পদ্মা সেতু উম্মুক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা


মাসউদুর রহমান , আপডেট করা হয়েছে : 25-06-2022

পদ্মা সেতু উম্মুক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২৫ জুন ২০২২। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। এ সময়টুকু দেশের দক্ষিন ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ আজীবন মনে রাখবে। এদিন বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বরনীয় একদিন। বহুল আকাংখিত পদ্মা সেতুর উদ্ধোধনের দিন। রাজধানী থেকে উক্ত অঞ্চলে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য পদ্মা সেতু উম্মুক্ত করে দেয়ার দিন। আর কোনো বাঁধা থাকলো না। আর কোনো লঘু লঞ্চনা নয়। আর কোনো পদ্মার পাড়ের দুর্ভোগ নয়। পদ্মা পার হতে যত জরুরীই হোক না কেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘কালো মেঘ’ বা ঝড়ের পূর্ভাবাস দেখে থমকে যাওয়া নয়।

চুপ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নদী পাড়ে বসে থাকা নয়। অসুস্থ রোগীকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জন্য চটলদি যাওয়ার যে বাসনা, সেটা বুকে চেপে চুপ করে থেমে যাওয়া নয়। অথবা ঢাকায় মৃত্যুবরন করা লাশ নিয়ে দ্রুত দেশের বাড়ীতে নিয়ে কবরস্থ করার তাড়া থাকলেও পদ্মা পাড়ের বিরম্বণা বা অনুকুল আবহাওয়া না থাকায় চোখ বন্ধ করে আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা নয়। এরকম শত প্রতিকুলতা,বাঁধার দিন শেষ। সারাদিন বা ৩ থেকে ১০-১২ ঘন্টার যে পারাপারের বিরম্ভবনা সেটা শেষ। এখন সেটা ৬-৭ মিনিটেই পার হয়ে যাবে আজীবন কষ্ট ও লঘু-লঞ্চনা পোহানো দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে পদ্মা সেতুর উদ্ধোধন ঘোষনা করেছেন। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত এক সুধী সমাবেশে এ মহেন্দ্রক্ষনের জন্য দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। নিজেদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা পাওয়া পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করাটা বাংলাদেশের জনগনের সাহস ও দৃঢ়তা যে প্রমান পেয়েছে সেটাই তিনি তুলে ধরেন। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সবাইকে তিনি ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের সন্মান ও সক্ষমতার প্রতীক’।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ পদ্মার বুকে জ¦লে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সাথে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজকে আমরা এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পারের যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে শুধু তাই নয়। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক।

তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহসিকতা, সহনশীলতা আর আমাদের প্রত্যয় এবং এই জেদ যে, এই সেতু আমরা তৈরী করবোই। যদিও ষড়যন্ত্রের কারণে এই সেতুর নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্ত আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি। হতাশায় ভূগিনি। আত্ববিশ্বাস  নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সকল অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি।

জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র পুনরুল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি। 

তারুণ্যেও কবি সুকান্তের ভাষায় তিনি বলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

আমরা মাথা নোয়াইনি। আমরা কোনদিন মাথা নোয়াব না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কখনও মাথা নোয়াননি। তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। 



জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তাঁর এবং তাঁর সরকারের পথচলা উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজকে বাংলাদেশ বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। 

এরপর তিনি নিজ থেকে টোল দিয়ে ধীরে ধীরে চলে যান তিনি পদ্মা সেতুর উদ্ধোধন ফলক উম্মোচনের জন্য। যে ফলকে বিশালাকায় দুটি ছবি শোভা পায়। একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন, সেতু ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সহ বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ। এছাড়াও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল উপস্থিত ছিলেন। সুইস টিপে সেতু ফলক উম্মোচিত করার আগে দোয়া মোনাজাত করেন মন্ত্রীপরিষদ সদস্য খন্দকার আনওয়ারুল ইসলাম মিলু। পরে প্রধানমন্ত্রী ধীরে ধীরে পদ্মা সেতু দিয়ে পার হয়ে অপর প্রান্ত অর্থাৎ মাদারীপুর-শরীয়তপুরের কাঠালবাড়ীতে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় বক্তব্য দেন। 

এতে করে বহুল আলোচিত গর্বের ৬.১৫ কিলোমিটারের এ দীর্ঘ পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলো। রাজধানীর সঙ্গে ওই অঞ্চলের অন্তত ২১টি জেলার সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক অগ্রগতি বয়ে নিয়ে আসলো সম্ভাবনার দ্বার। 

এর আগে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর নির্মান কাজে ৩৭ এবং ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর অংশ দৃশ্যমান হয়। পরে একের পর এক ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদী শাসন করেছে চীনের সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন। মোট ৩০, ১৯৩৩.৭ কোটি টাকা ব্যয়ে স্ব-অর্থায়নে সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে।

শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শরীয়তপুর জেলার জাজিরা পয়েন্টে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী নদী প্রশিক্ষণের কাজ এবং পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।  

এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ১৯৯৭ সালে তিনি জাপান সফর করেন। তিনি পদ্মা ও রূপসা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করেন। জাপান সরকার দুটি নদীর ওপর সেতু নির্মাণে সম্মত হয়। যেহেতু পদ্মা নদী একটি শক্তিশালী নদী যার প্রবল স্রোত, জাপান পদ্মা নদী জরিপ শুরু করে এবং তারা তার অনুরোধে রূপসা নদীতে নির্মাণ কাজ শুরু করে। 

জাপান ২০০১ সালে পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের সমীক্ষা প্রতিবেদন বাংলাদেশের কাছে জমা দেয়। জাপানি জরিপে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টকে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। জরিপের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।


পদ্মা সেতু উপলক্ষো পদ্মা পাড়ের কাঠালবাড়ীতে আয়োজিত জনসভায় আগত মানুষের একাংশ/ছবি সংগৃহীত 


তবে একই সঙ্গে সেতু স্থাপিত রেল লাইনের সুচনা করা যায়নি। তবে ২০২৩ সনের ২৫ জুন রেল লাইনেরও উদ্ধোধন হবে বলে ঘোষনা দেয়া হয়েছে। 

পদ্মা বহুমুখী সেতু ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে টোল ঘোষণা করেছে সরকার। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু পার হতে একটি মোটরসাইকেল ১০০ টাকা, একটি গাড়ি ও একটি জীপের টোল ৭৫০ টাকা। এছাড়া টোল চার্ট অনুযায়ী, একটি পিকআপের জন্য ১,২০০ টাকা, একটি মাইক্রোবাসের জন্য ১,৩০০ টাকা, একটি ছোট বাসের জন্য (৩১-সিটের জন্য ১,৪০০ টাকা), একটি মাঝারি আকারের বাসের জন্য ২,০০০ টাকা (৩২ আসনের  বেশি) এবং একটি বড় বাসের জন্য (তিন-অ্যাক্সেল) ২,৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়া ছোট ট্রাকের (৫ টন পর্যন্ত) জন্য ১,৬০০ টাকা, একটি মাঝারি ট্রাকের (৫-৮ টন) জন্য ২,১০০ টাকা এবং ৮-১১ টন ওজনের একটি ট্রাকের জন্য ২,৮০০ টাকা, একটি ট্রাকের (থ্রি-অ্যাক্সেল) জন্য ৫,৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং একটি ট্রেলারের (চার-অ্যাক্সেল) জন্য ৬,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয় যে চার-অ্যাক্সেল ট্রেলারের উপরে প্রতিটি এক্সেলের জন্য ৬,০০০ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ১,০০০ টাকা যোগ করা হবে। 



প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)