একতরফা নির্বাচন করতে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 24-05-2023

একতরফা নির্বাচন  করতে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ

আরেকটি একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এবার শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা নয়, শক্তিশালি রাজনৈতিক সাংগঠনিক অবস্থান তৈরি করে রাখতে কঠোর হয়েছে আওয়ামী লীগ। একতরফার নির্বাচনের মতো কঠিন কাজটি সম্পন্ন করতে আগে ভাগেই শক্ত গ্রাউন্ড তৈরি করে ফেলতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। আর এমন লক্ষ্য পূরণে আওয়ামী লীগ তার দলের একেবারের শীর্ষ পর্যায় থেকে একারণেই বিএনপি’কে প্রতিরোধ করার ডাক দিয়েছে, যার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে একতরফা নির্বাচনে যেনো দলটি (বিএনপি) কোনো শক্ত বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। কেননা ইতোমধ্যে ৫ সিটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। খবর বিভিন্ন সূত্রের। 


প্রতিরোধ ঘোষণার প্রেক্ষাপট...

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর কয়েক মাস বাকি। বিএনপি এতোদিন বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আছে। তাদের দাবি মধ্যে ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তি। সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির দাবিটা অনেকটা প্রকাশ পায়নি। এসব দাবিতে দল বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েই আসছে বিএনপি। এসব দাবি নিয়ে দলটি সারা দেশে গত দুই বছরে চষে বেড়িয়েছে, করেছে বিভাগীয় সমাবেশও। আর সময় যতো ঘনিয়ে আসছে ততো বিএনপি’র তার মূল দাবি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এখন আন্দোলনই জোরদার করছে বিএনপি। সরকারের পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে এক দফা আন্দোলন করার পরিকল্পনার কথা দলটি এখন প্রকাশ্যেই বলেছে। আর এজন্যই পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। বিভিন্ন দলের সাথে করছে যুগপৎ আন্দোলন। গত ডিসেম্বর থেকে ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিএনপি এখন থেকে এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করবে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর মির্জা ফখরুল এমন ধরনের বক্তবেই মূলত সব কিছু পাল্টে যায়। 

পরিস্থিতি পাল্টানোর কিছু নমুনা...

আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন ধরনের বক্তবেই মূলত আওয়ামী লীগ হার্ড লাইন চলে গেছে। সব কিছু পাল্টে গেছে, এতোদিন ধরে বিএনপি’র বিভিন্ন কর্মসূচির বিপরীতে শান্তি সমাবেশ পালনকারি দলটির (আওয়ামী লীগ) পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক খবর পর্যালোচনয় দেখা যায় গত ২০ মে শনিবার  বিকেলে লালমনিরহাটে এক জনসভায় দেওয়া ভাষণে আর ১০ দফা নয়, এখন থেকে এক দফার আন্দোলন করবেন বলে জানালেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর এর পর থেকেই যেনো সরকার নড়ে চড়ে বসেছে। ক্ষমতাসীন দল মনে করে এখন যদি বিএনপি’র লাগাম না ধরা হয় তাহলে তারা আরো কঠোর হয়ে যাবে। এতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে। আর এজনই খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজধানীতে এক সমাবেশে বলে ফেলেন, এখন থেকে শান্তি সমাবেশ নয়, সারা দেশে বিএনপিকে প্রতিরোধ করতে হবে। যুক্তি হিসাবে খাড়া করে বলেন, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের নামে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে বলে দাবি করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, বিএনপির সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য এখন থেকে শান্তি সমাবেশ নয়, সারা দেশে বিএনপিকে প্রতিরোধ করতে হবে। 

শুরু হয়ে গেলো প্রতিরোধ...

ঘটনা এক..

বলতে দেরি নেই শুরু হয়ে গেছে বলা চলে প্রতিরোধ। বিএনপির সমাবেশে যোগ দেওয়ায় ছাত্রদল নেতাকে পেটালেন ছাত্রলীগ নেতা। ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের দুই সদস্যকে মারধর করেছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। ২২ মে সোমবার বেলা পৌনে একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবন-সংলগ্ন লিপু চত্বরে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত এক ছাত্রদল নেতাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মারধর করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের নেতা সাকিবুল হাসান ওরফে বাকি। তিনি নিজেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। গণমাধ্যমে তারা বলেছেন রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। সেখানে ছাত্রদলের চিহ্নিত কয়েকজন নেতা-কর্মী আনন্দমিছিল করেন এবং সমাবেশ সফল করতে সেখানে যোগ দেন। ক্যাম্পাসে দেখতে পেয়ে তাঁদের প্রতিরোধ করা হয়েছে।

