ডলার সংকটে জ্বালানি নিরাপত্তা


খন্দকার সালেক , আপডেট করা হয়েছে : 15-03-2023

ডলার সংকটে জ্বালানি নিরাপত্তা

শুনছি ডলার সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লা কেনা বিঘ্নিত, কিনতে সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি তেল, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি, গ্যাস সরবরাহের জন্য আইওসির এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আইপিপিগুলোর পাওনা বকেয়া পড়েছে। এমনিতেই দ্রুত কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় নিয়ে সরকার দুশ্চিন্তায়। অচিরে ডলার সমস্যা নিরসন না হলে কীভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় থাকবে? শিল্পগুলো বিশেষত রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মিটানো না গেলে রপ্তানি কমে ডলার সংকট ঘনীভূত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ ধরে রাখা না হলে আমদানি সংকটে পড়বে। আইএমএফ হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে রিজার্ভ আছে মাত্র ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ঋণের শর্ত অনুযায়ী, সেটি ২৪ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে জুন ২০২৩ নাগাদ। তাই রিজার্ভ থেকে ডলার বরাদ্দ করা সংকট ঘনীভূত করবে। কি করবে সরকার? 

নভেম্বর, ডিসেম্বর শীতকালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি স্বস্তিদায়ক ছিল। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে নিবিড় সেচ কাজ শুরু হয়েছে। গ্রীষ্মকাল আসছে, রোজা শুরু হবে মার্চ মাসের শেষ দিকে। সরকার বলছে গ্রিড বিদ্যুৎ চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। ২০২২ জুলাই-অক্টোবর অভিজ্ঞতা আর বাস্তব পরিস্থিতি বিচারে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশব্যাপী জ্বালানির বিদ্যুতের মহাসংকটের। এমনিতে ২২ হাজার ৪৮২ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আর গেলো বছরের তুলনায় উন্নত বিদ্যুৎ সঞ্চালন আর বিতরণ ব্যবস্থার কারণে সংকট থাকার কথা নয়। পায়রা আমদানিকৃত কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পুরো ১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে এসেছে, এপ্রিল ২০২৩ দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার কথা, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র আর ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এই বছরে উৎপাদনে আসার জন্য প্রস্তুত। এমনকি ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত বিতর্কিত আদানি গ্রুপ বিদ্যুৎ বছরই। কেন্দ্র থেকেও ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে এই ২০২৩। এতো সম্ভাবনা নিয়েও বিদেশি জ্বালানিনির্ভরতার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানি সরবরাহ সংকট। নির্বাচনি বছরে সরকারের কুল রাখি, না শ্যাম রাখি অবস্থা। অনেকেই বলছেন, নিজেদের জ্বালানি উন্নয়ন উপেক্ষা করে আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণেই আজকের সংকট। গভীর সমীক্ষা না করে বিদেশি জ্বালানির পানে ছোটার কারণেই ডলারনির্ভর হয়েছে জ্বালানি নিরাপত্তা। 

অথচ দেশে পাঁচটি আবিষ্কৃত কয়লা ক্ষেত্র আছে। সেখানে খননযোগ্য গভীরতায় আনুমানিক ৬০ টিসিএফ তুল্যমানের মানসম্পন্ন কয়লা আছে। সরকার কিছু স্বল্পজ্ঞানী মানুষের ভুল পরামর্শে পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার কথা বলে কয়লা মাটির নিচে রেখে দিয়েছে। বড়পুকরিয়া কয়লাখনির উত্তোলন কাজ থেকে কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস হয়নি। সীমান্তের ওপারে একই বেসিন থেকে ১২-১৩ কয়লাখনি থেকে কয়লা উঠছে পশ্চিম বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ডে। সেগুলো উপেক্ষা করে কয়লা আমদানির দিকে ধাবিত হয়ে বাংলাদেশ কয়লা পরিবহনেও সংকটে পড়েছে। ডলার সংকটের কারণে সময়মত কয়লা আমদানির ভরসা নেই। সরকার উচিত অবিলম্বে কয়লা উত্তোলনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

বড়  সংকট প্রকৃতিক গ্যাস সরবরাহে। যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ২০০০-২০২৩ মাত্র তিন টিসিএফ নতুন গ্যাস যুক্ত হয়েছে। অথচ সঞ্চয় থেকে ব্যবহার হয়েছে ১৪ টিসিএফ। দ্রুত কমছে প্রমাণিত গ্যাস মজুদ। স্থলভাগে শুধু বাপেক্সকে ব্যবহারের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ২৫০ এমএমসিএফডি এবং কমছে। ২০১৮ থেকে শুরু হয় এলএনজি যোগ করে সর্বোচ্চ সরবরাহ ক্ষমতা ২ হাজার ৯৫০ এমএমসিএফডি। চাহিদা ৪২০০-৪৫০০ এমএমসিএফডি। বিদ্যুতের জন্য গ্যাস বা শিল্পে চাহিদা মেটানোয় সংকট। অবিলম্বে স্থলে-জলে গ্যাস উত্তোলনকাজ যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করা অপরিহার্য। এদিকে আবার ভূরাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র সাগরের অধিকাংশ ব্লক টেন্ডার ছাড়াই মার্কিন কোম্পানিদের ইজারা দিতে চাপ প্রয়োগ করছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ব্যাপক সুযোগ থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাবে অর্জন সীমিত। রুফ টপ সোলার, সোলার ইরিগেশন, চর, দ্বীপ অঞ্চলগুলোতে বায়ু-বিদ্যুৎ স্বভাবনা কাজে লাগিয়ে অন্তত ২০-৩০ শতাংশ নবায়ণযোগ্য বিদ্যুৎ ২০৩০ নাগাদ পাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজন স্বনির্ভর একটি সংস্থার। ওরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি দক্ষতা আর সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করবে।

ফিরে আসি প্রসঙ্গে জ্বালানিনিরাপত্তার জন্য ডলার আসবে কোথা থেকে। আইডিবি বিভিন্ন দেশকে জ্বালানি আমদানির জন্য সহজশর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। সরকার চেষ্টা করতে পারে। বন্ধু দেশগুলোর কাছে দেরিতে পরিশোধের ভিত্তিতে জ্বালানি আমদানির জন্য জ্বালানি দ্যূতিয়ালি করতে পারে। 

সরকার ১২ কার্গো এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে আমদানির পরিকল্পনা করেছে।  এটি সম্ভব হলেও পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী ১ হাজার ৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাস বিদ্যুতে বরাদ্দ দেয়া যাবে না। সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফডি দেয়া যেতে পারে। সংকট থেকেই যাবে। সরকারকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে শিল্পকে গ্যাস দিতে হবে। তবে সরকারকে অবশ্যই কয়লা, গ্যাস, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান করতেই হবে।

এর পরও সংকট হবে, লোডশেডিং হবে, শিল্প-গ্যাস সংকটে থাকবে। কৃচ্ছ্র, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)