১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৫:১০:১০ অপরাহ্ন


প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৯-২০২২
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে সারা দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর রাজনীতির মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে চলছে নানান ধরনের মন্তব্যের ঝড়। এর পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন ধরনের জয় পরাজয়ের হিসাব নিকাশ। 

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে তার ৪ দিনের সরকারি সফর শেষ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় ১১টা ৪০ মিনিটে নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছলে তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, সফরের প্রথম দিন বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শংকর দিল্লীতে তার অবস্থান স্থল আইটিসি মৌর্য হোটেলের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফরের দ্বিতীয় দিন, ৬ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনা হায়দরাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং একান্ত বৈঠক করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার সম্মানে আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার দেয়া হয়। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যে ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ কর্তৃক কুশিয়ারা নদীর ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের সমঝোতা স্মারকও রয়েছে। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের গৃহীত বেশ কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে খুলনার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক মৈত্রী পাওয়ার প্লান্ট ইউনিট-১ও রয়েছে।পরে যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদারে দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। যৌথ বিবৃতিতে ভারত বাংলাদেশি যে কোন পণ্য তৃতীয় কোন দেশে রপ্তানি করতে বিনা মাশুলে ট্রানজিট ব্যবহারে সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করে। একই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে শেখ হাসিনা যোগ দেন। শেখ হাসিনা পৃথকভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মূ এবং উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখারের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ সেপ্টেম্বর রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতির শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন মন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি এবং নোবেল জয়ী কৈলাশ সত্যার্থীরও সাক্ষাৎ করেন। একই দিন আইসিটি মৌর্য হোটেল কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। একই দিনে পরে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এবং যুদ্ধাহত ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সেনা ও অফিসারদের উত্তরসূরীদের ’মুজিব বৃত্তি’ প্রদানের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন এবং বৃত্তি প্রদান করেন।

কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। অসুস্থতার কারণে তিনি ভারত সফরে যাননি বলে বলা হয়। তবে তার এই না যেতে পারা নিয়ে দেশে বিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। আরো ঝড় আর আলোচনা তুঙ্গে উঠে যখন পরের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অফিস করেন।  প্রশ্ন উঠে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অফিস করলেন কীভাবে? যার পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য মন্ত্রী হাছান মাহমুদকে মুখ খুলতে হয়। এব্যাপারে এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর বাতিলের বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) অসুস্থতার কারণেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত সফরে যাননি। হাছান মাহমুদ আরো বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ যান, তখন সবসময় তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সফরসঙ্গী হন না। এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কিছুটা অসুস্থ। তাই তিনি সফরে যাননি। এখন এটিই আমাকে ধরে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) পররাষ্ট্রমন্ত্রী অফিস করলেন কীভাবে? আসলে কিছুটা অসুস্থ থাকলে অফিস করা যায়। কিন্তু এরকম হাই লেভেল ভিজিট করা কঠিন বা সম্ভব নয়। আমিও তো কিছুটা অসুস্থ থাকলেও অফিস করি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় আমার পক্ষে কি বিদেশ সফর করা সম্ভব? সম্ভব না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অসুস্থ থাকার কারণে সফর নির্ধারিত থাকার পরও তিনি যাননি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মমতার একই দুঃখ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে আমন্ত্রণ না জানানোয় ভারত সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মমতা বলেছেন, ’বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক। কিন্তু তার সফরে (কেন্দ্র) আমাকে আমন্ত্রণ জানায়নি। তার সঙ্গে বিদেশি অতিথিদের সাক্ষাতের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কেন ’চিন্তিত’ থাকে বলেও প্রশ্ন তোলেন তিনি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ারের সঙ্গে নয়া দিল্লীতে দেখা করতে না পারার বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ ইমরানের বাসভবনে আয়োজিত রিসেপশন ডিনারে যোগ দিয়ে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ’মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি আমার বোনের মতো। আমি এবার দিল্লিতে তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। কী করা যেতে পারে?’ 

সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের দাবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে এমন সফরে তারা জয়ী হয়েছেন। সরাসরি মুখে কিছু না বললেও ধরে নেয়া যায় ভারতের সমর্থন তারা একশত ভাগ পেয়েছেন। সফর একশত ভাগ সফল। এবার দেখা যাক কে কি বললেন। তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভারত সফর অত্যন্ত সফল এবং ফলপ্রসূ। এর মধ্যে সবচে বড় অর্জন হচ্ছে ভারতের স্থলভাগ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যসহ বিনাশুল্কে পণ্য রপ্তানির করার সুযোগ, যেটির জন্য বহু বছর ধরে বাংলাদেশ চেষ্টা করে এসেছে। ’অথচ এই ভারত সফর নিয়ে বিএনপি নানা ধরনের কথা বলেছে, এখন নিশ্চয়ই চুপসে গেছে কিন্তু এরপরও আজকালের মধ্যে তারা আরো কিছু একটা বলবে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সফল ভারত সফর করে বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিদেশি কোনও রাষ্ট্র বা সংস্থা কাউকে ক্ষমতায় বসাবে এমন উদ্ভট কথা বিএনপি বিশ্বাস করলেও আমরা করি না। বাংলাদেশ ও ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আস্থাপূর্ণ হওয়ায় বিএনপির গাত্রদাহ শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের। 

বিএনপি’র প্রতিক্রিয়া 

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোন সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়েছেন না জানালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে বলেই ফেলেছেন দেশটি (ভারতও) এখন আর তাদের ওপর খুশি নয়। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তিস্তার পানিবণ্টন, অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, বাণিজ্যের ব্যবধান কমানো- সুযোগ-সুবিধাগুলো নিয়ে আসতে পারেনি সরকার। ভারতও এখন আর তাদের ওপর খুশি নয়। খুশি নয় বলেই ‘নৃত্য-নৃত্যে’ ভরপুর একটা সফর দিয়েছে। অন্যদিকে  প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থে কোনো কথা হয়নি মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আমরা জানি না এই সফরের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা। তিনি বলেন, প্রতিবার ভারত গিয়ে তিনি শুধু দিয়ে এসেছেন, কিছু নিয়ে এসেছেন বলে দাবি করতে পারেননি।

অন্যান্যরা কি বলেন?

গণফোরাম একাংশের সভাপতি জননেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু গণফোরাম নির্বাহী পরিষদের জরুরি বৈঠকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে আমরা কি পেয়েছি? বাংলাদেশ কিছুই অর্জন করতে পারেনি! আমরা ভারতকে কানেক্টিভিটির সমস্ত লাইন দিয়েছি কিন্তু তিস্তা আমরা এখনও পেলাম না। অথচ অন্য কারো সাথে আমরা কানেক্টিভিটি পাইনি এটা নিয়ে আলোচনা। নেপাল-ভুটান থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভবনা ছিল কিন্তু তাও পায়নি বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও শেখ হাসিনা- নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে বাংলাদেশ পেয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি।

দলের নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ বলেন- দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পরে যৌথ বিবৃতিতে দেখা যায় বাংলাদেশ ভারতের বাজারে পাকাপোক্ত ভাবে পরিগণিত হবে। নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর কোন ব্যবস্থা না করে অন্য দেশ নির্ভর আমদানি নীতি গড়ে তোলা হচ্ছে। স্বাধীন-সর্বভৌম বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতে আমাদের পণ্য রপ্তানির সক্ষমতা আছে সেই ব্যাপারে যৌথ বিবৃতিতে কোন উল্লেখ নেই। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এই যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বার্খের পক্ষে কোন সারবস্তু আছে বলে মনে হয় না।

গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, এই সফর বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন সফর নয়, এই সফর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রাখতে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার ষড়যন্ত্রের সফর। ইতোপূর্বে যা অবৈধ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন। এসব ছলচাতুরী এদেশের মানুষ জানে তাই এবার কোনভাবেই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনের সুযোগ নেই।

কূটনীতিকরা কি বলেন?

বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেশের কূটনীতিবিদরা বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ করেছেন এই সফর নিয়ে। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন একটি দৈনিকে লিখেছেন, আমার দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর একটি ধারাবাহিক সফর। যেমনটি দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মাঝে আমি গুরুত্ব দিই কুশিয়ারা নদীর পানিবন্টনের বিষয়কে। বাকিগুলো ছোট ছোট বিষয়। যদিও এর কোনোটা নেতিবাচক নয়। মো. তৌহিদ হোসেন তার মন্তব্যে এক জায়গায় বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম দাবি তিস্তা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা- এগুলো নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত ১১ বছর ধরে আমরা প্রতিশ্রুতিই পাচ্ছি। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। আবার প্রতিশ্রুতিই এসেছে। বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট- সেপা) ঘোষণা এসেছে। দেখা যাক সেটা কতটুকু এগোয় তা-ও বলেছেন এই সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। 

ভারত নিয়ে বিএনপি’র এতো আগ্রহ কেন?

টানা দেড়যুগ বিএনপি বাংলাদেশে ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছে। বিএনপি’র নেতাকর্মীরা এখন উদ্বিগ্ন তারা আর বাংলাদেশে ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে পারবে কি-না? এরপাশাপাশি তারা নানান ধরনের রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক চেষ্টা তদবির চালিয়েও ক্লান্ত। তবে তাদের এখন রাজনৈতিক বোধোদয় হয়েছে যে ক্ষমতায় খাকাকালীন সময়ে পাশ্ববর্র্তী দেশটির সাথে সুস্পর্ক রাখা তাদের জন্য জরুরি ছিল। তাদের এখন বোধোদয় হয়েছে যে বিএনপি’র নেতৃত্বে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছিল সেই বিএনপি কিভাবে দেড়যুগ ক্ষমতার বাইরে আছে আর এর পেছনে কি? বিএনপি’র সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দল বলে পরিচিত দল জামায়াতের কারনেই যে তারা দেশে বিদেশে বিশেষ করে এই প্রতিবেশী দেশটি বিক্ষুব্ধ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিএনপি এখন টের পাচ্ছে যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগে বিরুদ্ধে আরেকটি অসম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক দল হিসাবে এতোদিন প্রতিষ্ঠা পেয়ে আসছে। সে ইমেজ একমাত্র জামায়াতের কারণে ধবংস হয়ে গেছে। বিএনপি বুঝতে পেরেছে ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাৎ না করাটি ভুল ছিল। তবে এব্যাপারে এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া এব্যাপারটি তুলে ধরে বলেছিলেন জীবনের প্রতি হুমকি থাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাননি। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভারতের দ্য সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাকেই একিই সাক্ষাৎকারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খালেদা জিয়া। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভারতের দ্য সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাকে জানান আওয়ামী লীগ সরকারের যড়যন্ত্র ও বিভিন্ন কুটকৌশলের কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাৎকারটি না হওয়ার আশঙ্কা ছিল। মোদির সঙ্গে আমার (খালেদা জিয়া) সাক্ষাৎটি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে তারা কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেনি। এব্যাপারে খালেদা জিয়া ঔ সাংবাদিককে বিস্তারিত বলতে গিয়ে জানান- বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী প্রকাশ্যে বলেছেন, মোদির বাংলাদেশে অবস্থানকালীন তাঁর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু নয়াদিল্লি তখন সবকিছু পরিষ্কার করল। মোদির সফরের আগের দিন সন্ধ্যায় এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই কথা জানানোর কয়েক ঘণ্টা পরই নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর জানিয়ে দেন, সাক্ষাৎটি হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। আপনি এটাকে কীভাবে দেখবেন? ভারতের কর্তৃপক্ষকে আমি ধন্যবাদ জানাই। সাক্ষাৎটি যাতে না হয়, সে জন্য যা যা করা যায় বাংলাদেশের সরকার তা করেছে। মোদির সঙ্গে আমি কোনো কথা বলি তারা সেটা চায়নি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের কাছে প্রশ্ন থেকেই যায় ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাৎ না করার পেছনে চক্রান্তটি কে করেছিল? কোন দলের পরামর্শে তিনি এটা করলেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন পরে বিএনপি বুঝতে পেরেছে তারা দেশে বিদেশে জামায়াতের মতো একটি সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে পরিচিত পেয়ে গেছে, যা তাদের রাজনীতিকে কয়েক যুগ পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিএনপি এখন এসব থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চায়। দলটি নিজেদেরকে আর তথাকথিত ভারত ও হিন্দু বিরোধী দল হিসাবে দাঁড় করাতে চায় না। কেননা খালেদা জিয়াই ভারতের দ্য সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাকেই একই সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, আমাকে এবং বিএনপিকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে একটি সুপরিকল্পিত প্রপাগান্ডা যন্ত্র অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি তিনি তুলে ধরেন, আমি কেন ভারতবিরোধী হতে যাব? সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে বলেন দেখুন, আমি আপনাকে যা বলছি শুনুন। আমাকে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী হিসেবে তুলে ধরার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার জোর প্রপাগান্ডা চালায়। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধন অনেক জোরালো এবং আমাদের স্বাধীনতার পেছনে তাদের অবদানকে আমরা পুরোপুরি স্বীকৃতি দিই। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদির এই সফর। এমন সময় তারা আমাকে ভারতবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন বিএনপি বুঝেছে প্রতিবেশী ভারতে ক্ষেপিয়ে তারা আর বেশিদূর যেতে পারবে না। 

