১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৯:২২:০০ পূর্বাহ্ন


কাজটা করতে গিয়ে প্রেমে পড়া খুবই স্বাভাবিক
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২২
কাজটা করতে গিয়ে প্রেমে পড়া খুবই স্বাভাবিক গিয়াস উদ্দিন সেলিম, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নাট্য ও চলচ্চিত্র : ফাইল ছবি রিচালক


দেশ’কে সেলিম 

গিয়াস উদ্দিন সেলিম, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তার পরিচালিত মনপুরা ও স্বপ্নজাল পেয়েছে দর্শকপ্রিয়তা। তার নতুন সিনেমা গুণিন মুক্তি পেয়েছে এ সপ্তাহে। ঢাকাসহ দেশের ২০টি সিনেমা হলে চলছে গুণিন। সিনেমাটির নির্মাণ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ পত্রিকার সঙ্গে। 

প্রশ্ন : আপনার বেশিরভাগ সিনেমায় গ্রাম, নদীসহ প্রকৃতির একটা দারুণ সম্পর্ক থাকে। এর কারণ কি? 

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : আমার জন্ম গ্রামে। ছোটবেলা কেটেছে ফেনীতে। গ্রামের নাম জাহানপুর। এটা ফেনী শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত ওখানেই কেটেছে। মানে বেড়ে উঠেছি আর কি। ওই সময় আমাদের গ্রামে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। একটা যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা। সব কাজিনরা মিলে দিনভর নানা কিছু করে বেড়াতাম। মজার ঘটনা হলো, আমাদের পরিবারের জীবনযাপন বা সংসারের জন্য যা যা দরকার, সবই আমাদের নিজেদের জোগাড় ছিল। হয়তো কেরোসিন তেল বা লবণটা বাজার থেকে কিনতে হতো। বাকিসব নিজেদের ক্ষেতে উৎপাদন হতো। কোনো জমিতে হয়তো পেঁয়াজ, কোথাও আদা, কোথাও ধান।


আমাদের বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল, যেখানে প্রচুর পদ্ম ফুল ফুটত। সেগুলো তোলা ছিল আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার ছোটবেলাটা একেবারেই গ্রামে কেটেছে। সিনেমায় এটার একটা প্রভাব তো পড়বেই।


প্রশ্ন : আপনার পড়াশোনা কি সেখানেই?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম: ক্লাস থ্রি পর্যন্ত জাহানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। তারপর ক্লাস ফোরে এসে ভর্তি হই ফেনী পাইলট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে; তারপর ফেনী পাইলট স্কুল ও কলেজ। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই মার্কেটিং বিভাগে। তখন আর পড়াশোনা কি, সারাক্ষণ নাটক নিয়ে পড়ে থাকতাম। একেবারে প্রাকটিক্যাল থিয়েটার চর্চা যাকে বলে, সেটাই করেছি।


প্রশ্ন : ওই সময় তো নাটক লেখালেখিও শুরু করেন?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : কৈশোরে কবিতা লিখতাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেশ কিছু পথনাটক লিখি। ওই সময় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর একটা অংশের নাট্যরূপ দিই। ওটা একটা দুঃসাহস ছিল। ওই সময় ঢাকা থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরও নাটকটি দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উনি বাসে যেতে পারবেন না; প্লেনে নিতে হবে। অত টাকা আমরা ওই সময় জোগাড় করতে পারিনি। পরে আর হয়নি।


প্রশ্ন : আপনি পড়াশোনো করেছেন মার্কেটিংয়ে। কিন্তু নির্মাণ করছেন চলচ্চিত্র। মার্কেটিং জগতে বিচরণ করতে না পারার জন্য দুঃখ হয় না?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : একেবারেই না। আমি এখন যে প্রফেশনে আছি, সেটা খুব উপভোগ করি। এখন যদি কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করতাম, হয়তো বড় কোনো পোস্টে কাজ করতাম; কিন্তু সেটা কেমন হতো, আমি জানি না। আমার ওই অভিজ্ঞতা নাই। আমি সেটা চাইও না। এবং এটার জন্য কোনো দুঃখবোধও নাই।


প্রশ্ন : জীবনে কখন কোন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, মিডিয়াতেই স্থায়ী হবেন?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : আমি যখন পড়াশোনো শেষ করে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসি, তখন সালাউদ্দিন লাভলু, মাসুম রেজা মিলে একটা অ্যাডফার্ম গড়ে তুলি। সেখানে কপি লিখতে লিখতে একটা অভিজ্ঞতা হয়। একদিন লাভলু ভাই বলেন, 'তোর তো লেখা ভালো, তুই টেলিভিশনের জন্য নাটক লেখা শুরু কর।' আমার প্রথম লেখা টিভি নাটক 'পৌনঃপুনিক'। পরিচালনা করেন কাওসার চৌধুরী। এটি প্রচারের পরপরই খুব আলোচনা শুরু হয়। বলতে পারেন, এক রাতের মধ্যে আমি তারকা নাট্যকারে পরিণত হই। তখনই আসলে সিদ্ধান্ত নেই চাকরি-বাকরি নয়, মিডিয়াতেই স্থায়ী হবো


প্রশ্ন : সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত গুণিনের পথচলা কেমন ছিল?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : গুণিন সম্পর্কে বলতে গেলে সবার আগে আসবে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হাসান আজিজুল হক স্যারের কথা। আমার মনটা একটু খারাপ। যার গল্প থেকে গুণিন সিনেমাটি করেছি তিনি আমাদের মাঝে নেই। সিনেমাটা দেখে যেতে পারলেন না। নভেল করোনাভাইরাস প্রথম যখন আসে তখন গুণিন গল্পটা আমার পছন্দ হলো। মনে হলো এটা দিয়ে কিছু করা সম্ভব। পাঁচ-ছয় পাতার গল্প তো, তখন ভেবেছিলাম ছোট সিনেমা বানাব। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এল। তখন মনে হলো গল্পটা দিয়ে ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম বানানো যায়। গুল্পটা শুনে চরকি এগিয়ে এল। তার পরই গুণিনের কাজ শুরু।


প্রশ্ন : গুণিন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কেমন? 

