‘বিজি ফর নাথিং’ বলতে যা বোঝায়, আমার অবস্থা অনেকটা সে রকম। অবস্থাটি এমন একটা রূপে ঘটতে থাকে যে, বিষয়টি ব্যখ্যা করেও সন্তোষজনক কোনো উত্তরে রূপায়ণ হয়ে ওঠে না। আমার এ সপ্তাহের কলামটি পত্রিকা অফিসে রোববারেই পাঠানোর কথা ছিলো। কিন্তু সেদিনটিও আমি ছিলাম বিজি ফর নাথিং। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। যার কারণে কলাম লেখা হয়ে ওঠেনি। আজকের দিনটিও শেষ হয়ে গেলো। রাত এখন বারোটা আট মিনিট, নতুন দিবসের আট মিনিট চলে গেলো। কলামের প্রয়োজনীয় লেখা পাঠানো থাক দূরের কথা, লেখাই এখনো হয়ে ওঠেনি। এভাবে কি মানসম্মান রা করা যাবে! অনেকেই তিরস্কার করে বলে, করো কি, চাকরি-বাকরি করোনা, টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়াও, এরপরও এমন একটা ভাব করো যে, মনে হয় তুমি বিশ্বকে উদ্ধার করছো! কেমন আয়-রোজগার হয় মাসে! ও বলতে চাও না। খুব কাছের মানুষ যারা পকেটের খবর রাখে তারা তো সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, আমি বিজি ফর নাথিং। আচ্ছা ঠিক আছে, প্রিয় পাঠক, আজকের ব্যস্ততার নমুনাটি আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরে অবস্থাটিকে বিশেষায়িত করার স্বাধীনতা আপনাদের হাতেই তুলে দেবো। দেখি, আপনারা কি বলেন?
বিগত দিনটির ব্যস্ততা তুলে ধরতে হলে এর একটা পটভ‚মি তুলে ধরা দরকার। আমার বেটার হাফ-এর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে আগামী মাসে। এটি রিনিউ করার জন্য আমাদের ছোট ছেলে কাগজপত্র, ফির ব্যাংক চেক প্রভৃতি প্রস্তুত করে রেখেছিলো, বাংলাদেশ কনসুলেট অফিসে যাবার জন্য। এরই মধ্যে পহেলা বৈশাখে আয়োজিত কনসুলেটের অনুষ্ঠানে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। সেখানে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লেতে দেখলাম, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এখন আর ইস্যু বা রিনিউ হবে না, ই-পাসপোর্ট নিতে হবে। বাসায় এসে ছেলেকে বিষয়টা খুলে বললাম। সে বললো, তাহলে তো সব কাগজপত্র পরিবর্তন করতে হবে। রাতজাগা কাজের পর দিনে না ঘুমিয়ে এ জাতীয় কাজগুলো করা ওর জন্য খুবই কষ্টকর হয়। ভাগ্য ভালো, আমার পাসপোর্ট রিনিউ করার কাজটি অনলাইনেই হয়ে গিয়েছিলো। এবার ওনার পাসপোর্টের জন্য সশরীরে যেতেই হলো। ছেলেই তার মাকে নিয়ে রওয়ানা দিচ্ছিলো, আমি সাথে জুড়ে গেলাম। ভাবলাম, যদি আমাকে লাগে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলাম, মানুষ আর মানুষ, অনেক মানুষ, সবারই পাসপোর্ট-বিষয়ক বিভিন্ন কাজ। দীর্ঘসময় লেগে যাচ্ছে বলে একসময় আমার জীবন সঙ্গিনী বললেন, তুমি না এসে ঘুমুতে পারতে। ছেলে আর তার মা যখন বাংলাদেশের নিউইয়র্ক কনসুলেটে ঢুকছিলো তখন আমি কিছুণ বাইরে দাঁড়ানো ছিলাম। এসময়ই টাইম টিভি থেকে ফোন এলো একটা অনুষ্ঠানের রেকর্ডিংয়ে যোগ দেয়ার জন্য। সময় দেয়া হলো, বিকেল চারটা। ভেতরে ঢোকার পর আরেকটা ফোনকল পেলাম এই মর্মে যে, একটা সরাসরি সংবাদ-বিশ্লেষণ অনুষ্ঠানে থাকতে হবে ঠিক ছয়টা থেকে। কনসুলেট থেকে যখন বেরোলাম তখন সময় হয়ে গেলো দুপুর দুইটারও বেশি, গিয়েছিলাম সকাল দশটারও আগে। ওখান থেকে বেরোনোর পর ছেলেকে বললাম বাসায় ফেরার পথে আমাকে জ্যাকসন হাইট নামিয়ে দিতে। টিভির প্রোগ্রামের তখনো দু’ঘণ্টা বাকি। জ্যাকসনে যখন নামলাম তখন প্রায় পৌনে তিনটা।