ঘটনা.. ২

গত ১৯ মে শুক্রবার খুলনায় বিএনপির সমাবেশে পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটেছে। নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে এ সময় বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারগ্যাস ছোড়া হয়। এতে বিএনপির বেশকয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। শুক্রবার বিকাল ৪টায় প্রেসক্লাব এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় পুলিশ গুলি ছুড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা। তাদের দাবি, পুলিশের ছোড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে দিঘলিয়া সেনাটি ইউনিয়ন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মুজিবুর রহমান, যুবদল নেতা জাহিদুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ পুলিশ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার পর শত শত নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে দিয়েছে। এদিকে পুলিশের কড়াকড়ি ও অনুমতি না পেয়ে রাজশাহী মহানগরীতে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করতে পারেনি বিএনপি গত ২৩ মে মঙ্গলবার। তবে জেলার ছয়টি থানায় তারা পদযাত্রা করছেন। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘পুলিশ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অজুহাত দিয়ে বিএনপিকে পদযাত্রার অনুমতি দেয়নি। তারা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সিটিতে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। তবে রাজশাহীর ছয়টি থানায় ইতোমধ্যে কর্মসূচি শুরু হয়েছে।’ অপরদিকে ২২ মে সোমবার প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে নেত্রকোনায় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিএনপির কার্যালয়ে তালা ভেঙে চেয়ার বাইরে এনে আগুন ধরিয়ে দেন।

ঘটনা-৩

ঢাকার ধানমন্ডিতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। ২৩ মে মঙ্গলবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে ধানমন্ডির সায়েন্স ল্যাব এলাকায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।এ সময় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করেন। এ ঘটনার আগেই ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনার জন্য পুলিশ ও বিএনপি নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। বিএনপির অভিযোগ, তাদের শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা আটকে পুলিশ লাঠিপেটা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। আর পুলিশ বলছে, বিএনপির মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। সংঘর্ষের সময় বিএনপির ধানমন্ডি থানার সাবেক সভাপতি রবিউল ইসলাম, ওই থানা শাখার সাবেক সদস্যসচিব সৈকতসহ কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন।

বিএনপির বিকল্প হতে প্রস্তুত

এদিকে এবারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে তার বিকল্পও তৈরি করে রেখেছে ক্ষমতাসীনরা। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে বিএনপি বিকল্প হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নামে একটি রাজনৈতিক দল। নিবন্ধনের পর দলটির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম দৃশ্যমান হবে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয় বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে, এই বিএনএমের ব্যানারে বিএনপির অন্তত অর্ধশত নেতা নির্বাচন করতে পারেন। আবার একটি সূত্র জানায়, বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন জোট থেকেও কেউ কেউ অংশ নেবে বলে গুঞ্জন আছে। গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের সরে যাওয়াকে এমন ইঙ্গিত বলে অনেকে মনে করেন। 

মার্কিন দূতাবাসের সতর্ক বার্তাতে একই আভাস..

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। ২১ মে রোববার বিকেলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে সতর্কতামূলক ওই পরামর্শ প্রদান করা হয়। ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’ শীর্ষক ওই সতর্কবার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগে বা ওই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচন সামনে রেখে এরইমধ্যে রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ও অন্যান্য নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশে থাকা মার্কিন নাগরিকদের আগাম সতর্কতা মেনে চলা উচিত। এখানে প্রশ্ন দেখা গিয়েছে মার্কিন দূতাবাসের সতর্ক বার্তাটি কোনো এতো আগেভাগে দেয়া হলো। মার্কিন দূতাবাসের কাছে কি খবর আছে সরকার এবারো জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সেরে ফেলতে চায় অংশগ্রহণমূলক ছাড়া অর্থ্যাৎ একতরফা? তাদের কাছে এধরনের খবরেরই পরিপ্রেক্ষিতেই সম্ভবত এমন সর্তক বার্তা জারি করা হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। 

শেষ কথা..

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে তারা এবারে ২০১৪ বা ২০১৮’র মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না। আবার বিএনপি’র এসরকারের অধীনে কোনোভাবেই নির্বাচন অংশ নেবে না। এর পাশাপাশি বিএনপি’র সর্বশেষ গন্তব্য একদফা আন্দোলন, যা মূলত সরকারের পদত্যাগ। দিন যতো যাচ্ছে বিএনপি একের পর এক কর্মসূচিই দিয়ে যাচ্ছে সে ধরনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ এখন থেকে শক্ত না হলে একতরফা নির্বাচন করা আগের মতো সম্ভব হবে না। 

একটি সূত্র জানায় আওয়ামী এবারেও একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে ফেলতে যাচ্ছে। আর একারণে বিএনপি’কে ছাড়া একতরফা নির্বাচন আয়োজন করতেই দলটি কঠোর হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। সামনের দিনে হয়তো সেলক্ষ্য পূরণের আরো কঠোর হবে আওয়ামী লীগ সরকার। চারিদিকে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের গ্রেফতার আর মামলার জালে আটকানোর মতো কর্মকান্ড দেখে তাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)