কথার কথকতা


মাইন উদ্দিন আহমেদ , আপডেট করা হয়েছে : 13-04-2022

কথার কথকতা

রক্তের সম্পর্ক শক্ত, না কি আত্মার সম্পর্ক- এ প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। কোন সম্পর্কটি বেশি শক্ত, এ জিজ্ঞাসা প্রত্যেকটি সচেতন মানুষের। বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন থেকে যাঁরা মনে, শরীরে বা আত্মায় আঘাতপ্রাপ্ত হন, তাঁদের কাছেই প্রশ্নটি বেশি বড় হয়ে দেখা দেয়। যদিও বস্তুবাদী বা কঠোর বাস্তববাদী মানুষ বলবেন, স্বার্থের প্রশ্নে কোনো সম্পর্কই দৃঢ় নয়, ভঙ্গুর। স্বার্থে আঘাত লাগলে রক্ত বা আত্মা কোনো রজ্জুই আর সম্পর্কটাকে বেঁধে টিকিয়ে রাখতে পারে না। তবে সাধারণ মানুষদের কাছে আত্মা ও রক্তের সম্পর্কের বিষয়গুলোই এখনো জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দেয়। আমরা আজকের আলোচনাটি চিন্তা ও প্রজ্ঞার অতি উচ্চস্তরের মানুষদের জন্য করবো না, আমার মতো সাধারণ স্তরের মানুষদের জন্য বোধগম্য হয় এরকম করে এগিয়ে নেবো। আশা করি একটা উপসংহারে পৌঁছতে পারবো আমরা।

আজ এ প্রসঙ্গে আমরা কথা বলবো মুগ্ধ এবং আমার সম্পর্ক নিয়ে। ফেসবুকের বন্ধুরা একসময় ওকে আমার ছেলে বা মেয়ের ঘরের নাতি মনে করতো। কিন্তু যখন দেখে যে, মুগ্ধ আমাকে ‘বড় আব্বা’ বলছে, তখন অনেকেই জানতে চেয়েছে, সে আমার কি হয়? যারা জানতে চেয়েছে তাদেরকে জানিয়েছি, মুগ্ধ আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে। এর বেশি কিছু বলার সুযোগ হয়নি। আজ  রক্তের বন্ধন ও আত্মার বাঁধন বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সবকিছু খুলে বলবো। আমার পৈত্রিক বাড়ি দণিবঙ্গে আর মুগ্ধ’র আব্বার বাড়ি উত্তরবঙ্গে, তাহলে আমরা দু’জন কি করে ভাই হলাম! আসলে আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে ভাই বানিয়েছে মুগ্ধ। আমি অসুস্থ হলে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় কাগজপত্রে আমি হয়ে যাই মুগ্ধ’র আব্বার বড়ভাই। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই আমরা ভাই হয়ে যাই। কী বিস্ময়কর ব্যাপার! মূল ঘটনাটি খুলে বলার আগে পটভ‚মিটা বিশ্লেষণ করা দরকার।

এর প্রাথমিক স্তরেই একটা সত্য প্রকাশ করা দরকার যে, ঢাকার মিরপুরস্থ মনিপুরে যে বাড়িটাকে সবাই সাংবাদিক মাইন উদ্দিন সাহেবের বাড়ি মনে করেন, সেটি আসলে আমার নয়। এটির মালিক আমার বড় শ্যালক আর আমার শাশুড়ি-আম্মা। এটাতো আর মানুষকে ধরে ধরে বলার বিষয় নয়, প্রেস্টিজের ব্যাপারও আছে। বিশেষত. আমরা মানুষের বিশ্বাসে আঘাত হানতে চাইনি। কারণ বাড়ির মালিক হিসেবে ঈর্ষার চেয়ে প্রাপ্ত সমীহের পরিমাণটা অনেক বেশি। আর আমাদের এ পন্থা অবলম্বনের যুক্তি হলো এই যে, আমরা যে অংশে থাকি তার ইটপাটকেল, টিন ইত্যাদি অর্থাত গৃহটি আমার খরচে বানানো আর নীতিগত শক্তি হলো এই যে, মায়ের অংশ থেকে আমার স্ত্রী তো জায়গা পাবেনই। যদিও এ প্রসঙ্গে আমার শ্বশুর সাহেবের নির্দেশনা সংশ্লিষ্টরা মানছে না। বাড়ির মালিক সেজে আমরা ইমেজটা ভোগ করতাম আর বিত্তসমূহ অর্থাত ভাড়ার টাকাটা তুলে গাঁটের পয়সা থেকে রিকশাভাড়া দিয়ে ওনার ভাইকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন আমার সহধর্মিণী। এ কাজ এবং বাড়ি রণাবেণের কঠিন দায়িত্বটি তিন দশক ধরে পালন করেছেন আমার স্ত্রী।

