২৩ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ৬:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন


ভারতকে এতো ভয় কেন ?
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৭-২০২২
ভারতকে এতো ভয় কেন ?


বাংলাদেশ ভারতের ভয়ে কি ক্রমাগত বেঁকে যাবে, না ভারতের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে? বিষয়টা নিয়ে ক্রমাগত ভাবিয়ে তুলছে যারা দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে ভাবতে চায়। ভারত সাধারণত বাংলাদেশের কোনো কিছু নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে না; কিন্তু যখন আমেরিকার আন্ডার সেক্রেটারি ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স ভিকটোরিয়া ন্যুল্যান্ড তার ভারত-বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা সফরকালে বাংলাদেশের সাথে এক খসড়া ডিফেন্স কো-অপারেশনে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তখন থেকে এক বিস্ময়কর যন্ত্রণায় ভুগছে বাংলাদেশ। গত ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক দেনদরবার করে গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমেরিকার প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন সাহেবের যখন কোনো দেশ ছিল না, তখন আমেরিকা নাকি তাকে থাকতে দিয়েছে। যখন তার কোনো বাড়ি ছিল না, বাড়ি দিয়েছে, যখন তার চাকরি ছিল না, চাকরি দিয়েছেÑ এসব কথা অবলীলায় বলে গেছেন তিনি। কিন্তু এসব বলে যখন ব্লিঙ্কেনকে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা পাড়লেন, তখন ব্লিঙ্কেন বলেন, তা ট্রেজারির বিভাগের বিষয়। অর্থাৎ র‌্যাবের সেসব কর্মকর্তা ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা মেরেছেন আর  বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রেডিট কার্ডের টাকা মারার জন্য র‌্যাবের পক্ষে দালালি করতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে, এ বৈঠকের আগেই গত মার্চ মাসে ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড খসড়া প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। বিষয়টা খসড়া হলেও তা ভারতের জন্য পেট কামড়ির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সে সময় ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সংযোগ রাখতে চান, কোনো দেশের সাথে ভায়া-মিডিয়া নয়। এরপর শুরু হয় আরেক যন্ত্রণা।

ভারত মনে করতে শুরু করলো যে, বাংলাদেশ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এতোদিন ছিল চীনের খপ্পড়ে, এখন তার মধ্যে ভাগ বসাতে শুরু করলো আমেরিকা। আর ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে যে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে তা বলাবাহুল্য। কারণ নরেন্দ্র মোদি কাপড় খুলে প্রায় উলঙ্গ হয়ে ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার করেছিলেন। ট্রাম্পকে আরেকটি টার্ম দেয়ার জন্য তার কণ্ঠস্বর শিকাগোতে ধ্বনিত হয়েছিল। সেদিন যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রাম্পের পক্ষে কিছু বলেননি। তারপরও দেখা গেছে, নরেন্দ্র মোদির পিছু নিতে তিনি ছিলেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্য। এদিকে এক হিন্দু মহিলা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন। ভূগোল সম্পর্কে হতবুদ্ধির ট্রাম্প সে সময় বাংলাদেশকে চিনতেই পারতো না। কিন্তু বাইডেনের ক্ষমতায় আসার পর তার পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা জন কেরি বাংলাদেশ সফর করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে মোমেন সাহেব শেখ হাসিনাকে কি বুঝিয়েছেন তা বিশ্লেষণ না করেও বলা যায়, তিনি একসময় জন কেরির ক্যাম্পেইনে কাজ করতে চেয়ে সুযোগ পাননি আমেরিকায়। দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বলে দাবিদার আনু আনোয়ার, জিওফ্রি ম্যাকডোনাল্ড, ড্যানিয়েল মার্কি ও হুমাইনা সিদ্দিকী সম্প্রতি তাদের এক বিশ্লেষণে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে এবং আমেরিকার সাথে সম্পর্কের কথা তুলে ধরেছেন। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৫০ বছর। কিন্তু এ সম্পর্কে আমেরিকার তেমন কিছু উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ বেশ কথা বলেছেন এ নিয়ে। কিন্তু ড্যানিয়েল মার্কি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক কঠিন পথ ধরে চলছে।

যদিও আমেরিকা চায় বাংলাদেশে পূর্ণ গণতন্ত্র। বাংলাদেশকে আমেরিকা জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মেলনে ডেকেছে। কিন্তু বছরের শেষে র‌্যাবের ওপর আমেরিকার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট অবরোধ দিয়েছে। কারণ দেখিয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অর্থ লুণ্ঠনেরও অভিযোগ রয়েছে র‌্যাবের যেসব কর্মকর্তাকে ধরা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে। কারণ ক্রেডিট কার্ড নিয়ন্ত্রণ করে আমেরিকার ট্রেজারি বিভাগ। এখন কারো কারো ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তারপর বাইডেন প্রশাসন ডেমোক্রেসি শীর্ষক বৈঠকে বাংলাদেশকে ডাকেনি। বেসামাল করে দিয়েছে বাংলাদেশকে আমেরিকা। আমেরিকার বিরুদ্ধে সজিব ওয়াজেদ জয় অনেক কথা বলেছেন। এখন এসে তিনি আমেরিকার ‘কোল থেকে আর বের হচ্ছেন না।’ কিন্তু এসবের সুরাহা করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, তিনি ভারতের ওপর এবং আমেরিকায় ভারতের নাগরিকদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন।

