পশ্চিমাদের চোখ রাঙানি মোকাবেলা মূল চ্যালেঞ্জ


সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ , আপডেট করা হয়েছে : 10-01-2024

পশ্চিমাদের চোখ রাঙানি মোকাবেলা মূল চ্যালেঞ্জ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে বাজারে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য, ডলার সংকট, কঠোর হাতে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি দমনের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ অনেক সমস্যা ছেয়ে গেছে। তবে এর চেয়ে সবচেয়ে বড়ো ধরনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পশ্চিমাদের চোখ রাঙানি মোকাবিলা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এমনটাই মনে করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্ট বেশ কয়েকজনের সাথে একান্তে কথা বলেও এমন অভিমত পাওয়া গেছে। তাদের মতে, ক্ষমতাসীন সরকারের মূল চ্যালেঞ্জই এটা, অর্থাৎ পশ্চিমাদের বাগে আনা। আস্থায় আনা ভবিষ্যতে চলার স্বার্থে। 

পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। আর এবার নিয়ে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন তিনি। ৭ জানুয়ারি রোববার অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এর মধ্যে ২৯৮ আসনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেস বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২২ জন, জাতীয় পার্টির ১১ জন, স্বতন্ত্র ৬২ জন ও অন্যান্য ৩ জন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের বিষয়ে ৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের (এমপি) শপথ বুধবার (১০ জানুয়ারি) সকাল দশটায় জাতীয় সংসদ ভবনের শপথ কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন।

চারিদিকে বাহবা বাহবা ॥ হঠাৎ থমকে গেছে পরিস্থিতি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। দেশে এমন খবরে আওয়ামী লীগের সর্ব পর্যায়ের নেতাকর্মীর পাশাপাশি দলটির বিশিষ্টজনেরাও উচ্ছ্বসিত। এর পাশাপাশি কয়েকটি দেশের অভিনন্দনে গণমাধ্যমের পাতা ভরাট হয়েও যাচ্ছিল গত মঙ্গলবার পর্যন্ত। খবরে বলা হয় ১৯ দেশের রাষ্ট্রদূত শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। স্ব স্ব দেশের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানান তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এসময় রাষ্ট্রদূতগণ তাদের দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণের অভিনন্দন বার্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পৌঁছে দেন। এর আগে খবরে ভরপুর যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারত, চীন, রাশিয়াসহ সাত দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। ৮ জানুয়ারি সোমবার সকালে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারত, রাশিয়া, চীন, ভুটান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূতেরা। এ সময় তাঁরা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। এর মধ্যে বাড়তি আরো খবর ছিল। তা হলো বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় দলটির সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এছাড়া পত্র-পত্রিকা জুড়ে খবর বেরোয় যে, বাংলাদেশের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিয়েছেন সরকার আমন্ত্রিত মার্কিন পর্যবেক্ষক এবং দেশটির কংগ্রেসের সাবেক সদস্য জিম বেটস। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ দেখেছেন বলেও জানান জিম। ৮ জানুয়ারি রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

