২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৫:৫২:৩৪ অপরাহ্ন


দলকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে বেশি কি দেশকে ভালোবাসি?
মাহমুদ রেজা চৌধুরী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২২
দলকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে বেশি কি দেশকে ভালোবাসি?


গত ২১ মার্চ গভীর রাত্রে, ঢাকা থেকে বাংলাদেশের এক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ফোন করেছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক, পত্রিকার নাম এবং সম্পাদকের নাম লিখতে পারছি না। এখন তো এই সময়, সব কথা, সবার নাম, সবসময় নেয়াও যায় না। অনেকের মতে এটাই স্বাভাবিক, তাই অনিচ্ছাকৃতভাবে অনুমতি ছাড়া নামটা লিখতেও পারলাম না।

আমার অগ্রজ সম্পাদক ভাই, আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অর্ধশত বছর উপলে আসছে ২৬শে মার্চের জন্য একটা লেখা চাইলেন। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হয়ে গেছে গত বছর, ২০২১ সালে। বললাম, গতবছরের তো চলে গেছে আমাদের হাফ শত বছর স্বাধীনতার, এই বছর আবার কেন এই দিবস উপলইে লেখা চাচ্ছেন। বললেন,  তবু দিতে। আমি আমার অপরাগতা জানালাম। বলেছি, আমি সাধারণত দিবসভিত্তিক সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে কিছু লিখি না। কারণ কোনো বিশেষ দিনে কিছু লেখার মতো আমার কোনো যোগ্যতা আছে বলেও আমি বিশ্বাস করি না। বিশেষ দিনে বিশেষ, বিশেষ মানুষেরা লেখেন, আমরা পড়ি।

মধ্যরাতে জেগে এটা নিয়ে তাঁর সাথে অনেকণ কথা হলো। ঢাকাতে এই সময়টায় লাঞ্চ ব্রেক থাকে। কথায়, কথায় প্রিয় সম্পাদক বললেন, শোনো আজকে দুপুরে একটু কাচ্চি বিরিয়ানি খাবার সাধ হলো। কাচ্চি বিরিয়ানির দাম তো বেড়েছেই, কিছু বলার নেই। কিন্তু ভেতরের অংশটা মনে হয় নেই কাচ্চির মাংস এটা। গতরাত্রে হয়তো রান্না করা খাসির মাংস যেটা বিক্রি হয়নি, ওটা দিয়েই আজকে কাচ্চি করেছে। মানুষ সব দুই নম্বর হয়ে গেছে। বললাম, ফেরত দিয়ে দেন, পয়সার জন্য না। স্বাস্থ্যগত কারণেও খাবারটা আপনার না খাওয়াটাই ভালো। বললেন ঠিক বলেছো, দাঁড়াও।

বলেই আমাকে ফোনে রেখে তাঁর অফিসের একজনকে ডেকে আনলেন। বললেন, যাও এই খাবারটা ওদের ফিরিয়ে দিয়ে আসো। পয়সা ফেরত দিতে হবে না। শুধু বলবে, খাবারটা আমার জন্য নিয়েছিলে এবং খাবারটা বাসি মাংস দিয়ে তৈরি করা। এরকম কাজ যেন আর না করে।

তখন নিজে থেকেই বললেন, দেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমরা সবাই দিনে দিনে নিজের ন্যূনতম সততা থেকেও সরে যাচ্ছি। বললাম, এই কারণেও অনেক কিছু বলা যাচ্ছে না, বললেই যদি জেলহাজত হয়ে যায়। এই বয়সে সেটা না আমি নিতে পারবো, না আপনি। পারতাম যদি কোনো কিছু পাবার আশায় কিছু যদি এমন করতাম। সবসময় নিজেরটা খেয়ে অন্যের বাগানের দূর্বা ঘাস পরিষ্কার করতেও ভালো লাগে না।

কবি নজরুলের একটা কবিতা আছে, ‘বাতায়ন-পাশে

গুবাক- তরুর সারি’ এই নামে। ওই কবিতার একটা লাইন, ‘আজ হ’তে হ’ল বন্ধ আমাদের জানালার ঝিলিমিলি, আজ হ’তে হ’ল বন্ধ মোদের আলাপন নিরিবিলি ...’ অনেকটাই এমন, এখন জানালা খুলে বলতে মনের জানালা খুলে একে অপরকে নিজেদের কথা বলতে পারি না, লিখতেও পারি না।

আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নের পাপড়ি, অনেকেই আমরা তা মাটিতে দেখে যেতে পারিনি। যারা বেঁচে আছি এখনো, তারাও সেটা দেখছি না সেভাবে, যেভাবে দেখবার কথা ছিল সবার। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন, বুকের রক্ত দিয়েছেন, তাঁদের আত্মা যদি কিছু দেখতে পারে, তাঁরাও হয়তো অসহায় হয়ে কবি নজরুলের মতোই বলবেন।

‘ভুল ক’রে আসিলে স্মরণে অমনি তা যেয়ো ভুলি। 

যদি ভুল ক’রে কখনো এ মোর বাতায়ন যায় খুলি;

বন্ধ করিয়া দিও পুনঃ তায়!.... তোমার জাফরি-ফাঁকে

খুঁজো না তাহারে গগন আঁধারে মাটিতে পেলে না

যাকে’! 