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : আমার মনে হয় দর্শক যদি হলে যায় এবং সিনেমাটা দেখে, তারা পছন্দ করবে। তারা বিনোদিত হবে।


প্রশ্ন : গুণিনে পরীমণির অভিনয় কেমন লেগেছে?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : পরীমনি আমার স্বপ্নজালে অভিনয় করেছে। গুণিনে অভিনয় দেখে মনে হয়েছে, পরীমণি যে অভিনয়টা আরো ১০ বছর পরে করত সেটা সে গুণিনে করেছে। শুধু পরীমণি না, অন্য যে শিল্পীরা আছে, তারা সবাই নিজের সেরাটা দিয়েছে। আসলে সিনেমায় তিনজন ভালো অভিনয় করল অথচ একজন খারাপ অভিনয় করল, এমন হলে আর সিনেমা থাকে না। দর্শকের মনোযোগ ছুটে যায়। সেই সিনেমা দেখা যায় না। কিন্তু গুণিনে ছোট চরিত্র থেকে শুরু করে বড় যত চরিত্র আছে, প্রত্যেকেই ঠিকঠাক অভিনয় করেছে।


প্রশ্ন : রাজ-পরীর রসায়ন কেমন ছিল? তারা কি বাংলা সিনেমার পরবর্তী জুটি হতে যাচ্ছে?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : আমি ব্যক্তিগতভাবে জুটিতে বিশ্বাস করি না। আমার যত সিনেমা আছে কোনোটাই জুটিনির্ভর না। মনপুরায় চঞ্চল চৌধুরীর বিপরীতে ছিল মিলি। স্বপ্নজালে রোশানের বিপরীতে পরীমণি। গুণিনে রাজের বিপরীতে পরীমণি। কোনোটাতেই জুটি ধরে কাজ করিনি আমি। ফলে জুটি নিয়ে আমি বলতে পারব না। যারা জুটি নিয়ে চিন্তা করে তারা ভালো বলতে পারবে।


প্রশ্ন : গুণিনে কাজ করতে গিয়ে রাজ-পরীর পরিচয় ও বিয়ে। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : গুণিন একটা উপলক্ষ। কাজটা করতে গিয়ে নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের প্রেমে পড়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। দুজনেই আমার পরিচিত। তাদের প্রতি শুভ কামনা ছাড়া আর কী থাকবে?


প্রশ্ন : গুণিনের ‘ঘোমটা খুলে’ গানটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কোন ভাবনা থেকে ধামাইল গান ব্যবহার করলেন?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : তেমন কোনো ভাবনা থেকে নয়। আমি চেষ্টা করেছি গল্পের সঙ্গে যায় এমন একটা অরিজিনাল গান, বাংলা গান, পূর্ব বাংলার গান ব্যবহার করতে।


প্রশ্ন : গ্রামীণ অনেক অনুষঙ্গ সিনেমায় উঠে এসেছে?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : হ্যাঁ, বিয়ের গীত আছে। পালকির গান আছে। আসলে যেটুকু গল্পের জন্য দরকার সেটুকু ব্যবহার করা হয়েছে।


প্রশ্ন : গুণিনে কী আছে?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : গুণিন হচ্ছে আমাদের আদিম গ্রাম সমাজের চিত্র। যেখানে আছে লোভ, লালসা, প্রেম, হিংসা...এসব। যা যা মানুষের থাকে আর কী।


প্রশ্ন : হাসান আজিজুল হকের গুণিন আর গিয়াস উদ্দিন সেলিমের গুণিনে পার্থক্য আছে?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : গুণিন গল্পটা খুবই ছোট। এত ছোট গল্প দিয়ে সিনেমা বানানো কঠিন। এজন্য মূল গল্পের সঙ্গে সংগতি রেখে কিছু অনুষঙ্গ যোগ করেছি। আমার ধারণা হাসান স্যার এগুলো দেখলে খুশিই হতেন।


প্রশ্ন : পুরস্কার না দর্শকপ্রিয়তা, কোনটা মাথায় রেখে গুণিন নির্মাণ?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : আমি পুরস্কারের জন্য ছবি বানাই না। দর্শকের জন্য বানাই। দর্শক পছন্দ করলে সেটাই আমার সব। দর্শকের ভালোবাসাই আমার অস্কার।


প্রশ্ন : ওটিটি প্লাটফর্মগুলো কি সিনেমা হলের জন্য হুমকি?

গিয়াস উদ্দিন সেলিম : অবশ্যই না। কনসার্টের গান আর রেকর্ড গান, দুইটা কি এক জিনিস? না। একইভাবে সিনেমা সিনেমার জায়গায়, ওটিটি ওটিটির জায়গায়।

শেয়ার করুন