এবার চলে আসি আসল প্রসঙ্গে। মুগ্ধ কি করে আমার আব্বা হলো আর আমি কি করে ওর বড় আব্বা হলাম। মুগ্ধ’র আব্বা, আম্মা আর বড়ভাই থাকতো আমাদের বাড়িতেই। তখন মুগ্ধ পৃথিবীতে আসেনি। বহু বছর পাশাপাশি অবস্থান। আমার স্ত্রী শিকতা করতেন, তাই মুগ্ধ’র ভাই পড়ার সুবাদে পরিবারের ছেলের মতোই হয়ে উঠেছিল।

মুগ্ধ পৃথিবীতে আসবে আসবে অবস্থায় ওর আব্বা তার মাকে নিয়ে ব্যস্ত। আজিমপুর ম্যাটারনিটি থেকে যেদিন স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন, আমাদের ‘মনা ভাই’ সেদিন ওনার স্ত্রীর কোলে ছিল একটা ফুটফুটে ছেলে-শিশু, যার খালা তার নাম রেখেছিল মুগ্ধ। আমার যমজ মেয়েরা ততদিনে পড়াশোনা শেষ করে শিকতা করছে। মুগ্ধকে পেয়ে ওরা তো দারুণ খুশি। আমি স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এ বিষয়টিকে সমাজের আর দশটা শিশুর পৃথিবীতে আসার মতো সাধারণ ঘটনা হিসেবে নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে ঘটলো আরেকটি ঘটনা।

আমেরিকা থেকে সপরিবারে দেশে এলেন আমার মেঝো ভায়রা। সবাই সেন্টমার্টিন যাবে বেড়াতে। আমার ম্যাডাম, ওনার দুই বোন- এই তিন পরিবারের সবাই পাঁচদিনের ভ্রমণে চলে গেল সেন্টমার্টিন দ্বীপে। আমিও সাথে গেলাম। যথারীতি চলছিল লোনা পানিতে দাপাদাপি, উড়ন্ত মাছের ফ্রাই ভোজন, ঢেউ অবলোকন ইত্যাদি। তৃতীয়দিন ঢাকা থেকে একটা ফোন এলো, যেটি আমাদের জন্য ব্যতিক্রমী একটা বার্তা নিয়ে এলো। ওই ফোনকলের খবর আমার মধ্যে হঠাত একটা  অলৌকিক বাণী নিয়েই যেন এলো।

আমার স্ত্রীর কাছে ফোন এলো, কাঁদো কাঁদো গলায় মুকুলের আম্মা ফোন করে প্রশ্ন করলেন, আপা আপনারা কবে আসবেন? মুকুলের আম্মা অর্থাত মুগ্ধ’র মায়ের করুণ স্বরে আমার ম্যাডাম তো ঘাবড়ে গেলেন, তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলেন- কি হয়েছে মুকুলের মা, কোনো বিপদ? উত্তর এলো, বিপদের চেয়েও বেশি। আপা আমার ছোট ছেলে ঘুম থেকে উঠলেই হামাগুড়ি দিয়ে আপনার বাসার সামনে সিঁড়িতে উঠে দরজার দিকে চেয়ে থাকে, আপনাদেরকে খুঁজতে থাকে, আনতে গেলে কাঁদতে শুরু করে। এই ফোন পেয়ে, সারমর্ম শুনে আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সবার মধ্যে কেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা নিরীণের সুযোগ পাইনি। কারণ এটি আমার মধ্যে এমন অনুভ‚তি সৃষ্টি করেছে যে, পারলে তখনি আমি ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়ে যেতাম।

