এই নির্বাচনেও সংখ্যালঘুরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি


বিশেষ প্রতিনিধি , আপডেট করা হয়েছে : 07-02-2024

এই নির্বাচনেও সংখ্যালঘুরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দাবিদার দল আওয়ামী লীগের একাংশের হাতেই বা ‘স্বতন্ত্র’ নামে হামলার শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও। কিন্তু এবারে ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশগ্রহণ করেনি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কিছুটা হলেও ভেবেছিল যে, বোধ হয় এ নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণ তেমন প্রকট হবে না। যদিও নির্বাচন পূর্ববর্তী দিনগুলোতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, এই নির্বাচনেও বহু স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি।

“নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় আলোচনাপর্বে এসব বক্তব্য উঠে আসে। রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অডিটরিয়ামে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন নাগরিক সমন্বয় সেল আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমন্বয় সেলের আহ্বায়ক সুলতানা কামাল। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন নাগরিক সমন্বয় সেল-এর সমন্বয়কারী ও এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা তার আলোচনা পত্রে বলেন, শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্ত নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের চিত্রের পরিবর্তন এবারও হলো না। বাংলাদেশে যে কোন ধরনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রথম শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষেরা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাংলাদেশের রাজনীতির একটি ক্রান্তিকালে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকেন, বিশেষত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, ধর্মীয় উৎসবের সময়ে একটি মহল সংখ্যালঘুদের সহায় সম্পত্তি লুটপাট ও ভোগ-দখলে নেবার জন্য কিংবা সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার জন্য, বিভিন্ন অজুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম নির্যাতন, অত্যাচর, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ অনেক মানবতাবিরোধী ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। সংবিধান অনুযায়ী এখনো বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসামপ্রদায়িক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য রক্ষায় সরকার এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বদ্ধপরিকর। এরপরেও ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব সময়ই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা একটি নিয়মিত অপরাজনীতির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনা বারংবার ঘটার পেছনে কোন না কোন রাজনৈতিক শক্তির সরাসরি ইন্ধন থাকে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতার বদলে এক ধরনের রহস্যময় উদাসীনতা এতে বড় ভূমিকা রাখে। তাই নির্দ্বিধায় বলাই যায়, বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘বাংলাদেশের জনাগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করার যে কথা বলা হয়েছিল এদের কাছে তার কোন মূল্যই দৃশ্যমান নয়। দেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও অদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তাটুকু রাষ্ট্র এখনো দিতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, অভিযোগ রয়েছে অনেক এলকায় আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টির কোন কোন প্রার্থী বা তার কর্মীরা সরাসরি হিন্দু সম্প্রদায়কে হুমকি দিয়েছেন, ভোট কেন্দ্রে না যাবার জন্য। পরে বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে, লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু পরিবার বাড়ী ঘর ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। 

মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমন্বয় সেলের আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, বৈরিতা ও সহিংসতা প্রতিরোধে নতুন প্রজন্ম এগিয়ে না আসলে আমরা কোনো আশার আলো দেখি না। তবে এর পাশাপাশি আমাদের ভেবে দেখতে হবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কী ধরনের বোধ ও দিক নির্দেশনা সঞ্চালিত হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নির্বাচন এলেই হামলা নির্যাতনের শঙ্কার মধ্যে থাকে, হামলা যদি নাও হয় প্রতিনিয়ত এই শঙ্কার মধ্যে থাকাটাই মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটার দায়বদ্ধতা ক্ষমতাসীনরা কতখানি উপলব্ধি করছে এবং তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটি তাদেরই প্রমাণ করতে হবে।

হামলা-নির্যাতনের মাধ্যমে দেশে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাশূন্যে পরিণত করার প্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সংখ্যালঘু নারীদের ওপর হামলা নির্যাতন এই চার ধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এর ফলে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের চিন্তা প্রবলভাবে মার খাচ্ছে, মনোলিথিক রাষ্ট্র অর্থাৎ কেবল বাঙ্গালী মুসলমানদের রাষ্ট্রের চিন্তা-চেতনার কাছে। এভাবে যখন দেশে মুসলমান ছাড়া আর কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু থাকবেনা, তখন শুরু হবে কে সালাফি আর কে হানাফি এটা নিয়ে হানাহানি।

রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেক্টিভ (আরডিসি)-র চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও সংখ্যালঘুদের আক্রমণের ঘটনা ঘটেই চলেছে, এরপরও কি বলা যাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনাকে আওয়ামী লীগ ধারণ করে? তিনি প্রত্যেকটি আক্রমণের ঘটনা তদন্তে রাষ্ট্রীয় তদন্তের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দলীয় তদন্ত পরিচালনার আহ্বান জানান।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. জেড আই খান পান্না বলেন, রাজনীতির চাইতে সম্পদ দখল করার জন্য মূলত সংখ্যালঘুদের বিশেষত যারা দুর্বল অবস্থানে আছে তাদের ওপর হামলা চলছে আর আমরা মনে হচ্ছে তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে জাতীয় সঙ্গীত চলবে না- এমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করলেও কারো বিরুদ্ধে আইসিটি, ডিজিটাল সিকিউরিটি কিংবা সাইবার সিকিউরিটি আইনে মামলা হয় না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম. এম আকাশ বলেন, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো একটি দল যখন ধর্মকে ব্যবহার করে তখন সেটি খুবই হতাশার। উইনার টেক অল অর্থাৎ বিজয়ীরাই সব কিছু পাবে এই মেজরিটেরিয়ান বা সংখ্যাগুরু তাত্ত্বিক না হয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা হতে হবে সংখ্যানুপাতিক হারে।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মণিন্দ্র কুমার নাথ বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে এসেও আমাদের এই আলোচনা এটিই বোঝায় যে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতার যে শঙ্কার কথা আমরা বলেছিলাম সেটি অমূলক ছিল না। 

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তবারক হোসেইন বলেন, সারাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হলেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। এই বিষবাষ্প রোধে দেশের শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, অনেকে বলেছেন নির্বাচনকে ‘তামাশার নির্বাচন’ বলে অভিহিত করা হলেও যে নির্বাচন সংখ্যালঘুসহ দুর্বল অবস্থানে থাকা মানুষের রক্ত ঝড়ায় সেটি আর তামাশার নির্বাচন থাকে না। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন সবসময়ই চলতে থাকে তবে নির্বাচন সেটিকে সুবিধা দেয়।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)