চলতি মধ্যবর্তী নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হলেও এবারের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলোচনা বেশ কঠিন। তবে সাধারণভাবে যেসব ফলাফল আলোচনায় উঠে আসছে, তাতে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট ও জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১০০টির মধ্যে ৩৫টি সিনেট আসনের নির্বাচনে ডেমোক্রেট সামান্যতম এগিয়ে রয়েছে, যদিও তা আগের মতোই সমান সমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ রয়ে গেছে। অন্যদিকে হাউজে এবার বরাবরই রিপাবলিকানরা ফেভারিট আর গভর্নর পদে ৩৬টি আসনে যে নির্বাচন হচ্ছে, তাতে এখন ডেমোক্রেটদের নিশ্চিত আসন নিউইয়র্কই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রিপাবলিকান জিলদান ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে অর্থনৈতিক মন্দাই ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্র রক্ষার স্লোগান কিংবা রো বনাম ওয়েড অর্থাৎ গর্ভপাত বাতিলের বিরুদ্ধে স্লোগান, ২০২০ সালের ভোট ডিনায়েল বা নির্বাচনকে অশ্রদ্ধা করার রিপাবলিকান পাঁয়তারা তেমন কিছু কাজ করছে না। গ্যাসের মূল্য যেন মানুষের মনের ব্যারোমিটার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিনেটের হালহকিকত
সিনেট যদিও ডেমোক্রেটদের হাতে রয়েছে এবং ডেমোক্রেটরা কিছুটা এগিয়ে আছে। তাতে দেখা যায় যেদল নেভাদা, জর্জিয়া ও পেনসিলভানিয়ায় তিনটি স্টেটের মধ্যে দুটি স্টেটে সিনেট আসন জয় করবে তারাই সিনেট নিয়ন্ত্রণ করবে। রিপাবলিকানদের সিনেট নিয়ন্ত্রণে দরকার ৫১ আসন আর ডেমোক্রেটদের ৫০ আসন। রিপাবলিকানরা নেভাদা ও জর্জিয়ায় সিনেট আসনে জোর সম্ভাবনা রয়েছে। ডেমোক্রেটরা আশা করছে, তারা পেনসিলভানিয়ায় জিতবে। কিন্তু নেভাদাতে রিপাবলিকানরা এগিয়ে থাকলেও জর্জিয়ার হারসেল ওয়াকারের স্ক্যান্ডেলের কারণে ওয়ারনকের বিরুদ্ধে তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জরিপে তার গ্যাপ শুরুতে ডাবল ডিজিট থাকলেও এখন তা ১ শতাংশের ব্যবধানে কমে এসেছে। এমনও হতে পারে ওয়ারনকের বিরুদ্ধে হারসেল জিতেও যেতে পারে। তাহলেই নেভাদাকে নিয়ে রিপাবলিকানরা সিনেট দখল করে নেবে। একসময় পেনসিলভানিয়ায় ডেমোক্রেট ফ্রেটারম্যান এর সাথে তুর্কি রিপাবলিকান মেহমুদ ওজের ব্যবধান ছিল ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি। এখন তা ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে কমে এসেছে। ওজ যদি জিতে যান, তাহলে রিপাবলিকানরা সিনেটও দখল করে নেবে অনায়াসেই।
অ্যারিজোনা ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে বর্তমান ডেমোক্রেটরা সুবিধাজনক স্থানে আছে। সিনেট রেসে নর্থ ক্যারোলিনা ওহাইও ও উইনসকনসিনে রেস কাছাকাছি হলেও ধারণা হচ্ছে রিপাবলিকানদের ঘরেই পড়বে জয়ের টিকচিহ্ন। তারপর ফলাফলের সম্ভাবনা হচ্ছে ডেমোক্রেটরা দুটি স্বতন্ত্র সিনেটরসহ ৪৭ থেকে ৫৩ আসন পেতে পারতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বর্তমানে ৫০-৫০ এর মধ্যে নেমে