আমরা যতো দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ফিরলাম। এরপর থেকে আমি মুগ্ধ’র হয়ে গেলাম এবং মুগ্ধ আমার হয়ে গেল। প্রত্যেক দিন একবার ওকে নিয়ে ঘুরতে না বেরোলো আমার ভাত হজম হতো না, ঘুম আসতো না। আমার সাথে রিকশায় মিরপুর দশ নম্বর না গেলে ওর ভালো লাগে না। ছবি তোলা তো তসবিহ টেপার মতোই চলতে থাকে। এরই মধ্যে সে সেলফোন এমনভাবে কানে ধরতে লাগলো যে, মনে হয় কোনো মাতব্বর অভিযোগ শুনছেন। আমার সাথে প্রেসকাবে পৌঁছে গেল সে। কাবের সামনের বাগানে সে ফুল টার্গেট করে এমনভাবে মোবাইল ফোন ধরে মনে হয় যেন কোনো প্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফার। আমার মেয়েরা বলে, মুগ্ধ দেখি আপনার মতো করে হাঁটতে ও কথা বলতে চেষ্টা করে! চলছিল সব নতুন গতিতে ভালোই, কিন্তু বড় ধরনের ছন্দপতন হলো ওর প্রিয় ও অপরিহার্য তিনটি লোক আমেরিকা চলে আসাতে। আমি, ছোট ছেলে রিয়াজ আর ওর আম্মা- আমরা এ তিনজন চলে এলাম। যা ছিল মুগ্ধ’র কাছে একত্রে তিনটা বাজ পড়ার মতো। অনেক দিন সে সহজভাবে নিতেই পারেনি। আমার দু’মেয়ে এবং ওদের জীবনসঙ্গীরা ওকে নতুন একটা মায়ায় গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। তারপরও মাঝেমাঝে মেয়েদেরকে জিজ্ঞাসা করে, বড় আব্বা, বড় আম্মা আর রিয়াজ ভাইয়া কখন আসবে? সবাই উত্তর দেয়, করোনা কমলে প্লেন চললেই আসবে। এক পর্যায়ে ফোন করে ওর বড় আম্মাকে বললো, করোনা তো কমছে প্লেনতো চলে, তোমরা চলে আসো না বড় আম্মা।

এরই মধ্যে জীবন নদীর পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। মুগ্ধ বিখ্যাত মনিপুর হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। ওর মা আর আমার মেয়েরা ওকে স্কুলে আনা-নেয়া করে। প্রায় প্রত্যহ আমরা ওর সাথে ফোনে কথা বলি। 

এরই মধ্যে সে বুঝতে পেরেছে যে, রিয়াজ ভাইয়া অফিসে যায়, বড়আম্মা রিয়াজ ভাইয়াকে ভাত রেঁধে দেয়। বাংলাদেশে যখন দিন, আমেরিকায় তখন রাত। আবার দেশে যখন রাত, ওখানে তখন দিন। মেয়েরা এবং ওদের হাজব্যান্ডরা তাকে গুড হিউমারে রাখার চেষ্টা করে। এর মধ্যেও একদিন মুগ্ধ সবাইকে বললো, বড় আব্বার সাথে ফোনে কথা বলবো, খুব দরকার। আমাকে ফোনে ধরে কুশলাদি বিনিময়ের পর বলা হলো, মুগ্ধ আপনার সাথে কথা বলবে, খুবই নাকি দরকার। আমি ফোন ধরলাম, বললাম আব্বা তুমি কেমন আছো? মুগ্ধ বললো, বড় আব্বা এখন তো প্লেন চলে। রিয়াজ ভাইয়া আর বড়আম্মা ওখানে থাক, তুমি চলে আসো না, আমি তোমার সাথে দশ নম্বর যাবো, প্রেসকাব যাবো। আমি এতো আবেগায়িত হয়ে পড়েছি যে, একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারিনি। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার জীবনসঙ্গিনীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলাম।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)