অভিনয় জেনেই মানুষ চরিত্র বা গল্পের প্রেমে পড়ে


আলমগীর কবির , আপডেট করা হয়েছে : 17-01-2024

অভিনয় জেনেই মানুষ চরিত্র বা গল্পের প্রেমে পড়ে

মোশাররফ করিম। যার তথাকথিত চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয় চেহারা নেই। নেই সিক্স প্যাক অ্যাবসে মোড়া নায়কসুলভ পেটানো শরীর। বরং মেদযুক্ত শরীরটায় বিসদৃশ একটা ভুঁড়ি উঁকিঝুঁকি দেয়। উচ্চতাতেও মার খেয়ে গেছেন খানিকটা। অথচ এই গড়পড়তা অনায়কোচিত আদল নিয়েই নাটক, সিনেমা আর ওটিটি জগতের বেতাজ বাদশা অভিনেতা মোশাররফ করিম। ১৯ জানুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে তার নতুন সিনেমা ‘হুব্বা’। এ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন আলমগীর কবির

প্রশ্ন: অভিনয় দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন অনেক আগেই। এর নেপথ্যের গল্পটা আসলে কি?

মোশাররফ করিম: নেপথ্যের তেমন কোনো গল্প নেই। আমি থিয়েটার করার জন্য, অভিনয়ের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছি; গতানুগতিক পরিশ্রম করার লোকই আমি না। আমার পরিবার কখনো আমাকে বাজারেও পাঠাতে পারেনি। কখনো কোনো আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিতে যেতে হবে, তখন আমি পালিয়ে যেতাম। কারণ, ওখানে যাওয়াটা আমার কাছে ফাও পরিশ্রম মনে হতো। আমি করতাম না এসব। আমি আসলে ওই পরিশ্রমটাকে ভালোবেসেছি যেটা আমি ভালোবাসি। আমি যদি অভিনয়কে ভালোবাসি, আর এর জন্য প্রতিদিন ১০ মাইল হেঁটে রিহার্সালে যেতে হয় তাতে কোনো পরিশ্রম হয় না, আনন্দ লাগে। 

প্রশ্ন: কিন্তু অনেক পরিশ্রমের পর যে কাজটা তৈরি হয় সেটা নাকি আপনি দেখেন না। এর কারণ কি?

মোশাররফ করিম: এখন পর্যন্ত আমার করা কোনো কাজ-সেটা নাটক হোক বা সিনেমা-আমি ওইভাবে বলতে পছন্দ করি না যে এটা অসাধারণ হয়েছে বা এ রকম কিছু। তবে নতুন কাজটি আমি ডাবিংয়ের সময় কিছুটা দেখেছি, তাতে আমি খুশি। আমার প্রডিউসার ও ডিরেক্টর ভীষণ উচ্ছ্বসিত। ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজে দর্শকেরা আমাকে গ্রহণ করেছে, ভীষণ খুশি হয়েছে। ‘মোবারকনামা’য় খুশি হলো। আমার ধারণা, হুব্বা দেখে তারা আরও খুশি হবে।

প্রশ্ন: হুব্বায় আপনার চরিত্রটি সম্পর্কে বলুন। 

মোশাররফ করিম: আমি আসলে খুবই থ্রিলড ছিলাম চরিত্রটি নিয়ে। ভয়েও ছিলাম, এ চরিত্রকে কীভাবে টেনে নিয়ে যাব; এর যে মনস্তত্ত্ব, সেটাকে কীভাবে আনব, সেটা ভেবে। অসাধারণ একটি চরিত্র। অনেক স্তর এ চরিত্রে। আমরা সবাই কিন্তু তাই-ই। এখন আমি যেভাবে কথা বলছি, এই একই মানুষ যখন আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব, সেটা কিন্তু একটু অন্যভাবে বলব। আবার মায়ের সঙ্গে আরেকভাবে, বাচ্চার সঙ্গে আরেকভাবে। সুতরাং মানুষ কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে অনেক স্তরে অ্যাকটিং করে। সেটা তো আছেই। সব মিলিয়ে এটা দুরূহ একটা চরিত্র ছিল।

প্রশ্ন: চরিত্রটি কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

মোশাররফ করিম: পুরোটাই তো চ্যালেঞ্জিং। মানসিকভাবে এ চরিত্র ধারণ করাটাই তো ভীষণভাবে চ্যালেঞ্জিং। সব তো বলা যাবে না। সিনেমাটা দেখলে বোঝা যাবে। পুলিশের টর্চার, এটা-সেটা। কখনো মনে হবে, সে সব সত্যি কথা বলে দিচ্ছে। আবার মনে হবে, এর মধ্যে বোধ হয় একটাও সত্যি নেই। আরেকটা বিষয় ছিল-ভাষা। হুব্বার কথা বলার ধরন। সব মিলিয়ে অনেক বিষয় ছিল। 

প্রশ্ন: যেকোনো বায়োপিকে চেহারার মিল আনার চেষ্টা করা হয়। এ নিয়ে কতটা প্রস্তুতি ছিল?

মোশাররফ করিম: আমরা প্রচুর বায়োপিক দেখেছি, সেগুলোতে আমরা কী দেখি? শারীরিক আকার থেকে চরিত্রকে ধরার একধরনের চেষ্টা থাকে। তবে আমার কাছে চরিত্রের মানসিক আকারটি ধরতে পারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। যেমন আমি হয়তো শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কিংবা জীবনানন্দ দাশের চরিত্রে অভিনয় করে ফেললাম। তার জন্য আমার জীবনানন্দ দাশের চেহারা হতে হবে, তা নয়। আমার কাছে মনে হয়, চরিত্রের মনস্তত্ত্বটা যদি ধরতে পারা যায়, শারীরিক আকারের চেয়ে সেটা বেশি জরুরি। কারণ, যখন আমি একটা টিপিক্যাল আকারকে ফলো করব, তার মাত্রাটা আর অসীম থাকবে না।

প্রশ্ন: হুব্বা সিনেমায় শুটিংয়ের কোন মুহূর্তটি আপনার কাছে বেশি ভালো লেগেছে?