এসেছে। তবে তাতেও আগামী ২ বছরের জন্য অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত সিনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে নিয়ে ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে বলে সম্ভাবনা। বর্তমানে জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, কলারোডা, ওয়াশিংটন, ইলিনর, ওরিগন, নিউইয়র্ক (চাক শুমার) ভারমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া, ম্যারিল্যান্ড ও হাওয়াই এ ডেমোক্রেটরা এগিয়ে আছে। অন্যদিকে উইনসকনসিন, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও, ফ্লোরিডা, ইন্ডিয়ানা, আরকানসাস, সাউথ ডেকোটা, আলাস্কাতে রিপাবলিকানরা এগিয়ে আছে। অন্যান্য নির্বাচনী স্টেটগুলো টস আপ।
হাউজের নির্বাচনে সম্ভাবনা
এখন ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন মনে করেন, হাউজের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্রেটদের থেকে রিপাবলিকানদের হাতে চলে যাবে। যখন রো বনাম ওয়েড সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করলেন, তখন ধারণা করা হয়েছিল ৪৩৫ আসনে ডেমোক্রেটরা সংখ্যাধিক্য বজায় রাখবে। কিন্তু পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাকে উসকে দিয়ে রিপাবলিকানরা তাদের অগ্রগতি চালিয়ে যায়। তাতে দেখা যায়, ৪ পঞ্চমাংশ লোক মনে করেন, রিপাবলিকানরা হাউজ দখলে নেবে। এখন ৮০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে রিপাবলিকানরা ২১৩ থেকে ২৪৬ আসন লাভ করবেন।
রিপাবলিকানরা যদি পপুলার ভোট ০.৭ পয়েন্ট বেশি পায়, তাহলে তারা সংখ্যাধিক্য আসন পাবে হাউজে। এখন গড়ে রিপাবলিকানরা নিয়ন্ত্রণ করে ২২৯ আসন আর ডেমোক্রেটরা নিয়ন্ত্রণ করে ২০৬ আসন। এখানে ডেমোক্রেটরা মাইনরিটি। অর্থাৎ ৪৩৫ আসনে ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ২৩ আসন কম। হাউজে মেজরিটি পেতে তাই ডেমোক্রেটদের রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত ২৩টি আসনের মধ্যে ১২টিতে জিততে হবে, যা এবার সম্ভব নাও হতে পারে। ৫৩৮ ফোরকাস্ট এবার বলেছে যে, হাউজে পেনসিলভানিয়ায় ৭, ভার্জিনিয়ায় ২, টেক্সাস ৩৪, অরিগন ৫, টেক্সাস ১৫, আরকানসাসের সবক’টি, নিউইয়র্কের ১৯, ক্যালিফোর্নিয়ার ২২, মিশিগানের ৩, রোড আইল্যান্ডের ২, পেনসিলভানিয়ার ১৭, আইওয়ার ৩, অ্যারিজোনার ২, মেইনের ২, কানেকটিকাটের ৫, নিউইয়র্কের ১৭, নিউ মেক্সিকোর ২, নেভাদার ৩, ম্যারিল্যান্ডের ৬, ক্যালিফোর্নিয়ার ১৩, ভার্জিনিয়ার ৭, নিউজার্সির ৭, অরিগনের ৬, নিউইয়র্কের ১৮, মিনেসোটার ২, মিশিগানের ৭, নর্থ ক্যারোলিনার ১৩, নিউইয়র্কের ২২, নেভাদার ১, ইলিনয়ের ৬, নিউইয়র্কের ৩, নিউ হ্যাম্পশায়ার ১, ওহাইওর ৯, মিশিগানের ১০, মিশিগানের ৮, ওয়াশিংটনের ৮, ওহাইওর ১ কানসাসের ৩, নেভাদার ৪, নিউইয়র্কের ১, ইলিনয়ের ১৪, নিউইয়র্কের ৪, উইনসকনসিনের ৩, ক্যালিফোর্নিয়ার ৪৮ নির্বাচনী এলাকায় জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নিউইয়র্কে সর্বোচ্চ ৭ নির্বাচনী এলাকায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এই স্টেটে এবার তা সকল স্টেটের চাইতে বেশি। এখানে গভর্নর নিয়ে ডেমোক্রেটদের চিন্তা করার কথা ছিল না, কিন্তু এবার সে ক্ষেত্রেও তা-ব নির্বাচন হতে পারে।
