বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জাসদকে জড়িয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শেখ সেলিমের বক্তব্য দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় বইছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ৪০ বছর পরেও এ ঘটনা নিয়ে আবার বিতর্ক দেখা দিয়েছে। প্রতিবছরই এই নিয়ে বির্তক দেখা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শাসনামলেই। তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর শরিক জাসদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে এধরনের বিতর্কে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অতীতেও এমন বির্তকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে সেই সময়ে জোটের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিমের ধানমন্ডির বাসভবনে জরুরি বৈঠকও হয়েছিল জোটের।
আর এবার এমন সময় ঘটনা ঘটেছে যখন ১৪ দলকে সাথে নিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক মাঠে বিএনপিসহ পুরো বিরোধী দলকে মোকাবেলা করার ঘোষণা দিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ১৫ আগস্ট নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে ১৪দলের অন্যতম শরিক জাসদের এই বির্তক ক্ষমতাসীনদের মধ্যে আরো ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা আওয়ামী লীগ একা পড়ে যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জাসদকে জড়িয়ে শেখ সেলিম এবারেরও তার এক বক্তব্যে জাসদ নেতা হাসানুল হত ইনুসহ কর্নেল তাহেরকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তার এই বক্তব্য নিয়ে ক্ষমতাসীনদের আর কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। তবে ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটি এর প্রতিবাদ করেছে। ৬ আগস্ট রবিবার জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির পক্ষ থেকে দফতর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই প্রতিবাদ জানানো হয়।
এতে তে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জাসদকে যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শেখ সেলিমের বক্তব্য রাজনৈতিক দূরসন্ধিমূলক মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। শেখ সেলিম বঙ্গবন্ধুর খুনীগোষ্ঠী এবং খুনীগোষ্ঠীর পাকিস্তানপন্থার রাজনীতির ধারকদের আড়াল করার উদ্দেশ্যেই মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস পেয়েছেন। জাসদ কখনই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী গোষ্ঠীর সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর কর্নেল তাহের বা হাসানুল হক ইনু বা জাসদের কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীর কোনো যোগাযোগ ছিল না। জাসদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সুফলভোগীও নয়। কারা খন্দকার মুশতাকসহ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে হাত মিলিয়েছিল, খন্দকার মুশতাকের মন্ত্রী সভায় কারা সদস্য হয়েছিল, কারা মুশতাককে বৈধতা দিয়েছিল, কারা মুশতাকের সময় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ছিল, কারা খুনিদের রক্ষা করেছে, কারা খুনিদের পুরস্কৃত করেছে তা আজ সমগ্র জাতির সামনে প্রকাশিত।
খন্দকার মুশতাকের ৮৩ দিনের অবৈধ শাসনকালে কারাবন্দি জাসদ নেতা-কর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়নি। জাসদ খুনি খন্দকার মুশতাকের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। ঐ ৮৩ দিনেও জাসদের নেতা-কর্মীদের উপর চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাচন চালানো হয়েছে। চট্টগ্রামের জাসদ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা খসরু, রাজবাড়ীর জাসদ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা আজাদ, গাইবান্ধার জাসদ নেতা বীরমুক্তিযোদ্ধা রুস্তমসহ সারা দেশে কয়েকশত জাসদ নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘দূরের না, আপন লোকরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আমার মা যাদের রেঁধে খাওয়াতেন তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।’ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এজাহার, এফআইআর, তদন্ত, চার্জশীট, সাক্ষীদের জেরা ও সওয়াল জবাব, চার্জের উপর আদালতে যুক্তিতর্ক, আদালতের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণের কোথাও জাসদ বা জাসদের কোনো নেতার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। এটাই স্বাভাবিক ও সত্য। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সাথে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পূর্বাপর জাসদের কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। শেখ সেলিম বা কেউই মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ইতিহাসের এই সত্য আড়াল করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে জাসদকে যুক্ত করে বক্তব্য প্রদানকারী শেখ সেলিম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার আপন মামা বঙ্গবন্ধু ও আপন ভাই শেখ মনির লাশ ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সাথে যুক্ত তৎকালীন আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে কি করেছিলেন তা জাতি জানতে চায়।
শেখ সেলিমসহ কতিপয় ব্যক্তির বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আড়াল করার ঘৃণ্য রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্যই জাসদ শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং এর পূর্বাপর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন ও শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয় মহান জাতীয় সংসদে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বিবৃতিতে বলেন, যখন বিএনপি-জামায়াত ও তাদের রাজনৈতিক পার্টনার এক হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার জন্য মাঠে নেমেছে, যখন ষড়যন্ত্র চক্রান্তের রাজনীতি প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি, ১৪ দল নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৪ ঐক্যকে জোরদার করাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক ঐক্যকে সম্প্রসারিত করার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেছেন তখন শেখ সেলিম অতীতের মতই ১৪ দলসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক ঐক্যের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বিএনপি-জামাতকেই খুশি করার সুবিধাবাদী ষড়যন্ত্রের পথে হেঁটে চলেছেন।