এখন এই সময় আমরা আমাদের শহিদদের স্বপ্নের কথা মনে হলেই ভুলে যেতে চাই, তাঁদের কথা, কারণ তাঁদের স্বপ্নকে মাটিতে ধরে রাখতে পারিনি আমরা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অনেকগুলো বছর চলে গেলেও যাদেরকে শাসক হিসেবে পেয়েছি অথবা পেয়েছিলাম, তাঁরা কে-বা কতটা এদেশের মানুষের বন্ধু ছিলেন? তাঁরা কে কতটা-বা সবার উপরে দেশকেই ভালোবেসেছেন! এসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু খুব কঠিন না, উত্তরটা বর্তমান প্রজন্মের সবারই জানা। পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস থেকেও আরো ভালো জানতে পারবে।

আমরা যতটা যে, যে দলকেই ভালোবাসি, সেটাকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে বেশি কি দেশকে ভালোবাসি কখন? আমরা আমাদের বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে বেশি কি সেই দলকে ভালোবাসি? আমরা আমাদের শক্তিকে যতটা ভালোবাসি, মা এবং বিনয়কে কি সেভাবেই ভালোবাসি নিজেদের কাজকর্মে? রাজনীতি করতে গিয়ে অথবা সরকার পরিচালনা করতে গিয়েও আমরা অনেক কিছুর বান্ধব বলি বা দাবিও করি নিজেদের। এই আমরা কতটা সত্যিকার অর্থে ‘জনবান্ধব’ হই? আমরা একেকজন বিভিন্ন দায়িত্ব এবং কর্তব্যে যতটা ‘সবান্ধব’, তার চেয়ে বেশি কি সমাজবান্ধব হই কখনোই? আমরা যতটা ‘মতাবান্ধব’, তার চেয়ে বেশি কি কখনো গণতান্ত্রিক হই বা হইছি কখনো? এই রকম কিছু প্রশ্ন নিয়ে গত রাত থেকেই ভাবছিলাম, তাই ঘুম আসছিল না।

শুরু থেকে এখন পর্যন্ত (১৯৭২-২০২২) শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে এখন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা দেশ চালাচ্ছেন। শেখ মুজিবের করুণ মৃত্যুর পর, কয়েক মাসের জন্য মতায় ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। আওয়ামী লীগেরই সদস্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তারপর মতায় আসলেন সামরিক বাহিনীর কর্তা জিয়াউর রহমান। মতায় ছিলেন পাঁচ বছর। এরপর সামরিক বাহিনীর আরেক কর্মকর্তা মতায় আসেন, হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। মতায় ছিলেন নয় বছর। তারপরে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, পুনরায় খালেদা জিয়া, ২০০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত একটানা এখন মতায় আছেন, শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা। 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনার মতো একটানা এতোটা দীর্ঘসময় কেউই মতায় ছিলেন না এর আগে। এদিক থেকে বিবেচনায় শেখ হাসিনার শাসনামল আপাতত দীর্ঘ একটা শাসনামল। এই শাসনামল কতটা গণতন্ত্রের সপে আর কতটা গণতন্ত্রের বিপরীতে, ইতিহাসেই স্যা থাকবে। পাশাপাশি এটাও বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই কোন শাসকের আমলেই বাংলাদেশে কার্যকরীভাবে কোন "গণতন্ত্র" চালু ছিল না। এখনো নেই। এইভাবেই গণতন্ত্রের বিপে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং বৈষম্যমূলক আর্থিক সমাজ ব্যবস্থাপনাই বিরাজমান বাংলাদেশে গত পাঁচ দশক থেকেই।

এরমধ্যেই, যে উন্নতি বাংলাদেশ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এই দেশের নি¤œবিত্ত এবং নি¤œ মধ্যবিত্তদের সততা এবং পরিশ্রমের। সরকার যেটুকু কাজ করেছে সেটা সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য থেকেই করেছেন। এর বাড়তি কোনো কাজ কোন সরকার ই কখনও করেননি "সাধারণ মানুষের" স্বার্থে। যদি করে থাকে সেটা করেছে "দলীয় মানুষের" স্বার্থে প্রতিটা সরকার। আমার কথা শোনার পর সম্পাদক আমাকে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, তোমার এসব কথা আমি পত্রিকায় ছাপাতে পারবো না। 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নিউইয়র্ক

শেয়ার করুন