কোন পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর এই সংকেত?


সালেক সুফী , আপডেট করা হয়েছে : 24-05-2023

কোন পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর এই সংকেত?

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে সাংবাদিক সম্মেলনে নির্বাচন, রিজার্ভ পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেসব দেশ বাংলাদেশকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বা দেবে তাদের কাছ থেকে কিছু ক্রয় বা আমদানি না করা। প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিকভাবে অনেক কথা নানা সময় বলার জন্য বলেন। তিনি সরকারপ্রধান বলে অনেকগুলো বাস্তবায়ন হয় কিছু হয় না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কথা নিয়ে প্রতিবাদ বা বিতর্ক করবো না। বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান মেরুকরণ সময়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য উভয় সংকট বৈদেশিক সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখা। তাই নাজুক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে নানাজন নানা সমীকরণ করতে পারে। বাংলাদেশকে এযাবৎ একমাত্র একটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথিত অভিযোগে এলিট বাহিনী র‌্যাবের কিছু প্রাক্তন এবং বর্তমান কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেটি নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। র‌্যাব যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সৃষ্ট এবং র‌্যাবের কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। হয়তো কোনো নির্দিষ্ট কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মাঝেমধ্যে ওরা বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। যেমন মায়ানমারের বিরুদ্ধে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে, ইরান, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিন্তু বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। জানিনা প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করেই কথাটি বলেছেন কি না। তবে দেখতে হবে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি হলে সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতি বহন করতে পারবে কি না। 

বর্তমানে পারস্পরিক বাণিজ্যিক ভারসাম্য কিন্তু বাংলাদেশের অনুকূলে। বর্তমানে আমদানির চেয়ে সাড়ে তিনগুণ বেশি পণ্য বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়, যা মোট রপ্তানির ১৯ শতাংশ। মূল রপ্তানি পণ্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের আমদানির মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭৪০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। বিপরীতে আমদানি করেছে ২৮৩ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য।  সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি স্থগিত করলে কিছু যাবে আসবে না। ওই সব পণ্য বহু দেশ কিনে নেবে। কিন্তু পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পণ্য আমদানি স্থগিত করলে মহাবিপদ হবে বাংলাদেশের। পোশাকশিল্পে সৃষ্টি হবে মহাসংকট। 

২০২১-২২ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি মোট রপ্তানি আয়ের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ।  বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে  খনিজ পণ্য, জ্বালানি উপকরণ, বিটুমিন, আয়রন, স্টিল, তৈলবীজ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, সুতা, ওষুধ পরমাণু উপকরণ। এছাড়া শিল্পের যন্ত্রপাতি, রেলওয়ে সামগ্রী, ইলেকট্রনিক ও ফটোগ্রাফিক উপকরণ, রাসায়নিক পণ্য, জাহাজ, আধুনিক নৌকা ও জৈব পণ্যও আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে খনিজ পণ্য। এর বিপরীতে দেশটিতে বাংলাদেশ রপ্তানি করছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, পাটজাত পণ্য, চামড়া ইত্যাদি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক। ৬৯০ কোটি ডলার আয় হয়েছে পোশাক রপ্তানি থেকে। এ ছাড়া হিমায়িত খাদ্য ৪ কোটি ডলার, হোম টেক্সটাইল ৬ কোটি ডলার, পাটজাত পণ্য ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার, চামড়াজাত পণ্য ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলার, হস্তজাত পণ্য ৬০ লাখ ডলার ও অন্যান্য পণ্যে ২৭ কোটি ডলার আয় হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির মধ্যে ৮৮ শতাংশই তৈরি পোশাক। বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য পণ্য।

রাজনৈতিক সম্পর্ক সাধারণত অর্থনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না। এই যে মায়ানমার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব এতো সোচ্চার তখনো অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউ দেশগুলোতে মায়নামারের মানুষগুলো থাকছে, ব্যবসা বাণিজ্য করছে। চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকার পরেও পশ্চিমা বিশ্বে চুটিয়ে ব্যবসা করছে চীন। আর বাংলাদেশের পক্ষে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিরোধ করা বাস্তব সম্মত না। নানা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। 

কি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, কি সংকেত দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য দিয়েছেন তিনি জানেন। মনে হয় এভাবে কথাটি উনি না বললেই ভালো হতো। সর্বোপরি উনি নিজে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে এলেন তখন এই ধরনের কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। কথাগুলো বাস্তব সম্মত নয়। 

প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হঠাৎ করে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত এবং সৌদি আরব কূটনীতিকদের বিশেষ পুলিশ প্রহরা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিলেন। ঢাকায় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে চার দেশের রাষ্ট্রদূতদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রদান করা হতো। দেশের রাজনীতিতে বিদেশি দূতাবাস সম্পৃক্ত হওয়া নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করাই যায়। আর এটি এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়ার কী আছে। 

সবাইকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের যেমন বহির্বিশ্বে বন্ধু আছে, বৈরী ভাবাপন্ন মহলও আছে। অত্যন্ত নাজুক সময়ে সবকিছু গভীর চিন্তা করে করা উচিত। সবকিছু সবাইকে খোলামেলা জানানোর প্রয়োজন নেই। কিছু কৌশলগত স্পর্শকাতর বিষয় কৌশলগতভাবেই করতে হয়। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যেভাবে নিরাপত্তা দিতে হয় সেটি বাংলাদেশকে দিতেই হবে। একইভাবে কূটনীতিকদের বড়সড় দায়িত্ব আছে। আর সেটা কিছু সীমারেখা অতিক্রম না করা। বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকা- নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে। ফলে এমতাবস্থায় সেটা হয়তো তারাও মেনে চলবেন যথারীতি।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)