২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৪:২৮:২০ পূর্বাহ্ন


ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব ছিল আসামকে বাংলাদেশের সাথে রাখার
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৯-২০২২
ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব ছিল আসামকে বাংলাদেশের সাথে রাখার


১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের বিভীষিকার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরম্পরায় যখন আওয়ামী লীগেরে পুনরায় উথান হলো তখন ভারতীয় কংগ্রেসের বিশ্বস্তজন হিসেবে দেখা দেন আব্দুর রাজ্জাক। আব্দুর রাজ্জাক বাকশালেই থেকে যান। কিন্তু একসময় কংগ্রেসের বাংলাদেশ বিষয়ক নেতা প্রণব মুখার্জি ও প্রিয় রঞ্জন দাশ মুন্সী, যাদের সাথে আব্দুর রাজ্জাকের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে তাদের মধ্যস্থতায় আব্দুর রাজ্জাককে আওয়ামী লীগে গ্রহণ করে নেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর থেকে শেখ হাসিনার সাথে প্রণব মুখার্জির সম্পর্ক চাচা-ভাতিজিতে রূপ নেয়। আজ প্রণব মুখার্জি নেই। কিন্তু তার প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকার করে গেছেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও তাই প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম শুভাকাক্সক্ষী বলা চলে। যদিও তার অনেক বিতর্কিত আচরণ রয়েছে। তার চেয়েও বিতর্কিত আচরণ বাংলাদেশের অনেক নেতা-নেত্রীর রয়েছে। আমার আজকের বিষয় তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ নয়। এ বিশ্লেষণ কংগ্রেসের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির উত্তরসূরি বলা চলে সেই আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মার মন্তব্য নিয়ে। শর্মা কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতায় তার মহামন্তব্যের প্রভাব রয়েছে বটে। কারণ ভারত বিভাগ ভারতের অধিকাংশ মুসলিম কখনো চায়নি। বরং তার বক্তব্যে যে বাংলাদেশকে ইঙ্গিত করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমন্বিতকরণের প্রত্যক্ষ প্রস্তাব দেয়ার পূর্বে ভারতের আরএসএস, শিবসেনাসহ সংঘ পরিবারের লাঠিয়াল বাহিনী, তলোয়ার বাহিনীর যে আচরণ তাকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে বৈকি? আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত শর্মা তার বিতর্কিত বিবৃতি এমন একসময় দিয়েছেন, যখন প্রধানমন্ত্রী এক কূটনৈতিক মিশনে ভারতে রয়েছেন বলে প্রকাশ্যে দাবি করা হয়েছে। আর সেই মিশনের সময় ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার একটি হচ্ছে আসাম থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদী নিয়ে। কথা ছিল শেখ হাসিনা তিস্তা নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু না তার পরিবর্তে কথা হয়েছে কুশিয়ারা নিয়ে। তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পশ্চিম বাংলা থেকে। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনার দিল্লি যাত্রা নিয়ে। এবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি যাত্রা নিয়ে দুটি প্রদেশ থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য বাংলাদেশের অস্তিত্বকে একদিকে যেমন হুমকির মুখে ফেলেছে, অন্যদিকে এদেশের বর্তমান শাসক মহল আওয়ামী লীগকে এক বিব্রতকর অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যদিও হাসিনা ভারত যাওয়ার আগে মমতাকে চিঠি দিয়েছে বলে ভারতীয় প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি বা হেমন্ত শর্মার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মনে মনে সম্ভবত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এসব মন্তব্যে খুশিই হয়েছেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন ক্ষমতা থেকে গেলে তার শরীর, মুখ রক্ষা করা কঠিন হবে।

