বিএনপি আপাতত ১০ ও ২৭ দফায়


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 21-12-2022

বিএনপি আপাতত ১০ ও ২৭ দফায়

গোলাপবাগের সমাবেশের পর বিএনপির সামনে বড় কর্মসূচির মধ্যে ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে আগামী ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাইরে দেশব্যাপী এবং ঢাকায় ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। একযোগে ২৪ ডিসেম্বর ওই কর্মসূচি হওয়ার কথা থাকলেও ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। দলটির সাধারণ সম্পাদকের অনুরোধে বিএনপি ঢাকার কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনেছে। 

এ দুই কর্মসূচির পর আপাতত কোনো কর্মসূচি নেই বিএনপির সামনে। দলের শীর্ষ সব নেতা কারাগারে। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নিজ (ভাড়া বাড়ি) গৃহবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে দীর্ঘদিন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, মির্জা আব্বাস, আব্দুস সালামসহ দলের শীর্ষ নেতারা এখন কারাগারে। মূলত এমনি সময়ে সামনে থেকে নেতৃত্বে দেয়ার মত যারা রয়েছেন, তারা আসলে নীরিহ। বা তাদের পক্ষে বড় কোনো কর্মসূচি বা সেটা বাস্তবায়নের সামার্থ মূলত নেই। যাতে করে বিএনপি অনেকটাই চুপসে যাবার উপক্রম। মাঠের কর্মীরা উত্তপ্ত হয়ে ওঠতে শুরু করলেও সেখানে আবারও নিরব হয়ে গেছেন। 

যেহেতু সিনিয়র নেতারা কারাভোগ করছেন, এমনি মুহূর্তে বিএনপি গোলাপবাগে দেয়া ওই দশ দফা আন্দোলন ও দাবির উপরই রয়েছে। অবশ্য এরই মধ্যে অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি আরেকটি সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফার রূপরেখা প্রকাশ করেছে। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন ও ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনসহ ২৭ দফার ওই রূপরেখা তাদের। 

স্থানীয় এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রূপরেখার ২৭ দফা উপস্থাপন করেন।

কী আছে বিএনপির ওই ২৭ দফায় : 

সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংশোধন, জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, মিডিয়া কমিশন, ন্যায়পাল নিয়োগ, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, নির্যাতনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিচার, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার মূলনীতির ভিত্তিতে ধর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল ও অপ্রয়োজনীয় কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বন্ধ, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া, দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করা, ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারগুলোকে অধিকার স্বাধীন ও শক্তিশালী করা, নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের তালিকা প্রণয়ন ও যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ, শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্যপর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা-কারিকুলামকে প্রাধান্যসহ জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এই নীতির ভিত্তিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রবর্তন ও জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ, শ্রমিকদের প্রাইস-ইনডেক্স বেজড ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা ও শিশুশ্রম বন্ধ করা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

এর সঙ্গে দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে সে লক্ষ্যে - একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা। নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। 

কেন এ ২৭ দফা 

কিন্তু তড়িঘড়ি করে ১০ দফা দাবি প্রদানের দুই সপ্তাহ না যেতেই সংবাদ সম্মেলন করে ২৭ দফা তুলে ধরার কী প্রয়োজনীয়তা ছিল সেটা নিয়ে নানা প্রশ্ন। বিশেষ করে দলের এতগুলো শীর্ষ নেতা যখন কারাগারে। মূলত নেতাদের কারাগার থেকে বের করার কোনো রাজপথের কর্মসূচি নেই। দীর্ঘদিন ইনডোরে কর্মসূচি পরিচালনা করার পর কিছুটা মাঠে নেমে বিভাগীয় সমাবেশসহ কিছু কর্মসূচি পালন শেষে আবারও বিএনপি ইনডোরেই চলে গেছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। কারণ দলটির পক্ষ থেকে যতই বলা হোক, ‘ক্ষমতা যাবে কোন পথে, সিদ্ধান্ত হবে রাজপথে’ শ্লোগানটা দেয়া হলেও রাজপথে তেমন কর্মসূচি নেই। তাহলে বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীদের আটক করে কারাগারে পাঠালেই আন্দোলন, কর্মসূচি শেষ এমন দন্যতার প্রমাণ মিললো?  

তবে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনটা কেন জরুরি সেটাই তুলে ধরতে চেষ্টা তাদের। কারণ অনেকেই ধারণা পোষন করেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এর মধ্যে আর কী পার্থক্য। ক্ষমতায় গেলে সবাই যে যার ভাগবাটোয়ারাতে মগ্ন হয়ে যায়। বিএনপি সে ধারণা থেকে বের হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে এ ২৭ দফা রাষ্ট্রকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনার একটা ম্যাসেজ ও কর্মসূচি তুলে ধরেছে। যাতে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অন্তত এ ২৭ দফার মাধ্যমে দেশের সব সেক্টরে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। সর্বোপরি যেটাকে একটা মাইন্ডগেম বলা যায়। যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। কিন্তু বেশ ক’বার ক্ষমতায় যাওয়া ও রাষ্ট্রপরিচালনা করা বিএনপি সে সময় কী করেছে সেটাও আলোচনায় নিয়ে আসছে। ফলে বিএনপির এ দফা প্রথমত নিজের নেতাকর্মীদের বিশ্বাস করানো ও তাদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে মানুষের মনমানসিকতা তাদের দিকে নিয়ে আসার যে চ্যালেঞ্জটাও বড় কিছু এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

গোলাপবাগে ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে বিএনপির দেয়া ১০ দফা -  

১. বর্তমান জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ২. ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। ৩. নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকার/ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, ওই নির্বাচন কমিশন অবাধ নির্বাচনের অনিবার্য পূর্বশর্ত হিসেবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও পেপার ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা। ৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি, দেশে সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা, সব দলকে স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে প্রশাসন ও সরকারি দলের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা বাধা সৃষ্টি না করা, বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে নতুন কোনো মামলা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার না করা।

 ৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করা। ৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস ও পানিসহ জনসেবা খাতের মূল্যবৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল। ৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা। ৮. বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন/দুর্নীতি চিহ্নিত করে দ্রুত যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। ৯. গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা। ১০. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে সরকারি হস্তক্ষেপ পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। 

বিএনপির এ ১০ দফা দাবি পূরণ করবে কে? কিভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বাধ্য করবেন তারা? মুখে মুখে দফা দিয়ে চুপ করে বসে থাকলেই দাবি পূরণ? সেটা ভাববার সুযোগ নেই। তবে এটা ঠিক, বিএনপি শান্তিপূর্ণ উপায় আন্দোলন করতে চায়। এত কিছু ঘটনার পরও বিএনপি এখনও কোনো হরতাল ধর্মঘটে যায়নি। বাকি সময়েও সম্ভবত এমন কর্মসূচিতে দলটি আর যাবে না। এ পরিবর্তন অবশ্যই সাধারণ মানুষের জন্য সাচ্ছন্দের। মানুষ এখন আর হরতাল ধর্মঘট, জ্বালাও, পোড়াও, হানাহানি, মারামারি পছন্দ করেন না। কিন্তু বিএনপি যে নীতিতে সেটাই যে সলিড ও সঠিক উপায় সেটা কী তৃণমূলের কর্মীরা মেনে নিচ্ছেন?    


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)