হায়রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবির মতো পররাষ্ট্র নীতি। তবে কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক খেলোয়াড় বলে মনে করে। সে জন্য খসড়া ডিফেন্স কো-অপারেশন চুক্তি সই করেছে মিস ন্যুল্যান্ড। বিষয়টা ঘটমটে, কিন্তু বোঝা যায় বাংলাদেশকে অবরোধ দিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ কাজ হাসিল করেছে। কাজেই চুক্তিটিকে খেলো করে দেখার সুযোগ নেই। 

এর মধ্যে হার্ভডের গবেষক আনু আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরগত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারত সবসময় চেয়েছে, বাংলাদেশের স্থান যেন ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন এসেছে ভারতের বাইরে থেকে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সন্দেহ করা হয়। সম্প্রতি ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পথ বন্ধ করার চিন্তা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে ভারত শ্রমের বাজার চায়, পণ্যের বাজার চায় আর চায় ট্রানজিট সুবিধা কোনো সারচার্জ না দিয়ে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারত কানেকটিভিটির আওতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারে। বিষয়টা বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপা হয়নি। তার চেয়ে ঘটা করে ছাপা হচ্ছে ভারতের পত্রিকায়।

যেন বাংলাদেশ নিজের ‘সুড়ঙ্গপথ ভারতকে লিজ দিয়ে দিয়েছে’। এরপর যখন পদ্মা ব্রিজ ওপেন হলো এখন ভারত উল্লম্ফন করতে লাগলো পদ্মা ব্রিজ দিয়ে বাংলাদেশ কাশ্মির পর্যন্ত যেতে পারবে। এর বলার কারণ হচ্ছে, ১৯১৮ সালের হিসাবে বাংলাদেশিদের সফর থেকে ভারত ২ হাজার কোটি রুপি আয় করে, এখন এ আয় আরো বাড়বে। এদিকে মহেশখালী মাতারবাড়িতে জাপানকে দেয়া হয়েছে ডিপ সি-পোর্ট আর চীনকে কুয়াকাটার কাছে দেয়া হয়েছে পায়রা বন্দর। চীন তা নিয়ে তার উন্নয়নে কাজ করছে আর শেখ হাসিনা মনে করেন, ভারতের মতো করে তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না। তিনি বলেন, উন্নয়নের জন্য ক্ষমতা চাই। গণতন্ত্র রসাতলে যাক, চাই ক্ষমতা। এদিক থেকে ভারত শেখ হাসিনাকে চায়। চীন কিংবা রাশিয়ার জন্য গণতন্ত্র কোনো ফ্যাক্টর নয়, কিন্তু আমেরিকা বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্য গণতন্ত্র ম্যাটার করে। এজন্য গণতন্ত্রের কথা উঠলে হাসিনার হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাবে। তাই তিনি ভারতের সাথে একাট্টা হয়ে থাকতে চায়। আমেরিকা বাংলাদেশের নীতি স্বাতন্ত্র্য করতে চাইলেও বাংলাদেশের বর্তমান শরিক তা চায় না। 

বাংলাদেশ ভারত ও চীনের সাথে উন্নত ভারসাম্যের জন্য আমেরিকার সহায়তা নিতে পারতো; কিক্ত এই তৃতীয়পক্ষ দিয়ে ভারসাম্য গড়ে তুলতে বাংলাদেশ দ্বিধাগ্রস্ত। চীনকে ব্যালান্স করার জন্য পদ্মা সেতুর, কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়েছে চীনকে। পায়রা বন্দর দেয়া হয়েছে চীনকে। পাকিস্তানের পর চীন থেকেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কিনে। যদিও চীন কোয়াডে যোগ না দিতে বাংলাদেশের ওপর খড়গ উঁচা করে রয়েছে। 

অর্থনৈতিক, কারিগরি দিক থেকে বাংলাদেশে ভারত কম্পিট করতে পারবে না চীনের সাথে। সে জন্য ভারত বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এখন বাংলাদেশ ভারতের জন্য চতুর্থ রেমিট্যান্স পাঠানোর দেশ। বাংলাদেশ থেকে ২০১৮ সালের হিসাবে ১৮ লাখ ট্যুরিস্ট যায় ভারতে। বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স আয় করে ভারত ১০.২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে যে সুজন সমাজকে দলিত মথিত করা হচ্ছে, মানুষের শক্তি কেড়ে নেয়া হচ্ছে, সমালোচনাকারীকে বিদ্ধ করা হচ্ছে তা অবর্ণনীয়।

জুমাইনা সিদ্দিকী বলেন, ২০৫০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ লোক নিজস্ব বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হবে। এ জন্য বাংলাদেশ জলবায়ু ফিন্যান্সিংয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্যারিস প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চায়। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র চায় তার পূর্বে গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন যাতে এই দেয় অর্থ কারো পকেটে না যায়। যেমন করে বলা হচ্ছে পদ্মা সেতুর এক বিলিয়ন ডলার তছরুপ হয়েছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা এক টন সিমেন্টের দাম ৯ হাজার ৬৮২ বাংলাদেশি টাকা হলেও তা আনা হয়েছে টনপ্রতি ১৫ হাজার টাকায়। এসব বিষয়ে ফলাও করে ভারতের পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা বয়ান দেয়া হচ্ছে। কাজেই এই মিথ্যা বয়ানের সহায়তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে ছাড়া আর কোথাও থেকে পাবে না। 


শেয়ার করুন