অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রচণ্ড চাপ


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 31-05-2023

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রচণ্ড চাপ

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে চারদিক থেকে ক্রমশই বাড়ছে চাপ। বেশ কিছুদিন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ও কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলো বিভিন্নভাবে তাগিদ দিয়ে আসছিল। কিন্তু তাতে খুব একটা সুফল হয়তো দেখা যাচ্ছিলো না। এরপরই দ্বিতীয় উদ্যোগ। যার সূচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি জে ব্লিঙ্কেন। সেটাতে স্পষ্ট করেছে তারা পরবর্তি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যারাই বাধাদান করবে সেটার আদেশ দাতা ও বাস্তবায়নকারী উভয়ের ও তাদের পরিবারবর্গের ভিসা দেবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবং সে তালিকায় কারা কারা রয়েছেন সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কী কী কাজ করলে তারা ওই ভিসা প্রাপ্তির যোগ্য হবেন না সেটাও। ওই ঘোষণা নিয়ে বাংলাদেশে এখন তোলপাড়। স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন সব। কারণ জাতীয় নির্বাচন সম্পদান করতে প্রয়োজন পড়ে আইনশৃংখলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি, আমলা প্রশাসনে থাকা সর্বস্তরের লোকবল। ব্লিঙ্কেনের ঘোষণায় উক্ত সবার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে সাথে বিচার বিভাগে কর্মকতারাও। রাজনীতিবিদরা তো আছেনই। সেখানে উল্লেখ রয়েছে সরকারি দল ও বিরোধী দলও। একই সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তাদেরও ওর আওতাভুক্ত করে ফেলেছেন তারা। অর্থাৎ কেউ যদি অমন কর্ম করে এখন রিটায়ার্ড করে ফেলেছেন, তাকেও ওই আওতায় আনা হয়েছে। ফলে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে বাধাদানকারী কাউই আর রেহাই পাচ্ছেন না। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তার নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে বিশ্বে যেসকল দেশে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বা কম, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন। ওই ধারায় দু’বার বাংলাদেশকে তার গণতান্ত্রিক সম্মেলনে আহ্বান করেনি। এতেই প্রমাণিত হয়েছিল, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারায় সন্তুষ্ট নয়। সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানালেও বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে রোডম্যাপ চেয়েছে। কিভাবে বাস্তবায়িত হবে। ওইসকল কর্মকান্ডেও তারা ইতিবাচক না হয়ে শেষতক ভিসানীতির উদ্যোগ। অনেকেই ধারণা করছেন মার্কিন এ চাপ আরো বাড়তে পারে নানা ফর্মুলায়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ সফল হয় সেটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। তাদের বক্তেব্যেই জানা গেছে যে, যে উদ্দেশ্যে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার উপর স্যাংশন দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। তাতে বাংলাদেশে বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড শুন্যের কোঠায় নেমে আসে। বদলে যাওয়া র‌্যাবের ওই কর্মকান্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট। তবুও তাদের উপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা তুলতে আরো সময় নিবে বলে জানিয়েছেন তারা। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন মনে করবে সব ঠিকঠাক ঠিক তখনই ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। যেহেতু তাদের একটি উদ্যোগ সফল তাই তারা এবার সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের জন্য নতুন এক নীতিতে শামিল হয়েছেন। 

যার অর্থ- বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ তাদের নিজের ভোট ভয় ডর বিহীন এক পরিবেশে ভোটদান করে যাতে নিজেদের নেতা বা প্রতিনিধি বেছে নিতে পারেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটাই নিশ্চিত করতে চায়। বারবার মার্কিন দূতাবাস বলে আসছে যে আমরা কোনো দলের সমার্থক নই। আমরা চাই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোটের আস্থা ফিরে আসুক। ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা চালু হোক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই ভিসানীতিতে ভেতরে ভেতরে তোলপাড় সংশ্লিষ্টরা। কারণ দেশের ওই স্তরের লোকজনের বেশিরভাগের প্রত্যাশা রিটায়ার্টের পর তারা ফ্যামিলি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা, ইউরোপে পাড়ি জমাবে। এদের মধ্যে অনেকের ফ্যামিলি বা সন্তানাদি এখনও অবস্থান করছেন ওইসব দেশে। ফলে এমন ভিসানীতির আওতায় পড়লে সবার জন্যই মারাত্মক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।   

