১৫ অক্টোবর ২০১২, মঙ্গলবার, ০৯:৩১:০৭ অপরাহ্ন


“জয় বাংলা” জাতীয় শ্লোগান হতে কেন ৫০ বছর লাগলো?
সামছুদ্দীন আজাদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২২
“জয় বাংলা” জাতীয় শ্লোগান হতে কেন ৫০ বছর লাগলো?


অদ্ভুত জাতি আমরা। আমরা চিন্তা- চেতনা ও ভাবনায় এখনো দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী বাঙ্গালী হতে পারিনি। আমরা দেশ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব’র ভাবনা নিয়ে এত বেশি দুর্বল, এত বেশি দ্বিধাগ্রস্ত- যা সত্যিই দুঃখজনক। পৃথিবীতে নিজ দেশ, স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ সার্বভৌমত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কটাক্ষ করা, ঠাট্টা করার মত আমরাই মনে হয় একমাত্র জাতি, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। জয় বাংলা শ্লোগান আজ বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান হয়েছে। লেগেছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডঃ বশির আহম্মেদের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে এই রায় দেয়া হয়। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি মন্ত্রী সভার বৈঠকে জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ২ মার্চ ২০২২ জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান ঘোষণা করে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। এর আগে ২০২০ সালের ১০ মার্চ জয় বাংলা শ্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য মাননীয় হাই কোর্ট রায় প্রদান করেন। বাংলাদেশে হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক রায় দেন। এতে বলা হয় ১. (ক) জয় বাংলা বালাদেশের জাতীয় শ্লোগান হবে। (খ) সাংবিধানিক পদাধীকারীগণ দেশে ও দেশের বাইরে কর্মরত সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কর্মকর্তা/কর্মচারি সকল জাতীয় দিবস উদযাপন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শেষে জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ করবেন। (গ) সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যাহিক সমাবেশ সমাপ্তির পর এবং সভা- সমাবেশে বক্তব্য শেষে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা জয় বাংলা শ্লোগান উচ্চারণ করবেন। ২. এটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। উল্লেখ্য যে জয় বাংলা হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক শ্লোগান। কোন বক্তৃতা ও বার্তা শেষে দলটির সদস্যরা বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু শব্দটি ব্যাবহার করেন।

আমার বক্তব্য হলো- কেন জয় বাংলা শ্লোগানটি জাতীয় শ্লোগান হতে পঞ্চাশ বছর সময় লাগলো? তাও আবার একজন আইনজীবীর রিট করার পর আদালত রায় দিয়েছে এবং মন্ত্রী পরিষদ এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়েছে। সত্যিই বিষয়টি খুব দুঃখজনক এবং বেদনাদায়কও বটে। মনে হলো দীর্ঘ ৫০ বছর আমরা একটি পরাধীন দেশে বসবাস করছিলাম। আজ থেকে আমরা স্বাধীন হলাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালীরা তাদের প্রাণের শ্লোগান জয় বাংলা উচ্চারণ করতে পারবে।

জয় বাংলার ইতিবৃত্ত

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম এম, এ আজিজের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম লাল দীঘির মাঠে লাখ লাখ জনতার সামনে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ছাত্র লীগের সভাপতি তোফায়েল আহম্মদ ও সাধারণ সম্পাদক আসম রবের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ১১ দফা উপস্থাপন করেন। ৬৯ এ ১১ দফা প্রণয়ন গণঅভ্যুত্থান যা বাঙ্গালী জাতির জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মাইলফলক হিসেবে খ্যাত। সেই ৬৯ এ জয় বাংলা শ্লোগানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারি আয়ুব শাহীর কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানের সংবর্ধনায় যোগ দেন। আর ঐ সমাবেশ জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত ছিল। ছাত্র জনতার পক্ষে তোফায়েল আহম্মদ সর্ব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধীতে ভূষিত করেন। আর সেই সমাবেশে লাখ লাখ জনতার উল্লসিত শ্লোগানে মুখরিত হয় জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু। ১৯৭০ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি রাতে তৈরি করা হয় আমাদের জাতীয় পতাকার প্রথম নকশা এবং নির্বাচন করা হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গানটি।

