বন্ধ হতে পারে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র


সালেক সুফী , আপডেট করা হয়েছে : 10-05-2023

বন্ধ হতে পারে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

কয়লা ক্রয় বাবদ ক্রোম পুঞ্জিত প্রায় ৩০ কোটি ডলার পরিশোধ বকেয়া থাকায় অচিরেই পায়রা আমদানিকৃত ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্ট উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চীনের সিএমসি যৌথ মালিকানায় নির্মিত এবং প্রচলিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য কয়লা ক্রয়ের দায়িত্ব সিএমসির। একটি নির্দিষ্ট চুক্তির অধীনে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা ক্রয় করা হয়। এ রিপোর্ট লেখাকালীন সময়ে বর্তমানে প্লান্টে আর বড়জোড় সপ্তাহখানেক সময় ব্যবহারের কয়লা মজুদ আছে। কয়লা না হলে এরপর বন্ধ হয়ে যেতে পারে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর আগে প্রায় ১৫ দিনের উপর হতে চললো রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও বন্ধ রয়েছে। তবে কিঞ্চিত আশার আলো রামপাল নিয়ে। কেননা কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ শীগ্রই দেশে পৌঁছার কথা। উল্লেখ্য, দেশে প্রচণ্ড তাপাদহ ছাড়াও এ সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। 

আসলে গরম যত বাড়ছে চাহিদাও বাড়ছে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় চালু থাকা এখন অপরিহার্য। এরই মাঝে ডলার সংকটে কয়লা কিনতে ব্যর্থ হয়ে এবং কারিগরি ত্রুটির ফলে কয়েকবার উৎপাদন স্থগিত হয়েছে। এদিকে গ্যাস উৎপাদন ক্রমাগত কমতে থাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করেও গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোকে চাহিদা মোতাবেক গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমনকি ডলার সংকটে চাহিদা মোতাবেক তরল জ্বালানি আমদানী করতে না পারে সেখানেও সংকট আছে। এমতাবস্থায় ২৩,৩৩২ মেগাওয়াট গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ ক্ষমতা নিয়েও জুন ২০২৩ থেকে জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট ঘনীভূত হতে পারে। 

কিছুদিন আগে জ্বালানি উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন সরকার জ্বালানি ক্রয়ের জন্য ডলার ক্রয়ের ব্যবস্থা করায় গ্রীষ্মকালে সংকট হবে না। পাওয়ার সেল মহাপরিচালক যথারীতি বলছেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।  তাহলে প্রশ্ন থাকবেই কেন বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা টেকসই হচ্ছে না?

বর্তমান সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৩ প্রায় ১৪ বছর ৬ মাস রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। কেউ অস্বীকার করবে না বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণে বেড়েছে। সারা দেশ বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় এসেছে। কিন্তু পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল প্রাথমিক জ্বালানি আয়োজনে সরকারের ব্যর্থ কৌশলের কারণে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও ধুঁকছে বিদ্যুৎ খাত। সরকার নিজেদের কয়লা উৎপাদনে সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি। গ্যাস তেল অনুসন্ধান হয়েছে ন্যূনতম, ঝুঁকি ব্যাবস্থাপনা না করেই আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে গেছে বাংলাদেশ। ফলশ্রুতিতে নানা কারণে বিশ্ব জ্বালানি বাজার অস্থির হয়ে পড়ায় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।  

প্রশ্ন আছে, কেন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা তুলছে না বাংলাদেশ? কেন বাংলাদেশ যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন করছে না এখনো? কেন সঠিক ব্যবস্থাপনার অধীনে সৌর বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য নবায়ণযোগ্য জ্বালানির যোগান বাড়ানো হচ্ছে না?