ঠিক এমন সময়ে ৯ জানুয়ারি মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে একটি খবর সবাইকে নাড়া দেয়। খবরটি হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করেছে পশিচমা ক্ষমতাধর বলা চলে বিশ্বের রাজনীতির কলকাঠি যারা নাড়ায় তাদের অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। খবরে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক হয়নি। এদিকে একা যুক্তরাষ্ট্রই না, বাংলাদেশের এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে বাংলাদেশের জনগণ, গণতন্ত্রের প্রতি তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ্য করেছে যে, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার এবং নির্বাচনের দিন অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। অবশ্য বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নির্বাচনের সময়, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে যে সহিংসতা হয়েছে তার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। অন্যাদিকে কানাডাও নির্বাচন নিয়ে আরেকটি বার্তা দিয়েছে। তা ছিল এমন- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি কানাডা সরকার। সোমবার এক এক্স বার্তায় এ কথা জানায় কানাডা হাইকমিশন। বার্তায় আরও বলা হয়েছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে কানাডার যে দুই নাগরিকের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে, তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই নির্বাচনের বিষয়ে তাঁদের (দুই পর্যবেক্ষক) মতামতের সঙ্গে কানাডা সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এদিকে নির্বাচন নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক। বিবৃতিতে ফলকার তুর্ক সদ্য নির্বাচিত সরকারের প্রতি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিরোধীদের গ্রেপ্তার, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রসহ নানা বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে গণতন্ত্র অর্জিত হয়েছে এবং সেটা যেন এখন লোকদেখানো হয়ে না পড়ে। বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে উল্লেখ করেন। তবে আশঙ্কার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আন্তরকভাবে আশা করি, দেশের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও এটার প্রতিফলন ঘটবে। বাংলাদেশের সব মানুষের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মুখে। 

তাহলে কি হলো কি হতে যাচ্ছে? 

চারিদিকে যখন এমন সাজ সাজ রব আর তার মধ্যে এই কঠিন বার্তা? জানা গেছে বিষয়টি আওয়ামী লীগ ও তার সমমনাদের মধ্যে ব্যপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের এমন খবরে বিচলিত হয়ে পড়েন। এতোদিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এটা বদ্ধমূল ছিল বিশ্বের এই দুই ক্ষমতাধররা একটি প্রতিবেশি দেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চালে ম্যানেজ হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে যে তা হয়নি তা স্পস্ট হয়ে উঠায় ক্ষমতাসীন মহলের পাশাপাশি তাদের সমমনাদের মধ্যে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আরেকটি বিষয় ছিলো যা খুবই স্পর্শকাতর ও প্রশ্নবোধক। তা হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদনির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিদেশি বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ভোটের সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্রিফ করেছিল নির্বাচন কমিশন। ব্রিফিংয়ে চীন, রাশিয়া, জাপানসহ পশ্চিমা বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত-হাইকমিশনার আসেন। তবে এমন ধরনের অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা আসেননি। দু’জনই অবশ্য দূতাবাস থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ব্রিফ করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূত-হাইকমিশনার ও আন্তর্জাতিক মিশন প্রধানসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের বেশি কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে রাশিয়া, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, আর্জেন্টিনাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশের রাষ্ট্রদূত-হাইকমিশনার উপস্থিত ছিলেন। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকরা মনে করেন দেশের কঠিন চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। সাধারণ ও নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করা মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সেক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে যাতে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে। এর পাশাপাশি ডলারের সংকট নিরসন ও দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা নতুন সরকারের আরও বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তবে সব কিছু ছাপিয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ঠিক আছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-কানাডা সর্বোপরি জাতিসংঘের এমন শক্ত বিবৃতি। এমন অভিমতই প্রকাশ পেয়েছে দেশ পত্রিকার সাথে এসব বিষয়ে বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপচারিতা। তারা নাম না প্রকাশ করার শর্তে অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন গত সোমবার পর্যন্ত অর্থ্যাৎ ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও দলটির সাথে বিশিষ্টজনেরা বেশ চাঙ্গা উৎফুল্ল মুডে ছিলো। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ৯ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি একিই দিনে যুক্তরাজ্য - কানাডা এমন কি জাতিসংঘের দেয়া বিবৃতি মন্তব্য আওয়ামী লীগের ভিতকে কঠোর ভাবে নাড়া দিয়েছে। তারা মনে করে, বিশ্বের ক্ষমতাধরদের এমন বিবৃতিতে ধরে নেয়া যায় তাদের সামনের দিনের পথ মসৃণ না। এর পাশাপাশি অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের জন্য কঠিন সময় সামনে অপেক্ষা করছে, যা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্কের কন্ঠে আভাস পাওয়া গেছে। কেননা তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সব মানুষের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মুখে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)