সবচেয়ে যে বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং কালজয়ী এই শ্লোগান “জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালোরাত্রিতে পশ্চিমা হায়েনারা যখন ঘুমন্ত বাঙ্গালীর উপর বর্বরোচিত হামলা, অপারেশন চার্জ লাইট শুরু করেছিল। সেদিন থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী রুখে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানী বর্বর সৈনিকদের আক্রমণ। বাঙ্গালীর দামাল ছেলেরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে তৎকালনি ভারত রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতায় ১ কোটি বাঙ্গালী সেদিন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস বাঙ্গালী সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ সদস্য এবং সাধারণ নাগরিকরা ভারত সরকারের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানী বর্বর সেনাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শ্লোগান ছিল জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু। এই শ্লোগান দিয়ে প্রর্শিক্ষণ শুরু করা হত আর প্রশিক্ষণ শেষ হতো এই শ্লোগান দিয়ে। এই জয় বাংলা শ্লোগান ছিল বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ। এই শ্লোগান বাঙ্গালীর হৃদয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত প্রজ্বলিত হয়ে উঠতো স্বাধীনতার চেতনা। জয় বাংলা শ্লোগান সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। জয় বাংলা শ্লোগান ছিল মুক্তিকামী বাঙ্গালীর প্রাণের স্পন্দন। আমাদের সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ সদস্যরা রণাঙ্গনে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে প্রশিক্ষণরত সেনাদের  দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করত। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ৯৪ হাজার পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পন করেছিল। সেদিনের গগণ বিদারি শ্লোগান ছিল জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা লন্ডন হিথরো বিমান বন্দর হয়ে দিল্লী এবং পরে যখন ঢাকায় কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন লক্ষ জনতা সেদিন জাতির পিতাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে। একইভাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। লাখ লাখ বাঙ্গালী সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়েই বিমান বন্দরে ঝড়, তুফান, ঠাÐা প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজেদের গর্বিত করেছিল।

জয় বাংলা শ্লোগানটি ছিল আতংক ও ভয়ের কারণ স্বাধীনতা বিরোধী আল-বদর আর রাজাকারদের। আরও বেশি আতংক ছিলো বাংলাদেশের অবৈধ স্বৈরাচারি শাসক জিয়া এবং এরশাদের কাছে। এবং পরবর্তিতে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। তাদের ধমনীর রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যেত জয় বাংলা শ্লোগান শুনলে। তাই সুকৌশলে স্বৈরাচারি জিয়া ক্ষমতা দখল করে, সংবিধানে সংশোধনী এনে আমাদের পবিত্র সংবিধান থেকে জয় বাংলা শ্লোগান বাদ দিয়ে সেখানে পাকিস্তানী ভাব ধারার শ্লোগান পাকিস্তান জিন্দাবাদের স্টাইলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ সংযোজন করেন। এবং স্বাধীন বাঙ্গালী জাতির ঘাড়ে পাকিস্তানী শ্লোগান চাপিয়ে দিয়ে তাদের বাধ্য করেন সর্বত্র এই শ্লোগান উচ্চারণ করতে। জিয়ার এমন সিদ্ধান্ত দীর্ঘ সাড়ে নয় বছরের স্বৈরশাসক এরশাদ যেমন কন্টিনিউ করেছিলেন এবং পরবর্তিতে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে একই শ্লোগানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। অথচ জিয়া ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে চাকুরি করা একজন সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমাণ্ডার। ভারতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যখন ট্রেনিং করাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সৈনিক এবং সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে সর্বপ্রথম জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনায় শানিত করতেন, যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণা যোগাতেন। এটা ছিল প্রতিটি সেক্টর কমাণ্ডারের নির্দেশ, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যারা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করলো তারাই আজ জয় বাংলার বিরোধীতা করছে। সেই খালেদা জিয়াও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন করা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতা যেমন করছেন একইভাবে জয় বাংলারও বিরোধীতা করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য এই খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা দিবস ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে উপহাস করতে তার ভূয়া জন্মদিন বানিয়ে বাঙ্গালীর সাথে তামাশা করছেন। যে জয় বাংলা শ্লোগান ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানে বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, যে জয় বাংলা শ্লোগান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় লাভ করতে সাহস যুগিয়েছিল এবং যে জয় বাংলা শ্লোগানে ভীত হয়ে ৯৪ হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল সেই শ্লোগান জাতীয় শ্লোগান হতে বাঁধা কোথায়? যারা এর বিরোধীতা করেছিল তারা পরাজিত শক্তি স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার যুদ্ধাপরাধী, বিএনিপর মত রাজনৈতিক দল। তাদের দিন প্রায় শেষ হয়ে আসছে রাজনীতির মাঠে, জয় বাংলা শ্লোগানকে তারা কোন দিন বিলুপ্ত করতে পারবে না। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ৪ মেয়াদকাল ধরে তারপরও তাকে নানান প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে এদেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে। এদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা সবকিছু তাকেই করতে হয়, একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান জাতীয় শ্লোগান জয় বাংলা শ্লোগান হিসেবে  প্রতিষ্ঠিত করতেও তাকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। শেষ পর্যন্ত একজন আইনজীবী রিটের প্রেক্ষিতে মাননীয় আদালত ঐতিহাসিক রায় দিয়ে প্রমাণ করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় শ্লোগান জয় বাংলা, এই শ্লোগানই ছিল বাঙ্গালী জাতির মুক্তিসনদ। দেশ বিরোধী বিএনপি জামাতের রক্তক্ষরণ শুরু হয় যখন গগণবিদারি শ্লোগান মুখরিত হয় জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।

সহ সভাপতি-যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ

শেয়ার করুন