২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৬:৪৮:০২ অপরাহ্ন


ভোলার আবিষ্কৃত গ্যাস কেন গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে না?
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১০-২০২২
ভোলার আবিষ্কৃত গ্যাস কেন গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে না?


দ্রুত কমে যাচ্ছে মজুদ গ্যাসের সঞ্চয়। মূলত গ্যাসনির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থার প্রকৃত সংকটের গভীরতা আর ব্যাপ্তি কতটা সম্মক উপলব্ধি করে লাগসই পরিকল্পনা কেন নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ তা নিয়ে সন্দেহ জাগে। নিজেদের জ্বালানি সম্পদ আহরণ আর উন্নয়ন বিষয়ে নিস্ক্রিয়তা, সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব এই সংকটের মূল কারণ সেই কথা কবে থেকে বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আমলানির্ভর জ্বালানি প্রশাসন কানে তোলেনি ২০১০, ২০১৬ বিদ্যুৎ সেক্টর মাস্টার প্ল্যান।




২০১০ থেকে  দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন করে টেন্ডারবিহীন কাজে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তথাকথিত ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের গালভরা বুলি দিয়ে সম্পদের অপব্যাবহার করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহও চেনের মূল সেগমেন্ট জ্বালানি সরবরাহ নির্বিঘ্ন করা হয়নি। দেশের জ্বালানি উপেক্ষা করে ভ্রান্ত পরিকল্পনায় কয়লা, তেল, গ্যাস আমদানির চেষ্টায় নিদারুণ ব্যর্থ হয়ে এখন জ্বালানি সংকট ডেকে আনা হয়েছে। দেশের মহামূল্য কয়লাসম্পদ আদৌ ব্যবহার করা হবে কিনা সন্দেহ জাগছে।





জলে-স্থলে গ্যাস আহরণ অ্যান্ড উত্তোলন চলছে ঢিমেতালে। দুর্বল বাপেক্সকে স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনের একক দায়িত্ব দিয়ে সংকট ত্বরান্বিত করা হয়েছে। সাড়ে ৪ হাজার এমএমসিওএফডি গ্যাস চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে সর্বসাকুল্যে ২৭৫০-২৮০০ এমএমসিএফডি। বিপুল ঘাঁটি নিয়ে পেট্রোবাংলার এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি দোদুল্যমনতা। শিল্প বিশেষ করে রফতানিমুখী শিল্পগুলো বিপুল সংকটে। ক্যাপটিভ জেনারেটার গ্যাস পাচ্ছে না, বয়লার চালানোর জ্বালানি সঙ্গত। এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য সক্ষমতা হারাবে বিশ্ববাজারে টিকে থাকার। বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।





এর বিপরীতে জ্বালানি ব্যবহার চিত্র হতাশাজনক। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোতে এখনো বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগ। এগুলো বর্তমান সরকারের সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। অনেক বৈধ গ্রাহক অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছে। গ্যাস সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির কাহিনি পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ফিচার। কেন, কোন যোগ্যতায় একজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে অবাধ দুর্নীতির সুযোগ দিয়েছে বর্তমান সরকার- দীর্ঘদিন সেই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। তার কারণেই গ্যাস সেক্টরে দুর্নীতি ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা এখনো গ্যাস সেক্টরে বহাল তবিয়তে আছে বলে অভিযোগ।

পলিসি মেকার্সদের একাংশের ধারণা বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদ ফুরিয়ে গেছে। অথচ বেঙ্গল বেসিনের মতো বিপুল গ্যাস সম্ভার, অথচ দেশে অনুসন্ধানের পরিমাণ সীমিত। পুরো অফশোর প্রায় ভার্জিন, স্থলভাগের বিরাট অংশে অনুসন্ধান হয়নি। সুরমা বেসিনে কিছুটা হলেও সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুসন্ধান হয়নি। পেট্রোবাংলা-ইউএসজিএস, নরওয়ের প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বোন ইউনিটের সমীক্ষা উপেক্ষিত রয়েছে। ছাতক, টেংরাটিলা গ্যাস আছে। পটিয়া, জলদি, সীতাপাহাড়, কাসালাং গ্যাস-তেলপ্রাপ্তির বিপুল সম্ভাবনা আছে। ভোলার আবিষ্কৃত গ্যাস কেন গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে না? 




