেকে যুক্ত করতাম। ভবিষ্যতে কী হবে না হবে এমন চিন্তা কখনই করিনি। নিজের থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে কখনই কোনো চিন্তা করিনি। আমার মনে হয় গ্রুপ থিয়েটারের আমিই একমাত্র নাট্যকর্মী ছিলাম, যার ভরণ-পোষণের জন্য দল থেকে প্রতিমাসে সম্মানী প্রদান করা হতো।

প্রশ্ন: শিল্পী না হলে আপনি কী হতেন?

সালাউদ্দিন লাভলু: আমরা পাঁচ ভাই এক বোন। আমার বাবা কখনই সন্তানদের ইচ্ছা, ভালোলাগার বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করতেন না। বাবা-মা দু’জনই ছিলেন শিল্পানুরাগী। নবম শ্রেণিতে থাকাকালীন তারা আমাকে সঙ্গীতের স্কুলে ভর্তি করে দেন। সঙ্গীতের প্রতি মন না থাকায় দু’বছর ক্লাস করেও আমি কিছুই শিখতে পারিনি। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর আমার বাবা-মা আমার ইচ্ছার বিরোধিতা করেননি। তবে শিল্পী না হলে কী হতাম তা আমি কখনই ভাবিনি। কারণ যখনই জীবন নিয়ে ভাবনা চিন্তার সময় ছিল তার আগে থেকেই আমি শিল্পের ছায়াতলে চলে এসেছি। এবং শিল্পচর্চাকে আঁকড়ে ধরে ভবিষ্যত পথচলার স্বপ্ন দেখেছি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের মধ্য থেকেই নিজের সততা দিয়ে সচেতনভাবে শিল্পের কাজ করে গেছি। পরবর্তীতে এই শিল্পচর্চাই আমার পেশায় পরিণত হয়েছে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)