গভর্নর পদে নির্বাচন
কয়েকটি রাজ্যে গভর্নর পদে হাতবদল হতে পারে। তাতে সেসব রাজ্যে পলিসি মেকিংয়ে পরিবর্তন আসতে পারে। ম্যাসাচুসেটস ও ম্যারিল্যান্ড অবশ্যই রিপাবলিকান থেকে ডেমোক্রেটদের হাতে যাবে। আর রিপাবলিকানরা নেভাদা, উইনসকনসিন পেতে পারে। তাছাড়া ত্রিমুখী লড়াইয়ের কারণে অরিগনও তাদের হাতে যেতে পারে। আবার অধিকাংশ স্টেট যদিও গভর্নর ও সিনেট একই দল থেকে নির্বাচিত হতে পারে। তারপরও দেখা যায়, কতিপয় স্টেটে তার ব্যত্যয়ও ঘটতে পারে। যেমন- কানসাস স্টেটে তা দুই দলে ভাগ হতে পারে এবং অ্যারিজোনাতে তা দুই দলে বিভক্ত হতে পারে। তবে ডেমোক্রেটরা আশা করছে সিনেট ও গভর্নর দুটিই তারা পাবে। মিশিগানে ডেমোক্রেটিক গভর্নর গ্রেটচেন হুইটমার অনায়াসে বলা চলে ফেভারিট। পেনসিলভানিয়াতে ডেমোক্রেট হোশ শাপিবো ও রিপাবলিকান ডগ মাসট্রিআনোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশ জমে উঠছে।
রিপাবলিকানদের পক্ষে বর্তমান জর্জিয়া গভর্নর ব্রাইয়ান কেম্প ও ফ্লোরিডা গভর্নর রন ডিসান্টি উভয়েই জিততে পারে। টেক্সাসে বেট ও রকি কি যথেষ্ট আলোচিত হলেও রিপাবলিকান গভর্নর গ্রেগ এবোট জিতে যেতে পারে। নিউইয়র্কে হঠাৎ করে হোকুলের নিশ্চিত অবস্থানকে রিপাবলিকান জিলদান কিছুটা কাঁপিয়ে দিয়েছে। তবে শেষমেশ ডেমোক্রেটপ্রাপ্তি হোকুল জিতলেও ভোটের মার্জিন অনেকটা কমে আসবে। অরিগনে উভয় দলের সমান সমান সম্ভাবনা, নেভাদার রিপাবলিকান উইনসকনসিনে ডেমোক্রেট, অ্যারিজোনায় রিপাবলিকান জিতার সম্ভাবনা। তাছাড়া কানসাসে, নিউ মেক্সিকোতে, মিশিগানে, মেইনে, মিনেসোটায়, পেনসিলভানিয়ায়, নিউইয়র্কে, কানেকটিকাটে, রোড আইল্যান্ডে, কলারোডাতে, ইলিনয়ে, ক্যালিফোর্নিয়ায় জিতবে। অন্যদিকে জর্জিয়া, ওকলাহামা, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, সাউথ ক্যালোলিনা, আরকানসাস, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, আইওয়া, টেনেসি, সালাবামা, আইডাহো ও ওয়ামিং রিপাবলিকান জেতার সম্ভাবনা। ভায়মন্টে সমান সমান চান্স উভয় দলের।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন স্টেট আইনসভা
২০২২ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হবে বিভিন্ন রাজ্যের আইনসভা, বস্তুত হোয়াইট হাউস একদিকে ও কংগ্রেস অপরদিকে গেলে ফেডারেল গভর্নমেন্টের জন্য আইন পাস করা কঠিন হয়ে পড়বে আর সে ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউস দখলে রেখে ডেমোক্রেটরা তেমন কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারবে না। বাইডেনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া গর্ভপাত বন্ধ করে এক কার্যকর আইন পাস করেছে। গত জুলাই মাসে ক্যালিফোর্নিয়া অবৈধ ফায়ার আর্মস তৈরি ও বিক্রি বন্ধ করতে গান বণিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার দিয়ে আইন পাস করা হয়েছে। ২০২১ সালে জর্জিয়া, ফ্লোরিডা ও টেক্সাস ভোটার ফ্রডের বিরুদ্ধে তাদের ভোটিং আইন কঠোর করেছে। একই সময়ে ইলিনয় প্রথম স্টেট যারা ক্যাশ বেইল দেয়া বন্ধ করেছে।