ইউরোপীয় ইউনিয়ন 

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রত্যাশা বা চাওয়া ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বাংলাদেশের অন্যান্য দাতাদেশসমূহেরও। ২৭ মে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাতকারে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে ইউরোপের বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত হতে পারে। তবে এর জন্য মানতে হবে বেশকিছু শর্ত। 

চার্লস হোয়াইটলি বলেন, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তবে তা দারুণ ইতিবাচক সিগন্যাল দেবে যে বাংলাদেশ জিএসপি প্লাসের জন্য প্রস্তুত। কারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ওপর আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী সবার ন্যূনতম নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার থাকতে হবে। তিনি জানান, আগামী ৮ জুলাই ১৩ দিনের মিশনে বাংলাদেশে আসছে নির্বাচন পূর্ব পর্যবেক্ষক দল। তারা রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ সবার সঙ্গে কথা বলবে। এখানের পরিবেশ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে। শুধু ব্যালট বাক্স ও ভোটিং পদ্ধতির স্বচ্ছতাই দেখবে না।

অস্ত্র ছাড়া ইউরোপে শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় বাংলাদেশ। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশই যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। স্বল্পন্নোত দেশ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে, ২০২৯ সালে জিএসপি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ সুবিধা হারালেও জিএসপি প্লাস নামে আরেকটি নতুন সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যাতে মিলবে জিএসপি’র মতো প্রায় একইরকম সুবিধা।

কিন্তু, এ জন্য মানতে হবে ৩২টি শর্ত। যার অন্যতম শর্ত হলো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন প্রধান বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নীতি গ্রহণ করেছে, আমাদেরটা ভিন্ন। আমরা নির্বাচনী পূর্ব মিশনে গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে আমার বিশ্বাস রাজনৈতিক দলগুলো জানে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। কোন দল অংশ নেবে একান্তই তাদের পছন্দ। যদি কোনো অবিশ্বাস থাকে তবে সংলাপে বসতে পারে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিতকরণের দাবি 

স্বাধীনভাবে কাজে বিশ্বাসী সুশীল সমাজের ওপর সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নানাবিধ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চরম দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অলিভিয়ার ডি শ্যুটার। তিনি বলেন, ওই আইনের অধীনে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদদের তাদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগের কারণে আটক করা হয়েছে। বাংলাদেশে ১২ দিনের সফর শেষে গত সোমবার (২৯ মে)  রাজধানীর একটি হোটেলে তিনি এসব বলেন।

ডি শ্যুটার বলেন, এই বিষয়গুলো দেশটি যে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে শুধু তাদেরই শঙ্কিত করবে না, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে। আপনি জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বা সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারবেন না।

জাতিসংঘের এই দারিদ্র্য বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে প্রত্যাশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার পর একটি অধিকার-ভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। মানুষকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে একটি দেশ তার আপেক্ষিক সুফল বা উন্নয়ন ভোগ করতে পারে না। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের মতো একটি রপ্তানি খাত দ্বারা ব্যাপকভাবে চালিত, যা সস্তা শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।

ডি শ্যুটার সরকারকে ২০২৬ সালে এলডিসি মর্যাদা থেকে আসন্ন উন্নীতকরণের সুযোগকে ব্যবহার করে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর তার নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানান, কারণ ওই শিল্প ৪ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বর্তমান রপ্তানি আয়ে শতকরা ৮২ ভাগ অবদান রাখছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যতো উন্নীতকরণের পথে এগুচ্ছে, ততো এটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স-প্রণোদনা প্রদান এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)