২৩ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ০৬:৬:০২ অপরাহ্ন


শতাধিক এমপি নাও পেতে পারেন নমিনেশন
আ.লীগ অনেক সাংসদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন যাচ্ছে
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২২
আ.লীগ অনেক সাংসদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন যাচ্ছে


আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের অনেকের মধ্যেই বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এর বাইরেও ডিসেম্বরের জাতীয় সম্মেলন কেন্দ্র করে দায়িত্ব পাওয়া ও দায়িত্ব থেকে বাদপড়ার সম্ভাবনায় তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত এই দুশ্চিন্তা, কোথাও স্বস্তি নেই। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা এবার বেশ কঠোর। সে বার্তাও তিনি ইতিমধ্যে দিয়ে রেখেছেন। মূলত এই বার্তাতেই দুশ্চিন্তা ভর করেছে নেতাদের মধ্যে। দুটি বিষয় নিয়ে মূলত দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে নেতাদের মধ্যে। প্রথমটি ডিসেম্বরের আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। এরপর দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। 

জাতীয় সম্মেলনে এবার অনেক হিসাব-নিকাশ। বিশেষ করে তারুণ্যে প্রধান্য দিয়ে এগোতে চায় আওয়ামী লীগ। আভাস মিলেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। বিগত কয়েকবারের চেয়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হবে প্রচ- প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এখানে এমন নেতৃত্ব বাছাই করার প্ল্যান, যাদের এলাকাতে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। দলের প্রতিও নিবেদিত। কখনো দলের সঙ্গে বেইমানি করবে না শতবাধা-বিপত্তি এলেও। কারণ গত ওয়ান-ইলেভেন সময়ে রাজনীতিতে সংস্কারের নামে একটা গ্রুপ সক্রিয় ছিলেন। সেটা ছিল দুদলেই। যাদের মূল প্ল্যান ছিল মাইনাস টু ফরমুলা (খালেদা হাসিনা)। যার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল ততকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ ও ফখরুদ্দীন সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মীদের একাত্মতা ও নেতৃত্বের অধিকাংশ বঙ্গবন্ধু পরিবার ও তার কন্যা শেখ হাসিনার পরিবর্তে অন্য কাউকে দলের শীর্ষস্থান ভাবতে অস্বীকার করায় আর সুবিধা করতে পারেনি। তবে তারা চিহ্নিত। তাদের অনেককে ক্ষমা করে আবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দিলেও একটা সন্দেহের বাতিক তাদের দিকে রয়েই গেছে। 

যেহেতু বিগত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে যেহেতু তেমন বেগ পেতে হয়নি, তাই দলের শীর্ষনেতাদের অনেককে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটা সেভাবে হচ্ছে না সেটা দিবালোকের মতো সত্য। ফলে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই মনোনয়ন দেয়া হবে বলেই আভাস মিলেছে। 

ইতিমধ্যে দলীয় একটা জরিপও শুরু হয়েছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত যার মাধ্যমে সম্ভব্য সংসদ সদস্য পদে কারা নির্বাচন করতে পারেন এমনকি জাতীয় সম্মেলনেও কাদের ওপর দল ভরসা করতে পারে বিভিন্ন স্তরে বা বর্তমান সংসদ সদস্যও যারা তাদের কার্যক্রমের চুলচেরা বিশ্লেষণ দেখতে চান দলের হাইকমান্ড।  

নেতাদের দুশ্চিন্তা এখানেই। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত একটা বার্তা দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কারণ দলীয় পদ ব্যবহার করে অনেকেই অনেক কিছু করেছেন, কখনো নিজে কখনো আত্মীয়স্বজন নিয়ে। কেউ কেউ দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের খোঁজও রাখেননি। অনেকেই ঢাকায় বসে তৃণমূলে অ্যাকটিভ থাকতে যেয়ে দলে বিভাজন তৈরি করে ফেলেছেন। অনেকেই নিজের দাপট দেখাতে নব্য আওয়ামী লীগের সদস্যদের ফ্রন্টলাইনে নিয়ে এসে সারাজীবন যারা সংগঠন করে আসছেন, এমন লোকদের উপেক্ষা করেছেন। তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। তাদেরকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করেছেন, অপমানিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই দলের বিপদকালীন সময়ে নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের খুব সম্মান দেয়ার চেষ্টা করেন। তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। কিন্তু অনেক সংসদ সদস্য বা শীর্ষ নেতৃত্ব সেটা না করায় তিনি নাখোশ। এতে করে তৃণমূলে ও সর্বস্তরে সম্ভাব্য সব নেতার আমলনামা তিনি দেখতে আগ্রহী হওয়ায় ওই জরিপকার্য, যা এলাকায় যেয়ে প্রয়োজনে সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। জরিপে উঠে আসবে সংসদ সদস্য পদে নমিনেশন পাওয়ার যোগ্য কারা। একইসঙ্গে জাতীয় সম্মেলনে সম্ভাব্য পদসমূহের জন্য যোগ্য কারা।  

বাদপড়ার কারণসমূহ 

শুধু বিরোধীদল ও পত্র-পত্রিকার খবরেই নয়, বাস্তবিক অর্থেও উন্নয়ন কাজ ঠিকমতো না করা, কমিশন খাওয়া, নিজস্ব নেতা-কর্মীর নামে মামলা, হয়রানি, ত্যাগী নেতাদের হয়রানি ও বলয় তৈরি করা, জনবিচ্ছিন্নতা, এলাকায় না যাওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলদারিত্বসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করার জন্য প্ল্যান রয়েছে ওই জরিপে। যাতে অন্তত শতাধিক নেতৃত্বকে ঝেড়ে ফেলার আভাস মিলেছে। সেখানে নিবেদিত প্রাণ ও তারুণ্যকে প্রধান্য দিয়ে নমিনেশন দেয়া হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। 

এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ফরমুলা- এমন প্রার্থীকে নমিনেশন দেয়া হবে, যিনি নিজের যোগ্যতায় এলাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে পাস করে আসতে পারেন। দলীয় প্রধান নিজে গিয়ে দেনদরবার বা মানুষকে বুঝিয়ে ভোট এনে পাস করিয়ে আনতে হবে এমনদের আর নমিনেশনের জন্য বাছাই করা হবে না। 

ফারুক খান এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য 

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গোপালগঞ্জ ১ আসনের সংসদ সদস্য ফারুক খান এমপি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে খোঁজ খবর নেয়া শুরু হয়েছে। এতে যাদের মধ্যে জনবিচ্ছিন্নতা, জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন এলাকাতে, সংগঠনের সঙ্গে সঠিকভাবে তালমিলিয়ে চলতে পারেনি, তাদেরকে সম্ভবত মনোনয়ন দেয়া হবে না। ইতিমধ্যে মনোনয়নের ব্যাপারে জরিপের কাজ চলছে।’ আওয়ামী লীগের এ সিনিয়র নেতা বলেন, ‘নরমালি প্রতিটা জাতীয় নির্বাচনে ওয়ান থার্ড নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ হন। অতীতে এমনটা হয়েছে। তাদেরকে বাদ দেয়া হয়। এতে করে শ’খানেক সংসদ সদস্য নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হন। সেখানে তারুণ্য ও প্রবীণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তাদের বাছাই করা হয় নমিনেশনের জন্য।’ 

মির্জা আজম, শীর্ষনেতা 

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘গত দুইটা নির্বাচনে অর্থাৎ ২০১৪ ও ২০১৮-তে বিরোধীদল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে তারা অংশগ্রহণ না করাতে এতে প্রার্থীদের আসলেই কী অবস্থা সে ভোটের চিত্রটা পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে এবারের নির্বাচনটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দল। এবার আমাদের নেত্রী বিভিন্ন সময় বলেছেন, যাদের মনোনয়ন দিলে নিজ যোগ্যতায় নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবে, অমন ব্যক্তিকে নমিনেশন দেয়া হবে। জানা গেছে এতে অন্তত ১০০ জনের মতো এবার বাদ পড়বে। 

এদের মধ্যে রয়েছেন যারা এলাকায় নিজে বা ভাই-বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের কারণে বিতর্কিত কাজ করেছেন, উন্নয়ন সম্পৃক্ত হতে পারেননি। আমার মনে হয় এ ধরনের নেতারা বাদ পড়বেন। নরমালি তো শ’খানেক এমনিতেই চেঞ্জ হয়।  এবার আরো বেশি হতে যাচ্ছে।’  

তদবির-লবিং শুরু 

যেহেতু সবার কাছে জরিপের ম্যাসেজ চলে গেছে। গোপনে আড়ালে হয়েও যাচ্ছে আমলনামা যাচাই-বাছাই। ফলে ইতিমধ্যে বেশকিছু নেতা সিনিয়রদের কাছে, নীতিনির্ধারকদের কাছে যেয়ে তদবির-লবিং শুরু করে দিয়েছেন। এমপি থাকা অবস্থায় নমিনেশন না পাওয়া প্রেস্টিজ ইস্যু। তাছাড়া এরা সাংগঠনিকভাবেই কিছুটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যে পড়ে যান। এটা দলে ভালো নজরে কেউ দেখে না। তাইতো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই দৌড়ঝাঁপ। অন্যদিকে তৃণমূল নিজস্ব এলাকায় কাজকর্ম করে সংগঠন চাঙ্গা রেখে এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন এমন যারা এদের অনেকেও লবিং শুরু করছেন যাতে তারা নমিনেশনের জন্য বিবেচ্য হন। এলাকায়ও তারা তৎপর। তাছাড়া জাতীয় কাউন্সিলটাও গুরুত্বপূর্ণ। 

এখানে ভালো পদ বাগিয়ে নিতে পারলে বা যোগ্যতার বলেই পেয়ে গেলে সেটাও নমিনেশন প্রাপ্তিতে বড় ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বরের জাতীয় কাউন্সিল ও দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একরকম দুশ্চিন্তা, টেনশন উৎকণ্ঠা এমপি, এমপি হওয়া প্রত্যাশীদের। তবে এটা ঠিক দলেয় নেত্রী শেখ হাসিনা এ সকল ব্যাপারে খুবই স্বচ্ছ। সবার হাঁড়ির খবরটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত দেন। এখানে তদবির বাণিজ্যটা নেই বললেই চলে। কারণ কার কী ইনটেনশন সেটা সে জানেন। এলাকায় কার কী অবস্থা এটার প্রতিনিয়ত খবর রাখেন। তাকে চোখ এড়ানো সম্ভবপর নয়। ভয় বা দুশ্চিন্তাটা এ কারণেই বেশি। কারণ নেত্রীর কাছে কোনো কিছুই যে লুকানো যাবে না এটা সবার জানা! এটা দিন যতো ঘনিয়ে আসবে, ততো বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

শেয়ার করুন