মামলা করতে রাজধানী আসতে হলো ভোলার বাচ্চু আলমকে


বিশেষ প্রতিবেদন , আপডেট করা হয়েছে : 07-12-2022

মামলা করতে রাজধানী আসতে হলো ভোলার বাচ্চু আলমকে

ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলাধীন চর মুজিবনগরে নৃশংসভাবে ভূমিহীন নারী হত্যা এবং পুলিশ কর্তৃক হত্যা মামলা গ্রহণ না করার প্রতিবাদ জানাতে রাজধানীতে এসেছে বাচ্চু আলম। কান্না বিজড়িত কন্ঠে বাচ্চু আলম জানালো কিভাবে তার স্ত্রী বকুলকে হত্যা করা হয়েছে। স্ত্রী হত্যার ব্যাপারে মামলা করতে গিয়েছিল। কিন্তু তা না করতে পেরে খোদ রাজধানীতে ছুটে এসেছে প্রাণভয়ে।  

জাতীয় পর্যায়ের ১০টি মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে সংবাদ সম্মেলনে বাচ্চু আলম একথা জানান। এদিকে তার পাশাপাশি ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলাধীন চর মুজিবনগরে নৃশংসভাবে ভূমিহীন নারী নির্যাতন ও হত্যার জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ট্রাইব্যুনালেই মামলার বিচারের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পর্যায়ের ১০টি মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন। মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনগুলি হচ্ছে এএলআরডি, টিআইবি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মহিলা পরিষদ, নিজেরা করি, বেলা, ব্লাস্ট, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যে পরিষদ, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন। এদের যৌথ আয়োজনে গত ৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এড. এস এম রেজাউল করিম, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি বদরুল আলম, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের এড. নাহিদ শামস, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এড. রামলাল রাহা। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নৃশংস হত্যার শিকার বকুলের স্বামী ভূমিহীন নেতা আলম বাচ্চু ও বকুলের ভাই সোলায়মান তালুকদার।

সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন এএলআরডি, প্রোগাম ম্যানেজার অ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ সিরাজী। 

এতে বলা হয় ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলাধীন চর মুজিবনগরের (চর শিকদার) প্রায় ৯০০ ভূমিহীন পরিবারকে চরের জমিতে বন্দোবস্ত পাবার জন্য বিগত ৪ বছর থেকে সংগ্রাম করে আসছে। পূর্বে এই চরের জমিতে তারা একসনা বন্দোবস্ত পেয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের এই বন্দোবস্ত নবায়ন করেনি। এই বিষয়ে মুজিবনগর ইউনিয়ন ভূমিহীন সমবায় সমিতি লিঃ এর পক্ষে বন্দোবস্ত পাবার লক্ষ্যে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয় যার নম্বর: ৩৩২২/২০১৮। আদালত দুই পক্ষের শুনানী শেষে ৩রা এপ্রিল, ২০১৮ তারিখ ভোলা জেলা প্রশাসককে আদেশ হাতে পাবার ১ মাসের মধ্যে বন্দোবস্তের বিষয়টি সুরাহা করতে আদেশ দেন। যদিও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বর্তমান জেলা প্রশাসক মো: তৌফিক-ই-ইলাহী যোগদান করার পর তিনি বিষয়টি সুরাহা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঠিক সেই সময় চর দখল করে রাখা জোতদার ও প্রভাবশালীরা কিছু ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এ জমি তাদের বলে দাবি করেন। যা আদতে সত্য নয়। কারণ চর মুজিবনগর পয়স্তি জমি এবং যেহেতু এখনও দিয়ারা জরিপ সম্পন্ন হয়নি তাই তা কোন ব্যক্তির নামে হওয়ার সুযোগ নেই। এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আদালত এই কাগজ অবৈধ ঘোষণা করে।

১২ এপ্রিল ভোলার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর, মুহাম্মদ আরাফাত হুসাইন চরফ্যাশন সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে বন্দোবস্ত দেবার ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক তৎকালীন এসি ল্যান্ড ভূমিহীনদের চরের জমিতে চাষাবাদ করতে বলেন। এবং অবৈধ দখলদারকে সেখান থেকে সরে যেতে বলেন। এতেই চরের অবৈধ দখলদার ভূমিগ্রাসীরা মুজিবনগর ইউনিয়ন ভূমিহীন সমবায় সমিতি লিঃ এর নেতা আলম বাচ্চুর উপর ক্ষিপ্ত হয় এবং তাকে ও তার পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে আলম বাচ্চুর স্ত্রী বকুল ১৩/০৪/২০২২ তারিখ দুলারহাট থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে অভিযোগ দাখিল করে। কিন্তু থানা পুলিশ কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভোলা জেলা প্রশাসক ও ভোলা পুলিশ সুপারের কাছে তিনি ১৭/০৪/২০২২ তারিখ জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দেন। এরপরও পুলিশের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো প্রায় প্রতি মাসেই ভূমিহীনদের রিরুদ্ধে একের পর এক গাছ কাটার মামলা, চুরির মামলা, ছিনতাইয়ের মামলা প্রভৃতি মিথ্যা মামলা দায়ের করতে থাকে। এবং এ সকল মামলায় স্থানীয় পুলিশকে আসামীকে ধরতে বেশ তৎপর দেখা যায়। ভূমিহীনরা আদালতে হাজিরা দিতে দিতে অসহায় হয়ে পড়ছে।

সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর দিবাগত আনুমানিক রাত ১ টা থেকে দেড়টার মধ্যে ১৪/১৫ জন সন্ত্রাসী আলম বাচ্চুর বাড়িতে ধারালো অস্ত্র-শস্ত্রসহ আক্রমণ করে। বাড়ির ভিতরে আলম বাচ্চুর স্ত্রী বকুল ও তার বড় বোন মুকুল ছিল। মুকুল কয়েকদিন আগেই খুলনা থেকে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ভোলায় মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ায় আলম বাচ্চু সেইদিন বাড়িতে ছিলেন না। সন্ত্রাসীরা বাড়িতে ঢুকে রাম দা, ছুড়ি প্রভৃতি ধারালো অস্ত্র দিয়ে বকুল এবং মুকুলকে উপর্যপুরি কোপাতে থাকে। বকুলের শরীরে ২২ টি দায়ের কোপের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এতে তার পেটের নারী ভুড়ি বের হয়ে আসে। এছাড়া মুকুলের গলায় তারা ছুড়ি চালায়। তারা হাতে ৩টি এবং মাথায় দুটি দা’য়ের কোপের চিহ্ন রয়েছে। সন্ত্রাসীরা তাদের দা দিয়ে কোপাতে কোপাতে ঘর থেকে বাইরে বের করে নিয়ে আসে এবং ফেলে রেখে চলে যায়। এ অবস্থায় বকুল তার বোনকে বলে তুমিতো এখানে থাক না, আমি বোধহয় বাঁচবো না, তাই তুমি ঈসামনি’র বাবাকে বলবা আমাকে ও তোমাকে আসলাম পেয়াদা, বশির ও শাহজাহান সরদারের ছেলেরা কুপিয়েছে। এদেরকে যেন না ছাড়ে। এই কথা বলে সে পানি খেতে চায়। আহত অবস্থায় মুকুল তাকে পানি দিলে তিনি সেখানেই মারা যান। মুকুল আরো জানান বাড়ির আশেপাশে খুনী দলের আরো ১০/১২ জন লোক  ছিল। 

ঘটনার অনেক পরে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে দুলারহাট থানা পুলিশ সেখানে হাজির হয়। তারা লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে এবং কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলেন। এবং লাশ ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। তারা আলম বাচ্চুর স্ত্রীর বয়ানমতো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের সকল কার্যক্রম শুরু করে। এরই মধ্যে দৃশ্যপটে হাজির হন ভোলার তজিমুদ্দিন সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: মাসুম বিল্øাহ। তিনি এটা বলা চেষ্টা করতে থাকেন যেহেতু ভিকটিম মারা গেছে তাই কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হলে চাক্ষুস সাক্ষী লাগবে। এবং তিনি ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কোন অভিযোগ শুনতে চান না বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এবং তিনি এটাও বলেন, যেহেতু মুমুর্ষ অবস্থায় থাকা মুকুল কোন নাম বলতে পারেনি তাই কারো নামে অভিযোগ করা যাবে না। কিন্তু বিকাল আনুমানিক ৫টার দিকে নিহত বকুলের স্বামী আলম বাচ্চু মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ জানায় কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। আলম বাচ্চু বার বার অনুরোধ করেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের নাম মুকুল তাদের বলেছে। কিন্তু পুলিশ তাদের জানায় যেহেতু মুকুল তাদের সামনে নাম বলেনি তাই তাদের নাম আসামী হিসেবে দেয়া যাবে না। এক পর্যায়ে পুলিশ আলম বাচ্চুকে বাদী হিসেবে মামলা নিতে অস্বীকার করে। এবং রাত আনুমানিক ১২টার দিকে খুলনা থেকে আসা মুকুলের ছোট ভাই সোলায়মান তালুকদারকে বাদী হিসেবে মামলা করার জন্য চাপ দিতে থাকে। তিনি নিজে বাদী না হয়ে আলম বাচ্চুকে বাদী করতে বললে তাকে বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখাতে থাকে। এই পুরো সময়ই ভোলার তজিমুদ্দিন সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: মাসুম বিল্লাহ দুলারহাট থানায় উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে পুলিশ বকুলের স্বামী আলম বাচ্চুকে পুরানো একটি গাছ কাটার মামলায় গ্রেফতার করার পাঁয়তারা শুরু করলে তারা থানা থেকে চলে আসেন। এবং পুলিশ নিহত বকুলের হত্যা মামলা গ্রহণ করেনি। তবে আমরা জানতে পেরেছি পরবর্তীতে পুলিশ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামী করে ঐ এলাকার চৌকিদারকে বাদী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে, যাতে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা যায়। সংবাদ সম্মেলন থেকে আয়োজকরা দুলারহাট থানা পুলিশ এবং ভোলার তজিমুদ্দিন সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: মাসুম বিল্লাহ এ হত্যা মামলায় বাদীর অভিযোগ গ্রহণ না করে আসামীদের রক্ষার জন্য যে বিধি-বহির্ভুত চেষ্টা করেছে তার জন্য বিভাগীয় তদন্তের মাধম্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাদের উক্ত দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। সেই সাথে একটি নিরপেক্ষ তদন্তকারী সংস্থা দ্বারা এই হত্যাকান্ডের তদন্ত সম্পন্ন করার দাবি জানান।  তাছাড়া চরে বসবাসরত নারী ও শিশুসহ সকল ভূমিহীনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যমান কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে ঐ এলাকায় বিশেষ পুলিশ ফাড়ি বসানোর নিশ্চয়তা দেয়ার দাবিও উঠে সংবাদ সম্মেলন থেকে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)