আমেরিকায় নজরদারি মামলা : মুসলমানদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 27-03-2024

আমেরিকায় নজরদারি মামলা : মুসলমানদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়

ইউএস সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সর্বসম্মতি (৯-০ ভোট) সিদ্ধান্তে এফবিআই ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন নাগরিক ইয়োনাস ফিকরের দায়ের করা মামলাটিকে গত ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ওরেগন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টকে পুনরায় চালু করে শুনানি করার নির্দেশ দেয়। আমেরিকান মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের ওয়াচলিস্ট মামলার এই সিদ্ধান্ত একটি বড় বিজয় এবং ঐতিহাসিক। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বলছে এফবিআই পোর্টল্যান্ডের মুসলিম আমেরিকান নাগরিক ইয়োনাস ফিকরের নাম, তাদের নো ফ্লাই লিস্ট তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরও ইয়োনাস ফিকর বলেছেন, এটা অসাংবিধানিকভাবে করা হয়েছে। যে কারণে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। মামলা চলাকালীন সময় সরকার ইয়োনাস ফিকরেকে নো ফ্লাই লিস্ট তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং তার ভিত্তিতে তার মামলাটি খারিজ করতে আদালতে আবেদন করে এফবিআই। ওরেগনের জেলা আদালত দুইবার মামলাটিকে মীমাংসা হিসেবে খারিজ করে দেয়। কিন্তু উভয় বারই নবম সার্কিট কোর্ট অফ আপিল খারিজ করা রায়গুলোকে উল্টে দেয়। এফবিআই ও মার্কিন সরকার সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। ইয়োনাস ফিকর অভিযোগ করেন যে তাকে ভুলভাবে নো ফ্লাই তালিকায় রাখা হয়েছিল। তালিকায় রাখার সময় সরকার ন্যায্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। সে কারণে তিনি অনির্দিষ্টকালের ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। 

উচ্চ আদালত রায়ে বলেন, যদিও এফবিআই-ফেডারেল কর্তৃপক্ষ আদালতে জোর দিয়ে বলছে ফিকরের অতীতের আচরণ পর্যালোচনা করে তাকে আর তালিকায় রাখা হবে না। তবে ভবিষ্যতে তিনি একই আচরণে জড়িত হলে সরকার তখন বিবেচনা করবে। কি কারণে অথবা কোন ডিপার্টমেন্ট ইয়োনাস ফিকরকে নো-ফ্লাই তালিকায় যুক্ত করে ফেডারেল সরকার তা আদালতে প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আদালতে সরকারের দেওয়া যুক্তি পরিপক্ব নয় বলে রায়ে উল্লেখ করেন।

নাইন-ইলেভেনের হামলার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ প্রশাসন একটি ফেডারেল সন্ত্রাসী নজরদারি তালিকা তৈরি করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই লিস্টটি সন্ত্রাসবাদী স্ক্রিনিং, ডাটাসেট বা ‘টিএসডিএস’ নামে পরিচিত। যার মধ্যে বেশির ভাগই মুসলিম আমেরিকানদের নাম অন্তর্ভুক্ত। মূলত এই ওয়াচলিস্ট ব্যবহার করা হয় মুসলমালদের অপমান হয়রানির ও নির্যাতন করার জন্য। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আল-কায়েদা সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে এই ওয়াচলিস্টটি ২৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান রয়েছে। যার ফলে অহেতুক হয়রানির শিকার আমেরিকার অনেক মুসলমান। এই লিস্টের ওপর ভিত্তি করে আমেরিকাসহ অনেক দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা নিয়মিতভাবে মুসলমানদের নজরদারি করছে। ওয়াচলিস্টটে প্রায় দেড় মিলিয়নেরও বেশি লোক রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই মুসলিম। যদিও এফবিআই বলেছে, কাউকে তাদের জাতি, গোষ্ঠী বা ধর্মের কারণে ওয়াচলিস্টে যুক্ত করা হয়নি। কেয়ারের আইনজীবীর দাবি এই তালিকায় থাকা প্রায় ৯৮ ভাগ লোক মুসলিম। প্রায় দুই দশক ধরে, মার্কিন সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে নো ফ্লাই লিস্ট পরিচালনা করছে। নো ফ্লাই লিস্টটি অনির্দিষ্টকালের জন্য মার্কিন নাগরিক এবং বাসিন্দাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্য দেশে ফ্লাই করতে বাধা দেয়। ভুলভাবে তালিকায় রাখা ব্যক্তিদের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সন্দেহভাজন হিসেবে কলঙ্কিত করা হয়েছে। তাদের নাম মুছে ফেলার জন্য একটি ন্যায্য প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে অস্বীকার করা হয়।

২০১৪ সালে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের ক্লায়েন্টদের দ্বারা দায়ের করা একটি মামলায় ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট আদালত বলেছে, নো ফ্লাই লিস্টে স্থান নির্ধারণকে চ্যালেঞ্জ করার প্রশাসনিক প্রক্রিয়া। যদিও ফিকরেকে নো ফ্লাই তালিকায় স্থান দেওয়ার জন্য কোনো কারণ দেওয়া হয়নি। মামলা দায়ের করার পর সরকার ফিকরেকে তালিকা থেকে সরিয়ে দেয় এবং পরে তাকে জানায় যে, বর্তমানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে তাকে নো ফ্লাই তালিকায় রাখা হবে না।