জ্যাকসন হাইটে নামিয়ে দেয়ার সময় ছেলে বলে দিয়েছে, আমি যেন আগে কোনো হোটেলে বসে অবশ্যই ভাত খেয়ে নিই। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। প্রথম যেখানে ঢুকলাম সেখানে মেহমানদারি হলো গভীর আন্তরিকতার আধাকাপ চা দিয়ে আর এদিকে ঘড়ি তখন তিনটা পেরিয়ে। এ সময় মনে হলো, কনসুলার অফিসের ওদিক থেকে এদিকে আসাটা ঠিক হয়নি। এই জটিল সময়ে ভাত খেতে যে সময় লাগবে তা মঞ্জুর করলে সময় হাতে রেখে টিভি স্টেশনে যাওয়া যাবে না। তাই আবার সাবওয়েতে ঢুকলাম, কনসুলার অফিস এলাকার কাছাকাছি স্থানেই অবস্থিত টিভি অফিসটি। ওখানে গিয়ে দেখি, মেইন গেটে তালা, ফোন করে জানলাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট সবাই এসে যাবেন। আপনারা জানেন, এগুলো অনেক ধৈর্য এবং প্রজ্ঞার বিষয়। টিভি সম্পর্কিত কাজ দুটো সেরে আবার জ্যাকসন হাইট আসতে আসতে সাতটার বেশি বাজলো। তখন ভাবলাম, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া আরো বেশি সময় থাকলে সুগার ডাউন হয়ে বিপদ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ইত্যাদি রেস্টুরেন্ট থেকে কিনলাম এক টুকরা মুরগি ফ্রাই, একটা নারকেলের পিঠা এবং একটা স্প্লেন্ডা চা। ডাইভারসিটি প্লাজায় বসে এগুলো খেলাম। জি, কী বললেন? এভাবে হোমলেস স্টাইলে কেন খেলাম? স্যরি, প্রিয় পাঠক, এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকতে চাই, মাফ করবেন। এর মধ্যেই ডাইভারসিটি প্লাজায় প্রাণবন্ত কয়েকজন মানুষ এলেন। ওরা হলেন- শিব্বির, মিনহাজ, নিহার, সহিদ প্রমুখ.. এনারা এভাবে ওভাবে কোনো না কোনোভাবে সবাই মিডিয়ারই লোক, বেশ সময় জমিয়ে রাখলেন ডাইভারসিটি প্লাজায় অবস্থানের সময়টি। সেখানে অনেকণ থেকে সবাই গেলাম সাকিল সাহেবের গ্রাফিক্স ওয়ার্ল্ডে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আমি গেলাম ড্রিম লাইটার অফিসে। সেখানে কিছু প্রয়োজনীয় কথাবার্তার পর ট্রেনে চেপে বাসায় এসে এই লেখাটি প্রস্তুত করতে করতে রাত এখন বারোটা ঊনষাট মিনিট। এই যে দেখুন, বলতে বলতেই রাত একটা বেজে গেলো। তাহলে সর্বসাকুল্যে মোদ্দাকথা কী দাঁড়ালো? যোগ-বিয়োগ করে সব মিলিয়ে অঙ্কটা যা দাঁড়ালো তার যোগফল হলো, বিজি ফর নাথিং। সীমাহীন ব্যস্ত আমাদের মাইন উদ্দিন সাহেব কিন্তু বৈষয়িক বিষয়াদির মাপকাঠিতে মোটা ডলার বান্ডিলের কাছ থেকে দূরেই পড়ে থাকেন। তাই ওনার জীবনের বেটার হাফ ওনাকে বলেন, বিজি ফর নাথিং। অবশ্য আমরা শুনেছি, এ কথাটি তিনি হাসতে হাসতে বলেন, মলিন মুখে নয়। একজন কলাম পাঠক অবশ্য একসময় মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, ডলার দিয়ে না মেপে আপনি এসব কর্মকাণ্ডে আনন্দিত থাকেন কিনা সেটাই বড় বিষয়। আরেকজন শুভাকাক্সক্ষী বললেন, ভালো বলেছেন, তবে জীবনযাপনের জন্য ডলার বা টাকাও দরকার। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, রাত এখন একটা বেজে তেইশ মিনিট, আই অ্যাম বিজি ফর নাথিং!