দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়


ঢাকা অফিস , আপডেট করা হয়েছে : 25-03-2022

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়

নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়ে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে এবং দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে সক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে। নতুন কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপের দ্বিতীয় দিনে ৩৯ জন বিশিষ্ট  নাগরিককে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এতে অংশ নিয়েছেন ১৯ জন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার নির্বাচনের ফলাফলের ব্যাপারে নিষ্পৃহ থাকবে। সে নির্বাচনের ফলাফলকে নিজের পক্ষে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না। তিনি বলেন, এমন সরকার যদি না থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের সংবিধান এবং আইনে প্রদত্ত অধিকার কার্যকর করার কোনো সুযোগ নেই। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরাই যেন নির্বাচনে মনোনীত হন, তার জন্য দেশে যেসব আইন আছে তার প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী তা সবার মোটামুটি জানা আছে। আজকে সেই বিষয়গুলোই আমরা পুনঃউল্লেখ করেছি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘু, নারী এবং দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ইভিএমের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। নির্বাচনে দেশি এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারবেন, তেমন পরিবেশ থাকার ওপর জোর দেন তিনি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনের বিষয়ে একটা সুরাহা হওয়া উচিত। জামায়াতের বিষয়টা ফেলে রাখা ঠিক হবে না। দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের আইনটা একটু কঠিন হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাকি আছে। গণসংহতি আন্দোলনের নিবন্ধন হয়নি, হাইকোর্টেরও রায় হয়েছে। আমাদের আবেদন থাকবে আপনারা দ্রুত ছেড়ে দেন। রাজনীতিতে সৎ লোককে আনতে হবে। অনেক বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার মতে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পথে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। উনি নির্বাচন করতে পারবেন। কেননা, উনার মামলার ফয়সালা এখনো হয়নি। আমি সব সময় বলেছি জামিন পাওয়া উনার অধিকার। ৬ মাসের এই খেলা দেখানো ঠিক নয়।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার একটি কথা বলেছিলেন, আমিও ইভিএম বুঝি না। পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে। একটা কাগজ তৈরি করা দরকার, কীভাবে ইভিএম এলো? বিনা টেন্ডারে এতো ইভিএম কেনা হয়েছিল কারণটা কী? এ সম্পর্কে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা প্রয়োজন। ইভিএম যদি ব্যবহার করতেও হয়, ৫-১০টা সেন্টারে হতে পারে। খুব সিরিয়াসলি আমরা দেখতে পারি, তবে এটা না হওয়াটাই ভালো।

এ সময় নির্বাচনে ভোটার লিস্ট সময় নিয়ে প্রকাশ এবং সব প্রার্থীদের নিয়ে অন্তত ৫টি জেলায় মিটিং করার প্রস্তাব দেন তিনি। দেশে খাদ্যদ্রব্যের যে অবস্থা যাচ্ছে, সুষ্ঠু গণতন্ত্রই এর মূল চিকিৎসা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন জানান, ভোটের আগে-পরে ৬ মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিত। ২০২৩ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর থেকে একাদশ সংসদের অধিবেশন থাকবে না। এ জন্য ভোটের আগে চার মাস, ভোটের পরে দুই মাস- এই ৬ মাসের জন্য ক্ষমতা ইসির হাতে থাকতে পারে। আস্থা অর্জন করতে পারলে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা সম্ভব।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। ক্ষমতায় থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গত দু’টি নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও আস্থা অর্জনে অন্যতম পরিমাপক হবে কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সরকারি আনুগত্য ও প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে তার অবস্থান ও কর্মকান্ডে নিজেকে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কতটুকু প্রমাণ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে, সরকারি আনুগত্যমূলক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান পরিহার করে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের চর্চা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কমিশনের দায়িত্ব পালনে যে আইন ও বিধিমালা রয়েছে, তা পর্যাপ্ত কি-না, তা বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের প্রস্তাব করুন। এ ক্ষেত্রে, এমন প্রস্তাব বিবেচিত হতে পারে যেন নির্বাচনকালীন সরকার, জনপ্রতিনিধি হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকে নির্বাচন করা, এ ধরনের বিতর্কিত বিষয়ে সমঝোতা অর্জন সম্ভব হয়। নির্বাচন কমিশন এককভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে না। নির্বাচনকালীন সরকার, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেহেতু আইনগতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ সকল প্রতিষ্ঠান নির্বাচনকালে সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত, সেজন্য কমিশনকেই সৎসাহসের সঙ্গে যথাযথভাবে তাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আগ্রহী সকল দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে অবাধে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্য সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে ব্যাপকবিতর্কিত নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছি-এরূপ অবাস্তব দাবি করা ও বিব্রতকর অস্বীকারের চর্চা পরিহার করতে হবে। নিজেকে আয়নার মুখোমুখি করে, ব্যর্থতার ক্ষেত্রে দায় স্বীকারের সৎসাহসের পরিচয় দিতে হবে।

লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ বলেন, ইসি এত সংলাপ করার মানে হচ্ছে এখানে সংকট রয়েছে। আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ।

এদিকে বিশিষ্ট নাগরিকদের আলাপের প্রসঙ্গ টেনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, কেউ কেউ বলেছেন নির্বাচন যদি ৫০ শতাংশ বা ৬০ শতাংশ গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে এটাও একটা বড় সফলতা।

দেশের নির্বাচন নিয়ে বিবর্তনটা ইতিবাচক হয়নি জানিয়ে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, সহিংসতা ব্যাপকতা লাভ করে। এটা হলে পরে ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ভোট দিতে পারে না। আপনারাও বলেছেন, সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি বলেন, এটা সত্য কথা আমাদের সাহস থাকতে হবে। সাহসের পেছনে থাকতে হবে সততা। আমাদের হারানোর কিছু নেই। পাওয়ার কিছু নেই। জীবনের শেষ প্রান্তে আমরা ইতিবাচক যদি কিছু করতে পারি, আপনাদের সাজেশনের আলোকে নির্বাচনটা যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায় সবার অংশগ্রহণে, সেটা একটা সফলতা হতে পারে।

বিগত নির্বাচনে বেশকিছু কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কেউ বলছে ভোট দিচ্ছে না। তবে নারায়ণগঞ্জের ইলেকশন খুব সুন্দর হয়েছে। ইভিএমের মাধ্যমে এটা একটা বড়দিক বলে মনে করেন তিনি।

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের বিপক্ষে অনেকেই। তিনি বলেন, এটার মধ্যে কোনো অসুবিধা আছে কিনা, এটা ব্যবহারে অনেকেই অভ্যস্ত নয়। মেশিনের মাধ্যমে কোনো ডিজিটাল কারচুপি হয় কি-না, পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম বাতিল করে দিয়েছে, কেন করলো সেটা গবেষণা করা উচিত। ইভিএমে রিকাউন্টিং প্রবলেম আছে জানিয়ে তিনি বলেন, যদি কোনোরকম কারচুপি হয়ে থাকে, তাহলে রিকাউন্টিং করা যাবে কি-না, এটার কোনো ব্যবস্থা আছে কি-না, এটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের টেকনিক্যাল কমিটির মিটিং করে একটা ধারণা নিতে হবে। নির্বাচনে যাতে ধর্মের ব্যবহার না হয়, সেটাও আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখবো। ভোটের আগে এবং ভোটের পরে ভোটারদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ভোটার সেন্টারে যেতে পারবে কিনা? ভোটার তার সেন্টার থেকে বের হয়ে নিরাপদ কিনা? ওসি-ডিসিদের মাধ্যমে ওই জায়গাটা দেখতে পারলে ভালো হয়।

নির্বাচন কমিশনের বিধিবিধানের অভাব নেই। কিন্তু এনফোর্সমেন্টের ঘাটতি আছে। বাস্তবে ঘাটতি আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এনফোর্সমেন্ট ক্যাপাসিটিটা আরও বর্ধিত করতে পারি কিনা?

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, এটা একটা কষ্টসাধ্য কাজ। আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা চেষ্টা করবো।



প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)