মোশাররফ করিম: একদিন ব্রাত্যদা (ব্রাত্য বসু) বললেন, আপনি আমাকে ছয়খানা ইমপ্রোভাইজেশন দিয়েছেন। ছয়টাই আমার কাজে লাগবে। আমি খুব ইন্সপায়ার্ড হলাম। ওটা একটা আনন্দের মুহূর্ত ছিল আমার জন্য। আর বিশেষ করে চরিত্রটি যখন পুলিশের সামনে কথা বলে, পুলিশ যখন তাকে ধরে নিয়ে যায়, তখনকার হুব্বার যে অভিনয়ের জায়গাটা, সেটা হুব্বার মূল চরিত্র থেকে বেরিয়ে অন্য রকম অভিনয় ছিল। এই অংশটা পারসোনালি আমার খুব ভালো লেগেছে। 

প্রশ্ন: ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় দুটি সিনেমায় অভিনয় করলেন (ডিকশনারি ও হুব্বা)। আপনাদের শুরুর গল্পটা কেমন ছিল? 

মোশাররফ করিম: প্রথম কাজটা যখন ব্রাত্যদার সঙ্গে করতে যাই, খুবই অবাক হয়েছিলাম, তিনি কেন আমাকে নিয়ে কাজ করতে চান! উনি সব দিক থেকেই ভীষণ বড় একজন মানুষ। চমৎকার লেখেন, চমৎকার অভিনয় করেন, চমৎকার নির্দেশনা দেন, রাজনীতিরও মানুষ। তো উনি চলে এলেন বাংলাদেশে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ওই যে উনার চলে আসা, এবং আমার অভিনয়ের প্রতি ভীষণ ভালোলাগাটা উনি প্রকাশ করলেন, তাতেই মনে হলো, আমি কাজটা করব। প্রথম যখন কাজ করতে যাই, তখন আমি একটু গুটিয়েই ছিলাম। কারণ, এর আগে কখনো এক কাপ চা-ও একসঙ্গে খাওয়া হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট শটটা দেওয়ার পরেই জট খুলে গেল। আমি উনাকে বুঝতে পারলাম। উনিও আমাকে ভীষণভাবে বুঝতে পারলেন। 

প্রশ্ন: নেতিবাচক চরিত্ররা ইদানিং নায়ক হয়ে পর্দায় আসছে। এতে সমাজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হতে পারে কি না? 

মোশাররফ করিম: হলিউডে তো এটা আরও আগে থেকেই হচ্ছে। আমিও সেটার স্বপ্ন সব সময়ই দেখতাম। এই যে হিরো, ভিলেন, কমেডি...অমুক তমুক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া তৈরি হয়ে আছে। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, শব্দটি শুধুই অভিনেতা। না হলে একজন অভিনেতার তৃপ্তি কোথায়? আমি কমেডিও করতে চাই, ট্র্যাজেডিও করতে চাই। নেগেটিভ রোল করতে চাই। পজিটিভ রোল করতে চাই। আমি সব চেটেপুটে খেতে চাই। আর সমাজে নেতিবাচক প্রভাব আসলে হয় না। এখন মানুষ নেটের কল্যাণে এত কাজ দেখে যে, মানুষ জানে এটা অভিনয়। অভিনয় জেনেই সে ওই চরিত্র বা গল্পের প্রেমে পড়ে। এটা বরং অভিনেতার জন্য দারুণ একটা ব্যাপার, যখন সে আগের ইমেজকে ভেঙে আরেক ইমেজ দর্শকের মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। 

প্রশ্ন: বিশ্বজুড়ে এখন ওটিটির রমরমা। ওয়েব কনটেন্টও সেন্সরশিপের আওতায় আনার দাবি তোলেন অনেকে। আপনার কী মত? 

মোশাররফ করিম: প্রশ্নটার উত্তর আসলে আমি জানি না। সেন্সর থাকলে কী হবে? মুক্তমনা মানুষদের গলাটিপে ধরা হবে। আমি আমার মতো করে বলতে পারব না। আবার সেন্সর না থাকলে স্বাধীনতার যাচ্ছেতাই ব্যবহার হবে। স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসবে। আসলে আমি এটার উত্তর একটু অন্যভাবে দিই। সায়েন্সকে আমরা একটা সূত্র দিয়ে নিরূপণ করে ফেলতে পারি-সঠিক কিংবা ভুল। কমার্সের ক্ষেত্রেও তা-ই। আর্টের ক্ষেত্রে এটা মুশকিল। কারণ, এখানে তো কোনো নির্দিষ্ট সূত্র নেই। তাই আর্টের বিচার করাটা মুশকিল। ফলে আর্টিস্ট নিজেই এর বিচারক। আর্টিস্ট বলতে আমি শুধু অভিনেতাকে বোঝাচ্ছি না, আর্টের সঙ্গে যুক্ত সবাই। যেহেতু এটার বিচার করার কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই, তাই শিল্পীকে সৎ হওয়া প্রয়োজন। সে নিজেই ভালো জানে, আমি যে এই কাজটা করলাম, এটার উদ্দেশ্য কী ছিল? কিছু টাকা ঘরে ঢুকুক? নাকি আমি আসলে একটা ফিলোসফিক্যাল জায়গা থেকে কিছু দেখাতে চাই?


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)