মুখ্যমন্ত্রী শর্মা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ যা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পদযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে উত্তর করেছেন। এই পদযাত্রা আসলে কংগ্রেস থেকে উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন নেতার চলে যাওয়ার প্রেক্ষিত কংগ্রেসের সাংগঠনিক কর্মকা- ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে। মি. শর্মা বলেন, ‘ভারত ঐক্যবদ্ধ কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী, শিলচর থেকে স্বরাস পর্যন্ত আমরা এক, কংগ্রেস দেশকে ভারত ও পাকিস্তানে ভাগ করেছে। তারপর বাংলাদেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি রাহুল গান্ধী তা নিয়ে তার প্রপিতামহ জওহরলাল নেহেরুর ভুল বুঝতে পারে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে চায়, তাহলে ভারতের অভ্যন্তরে ‘ভারত জোড়ো’র কোনো কারণ নেই। চেষ্টা করা উচিত পাকিস্তান, বাংলাদেশকে নিয়ে অখ- ভারত কায়েম করা’। শর্মা কংগ্রেস থেকে ২০১৫ সালে বিজেপিতে যোগ দেন। তিনি যে এ দাবি করে বলেছেন, তা এএনআই নামে এক নিউজ এজেন্সি ভিডিওতে টুইট করেছে।

রাষ্ট্রীয় শ্যামসেবক সংঘ (আরএসএম) অখ- ভারতের কথা বলে থাকে। আরএসএস বিজেপির আদর্শিক পিতৃতুল্য সংগঠন। তারা অখ- ভারত বলতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, আফগানিস্তান, তিব্বত ও মায়ানমারকে বোঝায়।

বিষয়টা অদ্ভুত, বর্তমানে বিজেপি নেতা হয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত শর্মা কিন্তু পুরো সত্যটা তুলে ধরেনি। কারণ ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ কিন্তু জওহরলাল নেহেরুর একক বিষয় ছিল না। সেখানে আজকের বিজেপির অন্যতম নমস্য ব্যক্তি বল্লভ ভাই পাটেলও সম্পৃক্ত ছিল, বরং বল্লভ ভাই পাটেলের দাবিতে ভারত ৮ খ-ে বিভক্ত হয়। কারণ সেদিনের কংগ্রেস এর কট্টরপন্থী বল্লভ ভাই পাটেল ও কংগ্রেসবিরোধী সাভারকারের দল, যাদেরকে মোরারজি দেশাইয়ের কারণে মূলোৎপাটন করা যায়নি- তারা খণ্ডিত ভারতই প্রকারান্তরে চেয়েছিল। গান্ধীকে যখন প্রথমবার খুন করার জন্য চেষ্টা করা হয়, তখন পুলিশ সাভারকারকে গ্রেফতার করার জন্য তৎকালীন বোম্বের ডেপুটি কমিশনার মোরারজি দেশাইয়ের কাছে অনুমতি চেয়েছিল। দেশাই সে অনুমতি দেয়নি। কিন্তু প্রকারান্তরে তা ছিল এক খেলা। কারণ কোনো অপরাধী বা অপরাধের সাথে সন্দেহজনক কাউকে গ্রেফতার করতে কোনো পুলিশকে অনুমতি নিতে হয় না বা ডেপুটি কমিশনারের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সেদিন কেন অনুমতি চাওয়া হয়েছিল বা অনুমতি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল তা বোধগম্য নয়। কারণ সেদিন সম্ভবত কংগ্রেসের ভেতরে-বাইরে খ-িত ভারতের রূপরেখা আরএসএস, শিবসেনা ও সংঘ পরিবারের অন্যদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। কাজেই এক কংগ্রেসকে এ নিয়ে দায়ী করলে হেমন্ত শর্মা সঠিক তথ্যটি দিয়েছেন বলা যাবে না।

আসলে বাংলাদেশকে ভারতভুক্ত নয়, সেদিন ব্রিটেনের কেবিনেট কমিশন প্রস্তাব তুলেছিল আসামকে পাকিস্তানভুক্ত বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত করার; কিন্তু সেদিন যদি কংগ্রেস নেতারা বিশেষ করে গান্ধী ও নেহেরু বিরোধিতা না করতেন, আজ সিলেটের মতো আসামও বাংলাদেশভুক্ত হতো। বাংলার নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আসামকে পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত করার দাবি তুলেছিলেন বলে তাকে দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত আসামের জেলে বন্দি থাকতে হয়েছিল।

শহীদ সোহরাওয়ার্দীও পশ্চিম বাংলাকে বাংলাভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন সুভাষচন্দ্রের মতো নেতাদের ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে পশ্চিম বাংলা আজ ভারতভুক্ত। এ নিয়ে অন্যদিন লেখা হবে। 

শেয়ার করুন