এ মুহূর্তে পাতাল রেল কি বিলাসিতা?


সালেক সুফী , আপডেট করা হয়েছে : 28-04-2022

এ মুহূর্তে পাতাল রেল কি বিলাসিতা?

 মহানগরী ঢাকার অসহনীয় যানজট নিরসনের জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের পর এখন পাতাল রেল নির্মাণের তোড়জোড় চলছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে, মাটির গভীরে  পাতাল রেল প্রকল্পে প্রতিদিন যাতায়াত করতে পারবেন ৮০ লাখ মানুষ। মাটির ওপরের মেট্রোরেল যেসব জায়গায় পৌঁছবে না; সেসব এলাকার ১১টি রুটে চলবে সাবওয়ে। ২০৩০ সালের মধ্যে চারটি এবং ২০৫০ সালের মধ্যে পুরো পাতাল রেলের কাজ শেষ করতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ বিলিয়ন ডলার।

 যার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় হচ্ছে ৩২১ কোটি টাকা। যাদের পাতাল রেল বিষয়ে বাস্তব ধারণা আছে, তারা অনেকেই এখন বলছেন ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে পাতাল রেল এখন বা অদূর ভবিষ্যতে সেরা বিকল্প নয়। বরং এই বাবদ প্রাক্কলিত বরাদ্দের কিছু অংশ সিটি সার্কুলার নদীপথ, সার্কুলার সড়ক, রেল এবং ঢাকা সংলগ্ন জেলাগুলোর সড়ক উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হলে, অধিকতর উপযোগী হবে। সঠিক পরিকল্পনা করে ঢাকা মহানগরীর ৩০-৪০ শতাংশ জনগণকে ঢাকার আশপাশে শহরগুলোতে স্থানান্তর করা গেলে, আরবান রুলার রিভার্স মাইগ্রেশন করা হলেই একসময়ের তিলোত্তমা ঢাকাকে ১৯৬০, ১৯৭০ রূপে ফিরিয়ে নেয়া যাবে।

বিশ্ব পরিস্থিতি ভীতিজনক অর্থনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ (প্রকারান্তে দুই পরাশক্তি বলয়ের প্রক্সি যুদ্ধ) কোনো পরিণতির দিকে ধাবিত হয় নিশ্চিত নয়। ভেবেচিন্তে আগাতে হবে বাংলাদেশের মতো সদ্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির কাতারে উন্নয়নের জন্য বিবেচিত দেশকে। পাতাল রেলের মতো বিলাসী উচ্চাকাক্সক্ষা প্রকল্প হজম করার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি বাংলাদেশের। ঢাকার জন্য পরিকল্পিত কৌশলগত যানবাহন পরিকল্পনার (এসটিপি) সুপারিশ ও বাস্তবায়ন করলে পাতাল রেল প্রয়োজন হবে না। এই ধরনের ব্যয়বহুল বিলাসী প্রকল্প গ্রহণের হঠকারিতা করা আত্মঘাতী হতে পারে। 

ঢাকার প্রধান সমস্যা অতিরিক্ত জনসংখ্যা 

ঢাকা মহানগরী দৈর্ঘ প্রস্থে তুলনামূলকভাবে না বাড়লেও জ্যামিতিক হারে বেড়েছে জনসংখ্যা। ঢাকা শহরের উন্নয়ন কোনো বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা মেনে হয়নি। এখন সময়ের অভিজাত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান হয়ে পড়েছে ক্যানসারের বস্তি। সেই পথে আগুয়ান উত্তরা। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য বিতান, হাসপাতাল, ক্লিনিক। ৭০ লাখবড়জোর ১ কোটি মানুষের ধারণ ক্ষমতার ঢাকা মহানগরীতে এখন ২ কোটির ওপরে মানুষের আবাসস্থল। 

সকল মানুষের জল, জ্বালানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ক্রমশই দুরূহ হয়ে পড়ছে। কোনো সরকার সাহস পাচ্ছে না পিলখানা বিজেবি সদর দফতর, পুরোনো বিমানবন্দর থেকে বিমানবাহিনী স্থাপনা, ঢাকা সেনানিবাস স্থাপনা ঢাকার বাইরে সুবিধাজনক স্থানে স্থানান্তর করার। বলা হলেও করা হচ্ছে না কেন্দ্রীয় সচিবালয়, ঢাকা মহানগর কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণ। 