এসব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে, যেহেতু একই দলের গভর্নর ও আইনপ্রণেতারা রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন। স্টেট সিনেট, স্টেট হাউস ও গভর্নর একই দলের ছিলেন। যখন কোনো দলের এই তিন শাখা নিয়ন্ত্রণে থাকে অথবা আইনপ্রণেতাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন তারা যে কোনো আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে পারে।
বর্তমানে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ৮৮টি স্টেট আইন প্রণয়ন সংস্থা বা রাজ্য আইন সভা ও ৩৬ জন গভর্নর নির্বাচিত হবে। অনেক রাজ্যে গভর্নর স্টেট সিনেট ও স্টেট হাউস ভিন্ন ভিন্ন পার্টি থেকে নির্বাচিত। আলাস্কায় স্টেট হাউস, ডেমোক্রেট, স্বতন্ত্র ও মডারেট রিপাবলিকানদের কোয়ালিশনে নিয়ন্ত্রিত। অনেক ক্ষেত্রে কোনো দলের ভেটো প্রুপ মেজরিটি থাকায় সে দল স্টেট আইনি সংস্থায় কর্তৃত্ব করে। নেব্রাস্কায় একটি আইনি চেম্বার মাত্র। দেখতে বা খাতা-কলমে তা দল নিরপেক্ষ হলেও চর্চায় তারা রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী এলাকায় পূর্ণ সীমানা নির্ধারণের কারণে স্টেট আইনসভা প্রতিযোগিতাপূর্ণ হলেও সেখানে অন্তত ১০টি স্টেট রয়েছে, যেখানে একদল সর্বময় ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারে। অন্তত ৮টি স্টেট রয়েছে যেখানে একটি দল পুরো নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। কাজেই নভেম্বরের ব্যালটে এমন প্রতিযোগিতা হবে যাতে রাজ্য পলিসি নিয়ন্ত্রণ করবে।
দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে নেভাদা, মেইন, অরিগন, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও মিনেসোটা এই ৬টি স্টেট সম্পূর্ণ ডেমোক্রেট, রিপাবলিকান অথবা বিভক্ত সরকারে পরিণত হতে পারে স্টেট আইনসভার কারণে।
রিপাবলিকানরা আলাস্কা (যদি ডেমোক্রেটদের সাথে কোয়ালিশন না হয়), নর্থ ক্যারোলিনা, উইনসকনসিন, সম্পূর্ণ দখলে নিতে পারে। অন্যদিকে ভারমন্টে (রিপাবরিকান গভর্নর নির্বাচিত হলেও) ডেমোক্রেটরা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। নিউ মেক্সিকো ও কলরাডোতে রিপাবলিকানরা ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে পারে। অ্যারিজোনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, কানসাসে ডেমোক্রেটরা রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে পারে। তবে অনেক জরিপের ফোরকাস্ট হচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসিতে এবার বিভক্ত সরকার হবে। দুটি চেম্বারের অন্তত একটি রিপাবলিকানরা দখল করবে। আর হোয়াইট হাউস থাকবে ডেমোক্রেটদের দখলে। সে কারণে রাজ্যের আইনসভাসমূহ ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনায় অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে বাধ্য হবে।