উত্তর একটাই সরকারের উপদেষ্টারা সরকারকে ভ্রান্ত উপদেশ দিয়ে বিভ্রান্ত করে জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে রেখে ঘোলা পানিতে জ্বালানি সিন্ডিকেটকে মাছ শিকার করার সুযোগ দিচ্ছে। 

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার হুমকির মধ্যে রয়েছে বলে খবর দিয়েছে বিবিসিও। গত ২ মে প্রকাশিত বিবিসি বাংলা গুরুত্ব সহকারে সংবাদটি প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছে- বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সংকটের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানির বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ। এর আগো গত ২৩শে এপ্রিল থেকে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে কয়লা সংকটের কারণে।

বিসিবি তাদের বিশেষাজ্ঞদের মতামত দিয়ে বলছে- কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয় পড়বে। সাধারণ মানুষ যেমন লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়বে এর পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজগুলোতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা সংকট প্রসঙ্গে বিবিসি জানায়- পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। প্রতিদিন ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১১ থেকে ১২ হাজার টনের বেশি কয়লা প্রয়োজন হয় এই কেন্দ্রে। ২ মে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়- বর্তমানে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার মজুত রয়েছে ১৫ থেকে ১৬ দিনের মতো। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরেশেদুল আলম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, আমদানির বিল বকেয়ার কারণে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, “সবসময় ছয় মাসের বাকিতে কেনার চুক্তি আমার হয়েছে। কিন্তু আমি ছয় মাস পরেও পেমেন্ট করতে পারছি না। যেমন জানুয়ারিতে যে কয়লার পেমেন্ট তারা করেছে সেটা জুলাইয়ে আমার পেমেন্ট করার কথা কিন্তু সেটা করতে পারছি না। ফলে ছয় মাস পর আমার পেমেন্ট ওভারডিউ হয়ে গেল।” বকেয়া বিল পরিশোধ করা না গেলে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন বা সিএমসি আর টাকা দেবে না। আর সেটা না হলে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও কয়লা সরবরাহ করবে না, বলেন মি. খোরশেদ। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যৌথ মালিকানায় রয়েছে, বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিএমসি। এখানে উল্লেখ্য, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইন্দোনেশিয়ার যে কোম্পানি কয়লা সরবরাহ করে সেই কোম্পানির কয়লার দাম পরিশোধ করে সিএমসি। অর্থাৎ, সিএমসি কয়লা ক্রয়ের ছয়মাস পরে বাংলাদেশ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে। এমন বিষয় চুক্তিতে উল্লেখ আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ডলার সংকটের কারণে ছয়মাস পরেও বাংলাদেশ সিএমসিকে অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। খোরশেদ আলম আরো বলেন “ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সবসময় প্রোভাইড করে আসছে সিএমসি। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হলো আমরা ইন্দোনেশিয়া থেকে যে কয়লা কিনছি সেই কয়লার ইনভয়েসের এগেইনস্টে তারা এলসি করে পেমেন্ট করছে। ওদের পেমেন্টটা হলো ডেফার্ড পেমেন্ট, ছয়মাসের দেরিতে পরিশোধের পেমেন্ট। অর্থাৎ জানুয়ারিতে যে পেমেন্ট তারা করবে ওইটা আমরা জুলাইয়ে পরিশোধ করবো। চুক্তিটা এরকম। সেক্ষেত্রে আমরা ছয়মাসেও তাদের পেমেন্টটা করতে পারছি না। ছয়মাসের উপরে আরও পাঁচ মাস চলে গেছে এখনও সেটা শোধ করতে পারতেছি না।” তিনি যোগ করেন,“ফরেন কারেন্সির (ডলার) যে ক্রাইসিস চলছে সেজন্য বকেয়া পরিশোধ অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওভারডিউ পেমেন্ট না করলে তো তারা আর কয়লা দিবে না।” 

এদিকে সর্বশেষ, তথ্য অনুসারে কিছুটা আশার আলো রামপাল নিয়ে। কয়লার অভাবে ২৪ এপ্রিল থেকে এটি শেষবারের মত বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে আমদানি করা কয়লার জাহাজ গত ৯ মে মঙ্গলবারই চট্টগ্রামে পৌঁছার কথা ছিল। আর সেটা হলে এর দুই দিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। এতে কিছুটা হলেও দূরীভূত হবে ক্রাইসিস। এছাড়াও  

যেহেতু গ্রীষ্মকাল। এ মুহূর্তে দেশ পুড়ছে প্রচন্ড তাপাদহে। এতে করে বিদ্যুৎ এর চাহিদা কমছে না। দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ চাহিদা অন্যসব বারের চেয়েও বেশি। পরিস্থিতির আরো উন্নতি না হলে লোডশেডিংয়ের  ভয়াবহতা শুরু হতে পারে। কেননা ডলার সঙ্কটে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)