তবে...শেষ কথা 

আর মাত্র কয়েকমান পরই দেশে একটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়াজে বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। আর একারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ও নানান প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। একারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি প্রতেকেই দাবি করছে তারা বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে কে কিভাবে লাভবান হলো তা-র নানান ফর্মুলাও তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন টক শো, সভা- সমাবেশে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলেও হাস্যরসেরও সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করে এদেশের বড়ো দু’টি দল দেশের জনগণ নয় আরেকটি দেশ বা শক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এমন আশাতেই দিন গুণছে। যা দেশে জাতি ও একটি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনতে পারে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। তারা মনে করেন, এটা দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভোমত্বের প্রতি রাজনীতিবিদ ও দলের অনাস্থাই প্রকাশ পাচ্ছে প্রকারন্তরে এমনসব কথা বার্তায়। কেননা একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের তালিকা থেকে  পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বাদ পড়ে যাওয়ার বিষয়টি তেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃষ্টিকটু ঠেকেছে অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে আমন্ত্রণ না জানানোয় ভারত সরকারের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ক্ষোভ প্রকাশও সবার নজরে এসেছে। আবার মৌর্য হোটেল কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সৌজন্য সাক্ষাৎ ঠিকই হয়েছে। একটুকু বিশ্লেষণ করতে কাউকে দক্ষ কুটনীতি হবার দরকার নেই যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে আওয়ামী খুব বেশি খুশি হবার সুযোগ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর শেখ হাসিনা এই সফরে সবাই আশা করেছিল তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তি এবং সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ করাসহ দ্বিপাক্ষিক মূল ইস্যুগুলোর একটা হিল্লা হবে। কিন্তু তা কিন্তু হয়নি। অন্যদিকে বিএনপি যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সফল হয়নি বলে প্রচার করে যাচ্ছে সেব্যাপারে পর্যাপ্ত যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেনি বিএনপি। কাই কি বারণে বিএনপি এতো খুশি। সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কয়েকটি বক্তব্য বিশ্লেষণই যথেষ্ট। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দুই দেশের পারস্পরিক বিশ্বাস অক্ষুন্ন রাখতে ভারত ও বাংলাদেশকে যৌথভাবে সন্ত্রাস ও মৌলবাদী শক্তির মোকাবিলা করা উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে অঅর্ন্তজাতিক অঙ্গনে সন্ত্রাস ও মৌলবাদী শক্তির সাথে বিএনপির যে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা থেকে দলটি কি পরিত্রাণ পেয়েছে? কারণ এখনো বিএনপি জামায়াতের মতো শক্তির সাথে সর্ম্পকের বেলায় ধরি মাছ না ছুই পানির মতো। আবার দেখা যাচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘বন্ধুপ্রতিম ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়। বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী এবং চতুর্থ রপ্তানি বাজার। তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা সবসময়ই চায় ভারত।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা চাওয়ার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যাখা কি তা বিএনপি’কে ভালোভাবে বুঝতে হবে। তা বুঝতে না পারলে তাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। সেটা বুঝতে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবি সুব্রত চৌধুরীর বক্তব্যটির ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ সিনিয়র এই আইনজীবী বলে ফেলেছেন, এই সফর (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর) বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন সফর নয়, এই সফর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রাখতে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার ষড়যন্ত্রের সফর। ইতোপূর্বে যা অবৈধ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন।

শেয়ার করুন