আদালতের ফাইলিং অনুসারে ফিকরে অভিযোগ করেন, তিনি পূর্ব আফ্রিকায় একটি ইলেকট্রনিক্স ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ২০০৯ সালের শেষের দিকে সুদানে গিয়েছিলেন। সুদানে থাকাকালীন এফবিআই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, ফিকরেকে বলেছিল যে সে নো ফ্লাই লিস্টে আছে এবং যদি সে এফবিআইয়ের তথ্যদাতা হয়, তবে তাকে নো ফ্লাই লিস্ট থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। ফিকরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন এবং সুদান থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যান। তিনি দাবি করেন যে, এফবিআইয়ের অনুরোধে সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোপন পুলিশ তাকে করয়ক মাস ধরে অপহরণ ও নির্যাতন করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ত্যাগ করার পর ফিকরে সুইডেনে চলে যান। সুইডেনে তিনি আশ্রয় চেয়ে মামলা দায়ের করেন। অশ্রয় প্রত্যাখ্যান করার পর সুইডেন ফিকরেকে একটি ব্যক্তিগত জেটে পোর্টল্যান্ড, অরিগানে ফেরত পাঠায়।

কেয়ার ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর নিহাদ আওয়াদ সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের প্রশংসা করে বলেন, সুপ্রিম কোর্টে মুসলমানরা আজ একটি বড় বিজয় অর্জন করেছে। এই রায় আমেরিকান মুসলমানদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক, যার মধ্যে আমাদের সরকারের দ্বারা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। আমরা যতক্ষণ না এফবিআইয়ের গোপন নজরদারি তালিকাগুলো আর আমাদের লক্ষ্যবস্তু না করে এবং সংবিধানকে ক্ষুণ্ণ না করে ততক্ষণ আমাদের লড়াই চলবে-এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি। আমরা এই কৃতিত্বের জন্য আমাদের আইনি দলকে অভিনন্দন জানাই এবং আমাদের সমর্থকদের তাদের অধিকার রক্ষার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

কেয়ার ন্যাশনাল লিটিগেশন ডিরেক্টর লেনা মাসরি বলেন, আদালতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো ফেডারেল আদালতে নজরদারি তালিকা চ্যালেঞ্জ করে নির্দোষ মুসলমানদের অপসারণ করে জবাবদিহি এড়ানোর এফবিআইয়ের দীর্ঘকালের অনুশীলনের একটি কঠোর তিরস্কার।

কেয়ার ন্যাশনাল ডেপুটি লিটিগেশন ডিরেক্টর যিনি সুপ্রিম কোর্টে ইয়োনাস ফিকরের পক্ষে মামলার যুক্তি দিয়ে অ্যাটর্নি গাদির আব্বাস বলেন, এফবিআই মুসলমানদের অধিকার নিয়ে খেলতে পারে না। এফবিআই নিরপরাধ মুসলমানদের বিনা কারণে নো ফ্লাই লিস্টে রাখতে পারে না। রায় অনুসারে শুধু মুসলমানদের জন্য করা সেই অসাংবিধানিক তালিকাটিকে ব্লক করতে হবে। তালিকায় কেন মুসলমানদের রাখা হয়েছে তার সম্পূর্ণ যুক্তি সরকার প্রকাশ করে না। ফিকরের মতো মামলাগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলে সরকারকে মাঝেমধ্যে ক্লাসিফাইড ব্যাখ্যা প্রকাশ করতে বাধ্য করবে। যখন একজন মুসলিম নাগরিক সেই অসাংবিধানিক তালিকাটিকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করে তখনই এফবিআই সেই মুসলিমদের তালিকা থেকে অপসারণ করে। এফবিআই দুই যুগের বেশি সময় ধরে মুসলমানদের এভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করছে। এই রায়ের ফলে মামলার স্থায়ী সমাধান হবে। অ্যাটর্নি আব্বাস বলেন, মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। ফিকরেকে অসাংবিধানিকভাবে নো ফ্লাই লিস্টে রাখা হয়েছিল এবং চার বছর ধরে বিদেশে আটকে রাখা হয়েছিল। আজকের জয়টি স্পষ্ট করে যে সরকার তার জাতীয় নিরাপত্তা নীতির অজুহাতে বাছাই করে মামলা তুলে নিয়ে পর্যালোচনা এড়াতে পারে না। তিনি সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।

কেয়ার সিনিয়র লিটিগেশন অ্যাটর্নি জাস্টিন স্যাডোস্কি বলেন, নো ফ্লাই লিস্ট প্রোগ্রামটি এক্সিকিউটিভ শাখার বিচক্ষণতা এবং গোপনীয়তার একটি কালো অধ্যায়। তিনি মামলাটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। যদি সরকার ইয়োনাসের সঙ্গে যা করেছে তা অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে করে যাচ্ছে, আমরা নিশ্চিত করবো যে, আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা বেআইনি। আমরা আদালতের আদেশ অমান্য করার জন্য এফবিআইকে আদালতে নিয়ে যাবো।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)