কেন পাড়া-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলো গার্মেন্টস পল্লীতে স্থানান্তর করা যাচ্ছে না? ঢাকার বাইরে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করা যাবে না। শুনলাম, ঢাকা উত্তর মেয়র আক্ষেপ করছেন রাজউকের পরিকল্পনায় আছে খেলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র। কিন্তু বাস্তবে এগুলো প্লট করে আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।

উন্নত দেশে সকল মহানগর কেন্দ্র বিশেষভাবে উন্মুক্ত থাকে। প্রতিবেদকের জার্মানি, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ভারতে পাতাল রেল অভিজ্ঞতা আছে। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নগরীর কেন্দ্রস্থলে পাতাল রেলভ্রমণ করেছি। আমি ঢাকা মহানগরীকে বিদ্যমান অবস্থায় এবং অদূর ভবিষ্যতে পাতাল রেলের উপযোগী মনে করি না। 

ঢাকার মাটির নিচে গ্যাস, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন লাইনগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে। আজ বিল্ট নকশাগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। গ্যাস পাইপলাইন শত ছিন্ন হয়ে নিয়মিত দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে। পানির লাইন ছিদ্র হয়ে, পুটি গন্ধময় পয়ঃবর্জ্যঢুকে পড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অসংখ্যামূলকভাবে নেমে যাওয়ায়, ঢাকা ভূমিকম্পর সম্ভাবনা তীব্র হচ্ছে। এহেন অবস্থার অবসান না ঘটিয়ে পাতাল রেল নির্মাণ করা কতটা বাস্তবসম্মত সেটি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। 

অন্যান্য অনেক মহানগরী থেকেও ঢাকা অনেক ভাগ্যবান। অধিকাংশ নগরী একটি নদীকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছে। যেমন লন্ডন টেমস, মেলবোর্ন ইয়ারা, ব্রিসবেনে, ব্রিসবেন রিভার, জার্মানির কিছু নগর রায়ীন, করাচি সিন্দু নদী।

ঢাকার বুড়িগঙ্গা, শীতালক্ষ্যা, বালু, তুরাগ। দখলদারদের আগ্রাসনে যদি খাল বা নদীগুলো মৃতপ্রায়। এখনো সুযোগ আছে, এগুলোকে বাঁচিয়ে ঢাকাকে বসবাস অযোগ্য নগরীর কলঙ্ক থেকে রক্ষা করার। কেন ঢাকার বুক চিরে একসময় বহমান খালগুলো উদ্ধার করে আমস্টারডাম বা ভেনিসের মতো গন্ডোলা চালু করা যাবে না? প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের ভিশন ছিল। উত্তরসূরি উত্তরের মেয়র চেষ্টা করছেন। ইদানীং দক্ষিণের মেয়রকে খুব একটা শোনা যাচ্ছে না। চামড়াশিল্প কেন্দ্রটাই এখনো পর্যন্ত সঠিকভাবে সরানো গেলো না।

যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরে যাই। অনেক মহানগরী করেছে বলেই তথাকথিত ফরমায়েশি সমীক্ষার ভিত্তিতে পাতাল রেল প্রকল্পের মতো অপরিণামদর্শী প্রকল্প ঢাকার জন্য উপযোগী কিনা তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয় জরুরি।

এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প হয়তো বাংলাদেশকে একসময় ঋণ জর্জর দেউলিয়া অর্থনীতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। সমন্বিত পরিকল্পনা না করায় হয়তো পদ্মা সেতু জুন থেকে চালু হলে ঢাকা মহানগরীর আগমনী দরজা আরো সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে। আগে দেখতে হবে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কি প্রভাব ফেলে।তারপর ভেবে-চিন্তে নিদেনপক্ষে পাতাল রেল নিয়ে এগোনো যথাযথ হবে বলে মনে হচ্ছে। 



প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)