মনে হয় একশ্রেণির পলিসি মেকাররা কিছু মুখচেনা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য সংকট অব্যাহত রাখছে। যদি ভারত সীমান্ত-সংলগ্ন ত্রিপুরা রাজ্যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কার করতে পারে, যদি মায়ানমার বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় গ্যাস-তেল পেতে পাওে, বাংলাদেশ কেন হাত গুটিয়ে বসে আছে? কেন মডেল পিএসসি সংস্কার করে অবিলম্বে সাগরে অনুসন্ধান করা হচ্ছে না। 




সবাই জানে, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে প্রয়োজনীয় গভীরতা নেই। তাই পায়রা, রামপালে কয়লা পরিবহনে সংকট দৃশ্যমান। একমাত্র উপযোগী স্থান মাতারবাড়িতে সুযোগ থাকলেও সেখানে একাধিক কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প তড়িৎ সিদ্ধান্তে বাতিল হয়েছে। পায়রা চালু হয়েছে, রামপাল প্রস্তুত কিন্তু সঞ্চালন ব্যবস্থা এখনো পিছিয়ে আছে। শোনা যায়, সঞ্চালন ব্যবস্থার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে চালু করা যাবে না রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সঠিক সংগঠন আর নেতৃত্বের অভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন গতিহীন।




এমতাবস্তায দ্রুত কমছে সঞ্চিত গ্যাসের পরিমাণ। কবে শেষ হবে মাতারবাড়ি ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনাল নিশ্চিত নয়। সামিট এনার্জির জন্য প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে দেয়া হলেও পারছে না ওরা। বিশ্ব জ্বালানি বাজারের অগ্নিমূল্যের কারণে বাংলাদেশ চাইলেই এলএনজি আমদানি করতে পারবে মনে করার কারণ নেই। 






বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার পেতে করণীয় 

সিস্টেম লসের নাম চুরি চিরুনি অভিযান চালিয়ে শূন্য করতে হবে। সবধরনের লিকেজ পিলফারেজ কমাতে হবে, গ্যাসসম্পদ মূল্যসংজোগন খাতে ব্যবহার করতে হবে। বিকল্প পন্থায় রান্নার কাজে পাইপলাইন গ্যাস ব্যবহার এলপিজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সিএনজিতে গ্যাস ব্যবহার সীমিত করতে হবে।

গ্যাস আহরণ আর উত্তোলন কাজে বাপেক্সের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। স্থলভাগে মডেল পিএসসি সংস্কার করা প্রয়োজন। ২০২৪ থেকে অন্তত ১০টি রিগ স্থলভাবে খননকাজে নিয়োগ করা সম্ভব হলে ২০২৭ নাগাদ ৩-৫ টিসিএফ গ্যাস স্থলভাগেই পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আর দেরি করা আত্মঘাতী হবে। 





বাংলাদেশ এজন্য আমদানি করবে। কিন্তু বিশ্ববাজার থেকে কি মূল্যে কতটুকু কখন জ্বালানি আমদানি সম্ভব সেটি বাস্তবতার বিচারেই নিরূপণ হওয়া প্রয়োজন। প্রশ্ন জাগে, সেই মানুষগুলো আজ কোথায় যারা জাপান কোরিয়া পারলে, বাংলাদেশ কেন পারবে না গাল ভারী কথা বলতো। বাংলাদেশকে উন্নয়ন ধারা বজায় রাখতে হলে দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি প্রসাধন ঢেলে সাজাতে হবে।

শেয়ার করুন