১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৭:৪৩:১০ অপরাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১১-২০২২
কথার কথকতা


‘আঁই কিত্তাম’? বঙ্গানুবাদ হলো, আমি কি করবো? ইংরেজি অনুবাদ হলো, হোয়াট শুড আই ডু নাউ? ম্যায় কেয়া কারুঙ্গা- হচ্ছে এর আরেক ভাষার অনুবাদ। আঁই কিত্তাম- দুই শব্দ সংবলিত এই বাক্যটি বাংলাদেশের একটি অঞ্চলের ভাষা- আঞ্চলিক ভাষা। আমার বিশ্বাস, এ কথা সবাই জানেন। আঁই অর্থ হলো আমি, যেটা আনুনাসিকতা বাদ দিয়ে ইংরেজি ভাষাতেও আমি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিত্তাম শব্দটা দুটো আঞ্চলিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, শব্দ দুটো হচ্ছে- ‘কি করতাম’। কি করতাম শব্দ দুটো মিলে মিশে ‘কিত্তাম’ রূপ লাভ করতে কতো শতাব্দী সময় লেগেছে তার কোনো বর্ণনা কোনো বইতে পাওয়া যায়নি। তবে ভাষাতত্ত্ব পড়বার সময় আমি শুদ্ধ বাংলা ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক বাংলা নিয়ে গবেষণা করে দেখেছি, পাঁচ মিনিটে শুদ্ধ বাংলা যতোটুকু সংসাধন করা যায়, আঞ্চলিক ভাষাটি ওই সময়ের মধ্যে তার তিনগুণেরও বেশি বলা যায়। অবশ্য হিন্দি সিনেমা এবং মানুষের বিদেশ যাতায়াতের কারণে আঞ্চলিক ভাষাগুলো স্বকীয়তা হারিয়েছে। প্রবীণ মানুষেরা মরে যাওয়াও এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যাকগে ওই প্রসঙ্গ। আঁই কিত্তাম কথাটা দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি যেভাবে প্রকাশিত হয়, সাথে দেয়া অনুবাদগুলো ওটা অতো নিবিড় করে প্রকাশ করতে পারে না। আমরা এ মর্মে কিছু পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেছি যেগুলো এখন গল্পচ্ছলে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।

অনেক আগের কথা, কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর আগের। এমএ ক্লাসের এক ছাত্র এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে ঢোকার মুখেই একজন শিক্ষক তাকে প্রশ্ন করলেন, আসতে দেরি হলো যে? এই শিক্ষক ক্লাসরুমে ঢুকছিলেন, তিনি ওই ক্লাসটি নেবেন। ছাত্রটি বললো, স্যার আরেকটা ক্লাস এই মাত্র শেষ হলো। দরজায় দ-ায়মান শিক্ষক তাকে খুব তিরস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, ‘ক্লাস’ শব্দটি উচ্চারণ হয়নি। এটি এই রকম হবে, বলে তিনি শব্দটি উচ্চারণ করলেন, কিন্তু ছাত্রটি বুঝতেই পারেনি স্যার ক্লাশ, ক্লাস, ক্লাচ, ক্লাছ নাকি ক্ল্যাশ বলেছেন। ছাত্রটি তখন মনে করার চেষ্টা করলো, সে প্রাইমারি বা হাইস্কুল, কলেজ, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র? সে মনে মনে উচ্চারণ করলো: ‘আঁই কিত্তাম?’ শিক্ষক সাহেব তাকে ধমকের গলায় প্রশ্ন করলেন: তুমি কি কিছু বলেছো? জ্বি না স্যার, বলে ক্লাসরুমে ঢুকলো বিস্ময়ের ঘোরে। এরকম অনেক কারণেই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক মান হারিয়ে বসে আছে!

‘আঁই কিত্তাম’ জাতীয় পরিস্থিতি বর্তমানে সমাজের সর্বস্তরে হরেক রকম রূপ লাভ করে বিস্তৃত হচ্ছে। এরকম তিনটি ঘটনা বলতে চাইলো আমাদের এক বন্ধু। আমি তার কথা শুনতে রাজি হয়ে গেলাম। ভাবলাম, লেখার একটা বিষয়বস্তু পেয়ে যাবো।

বন্ধুটি বললো, বিভিন্ন সময়ে সে তিনটা ‘আঁই কিত্তাম’ বলার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, যেগুলো ছোট্ট কিন্তু মারাত্মক। ‘ও মাই গড’, বন্ধুটি এসব কি বললো? শুনে তো আমার মুখ দিয়েই বেরিয়ে গেলো: ‘আঁই কিত্তাম?’

বাংলা সাহিত্যে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এক কবি, এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে যোগদান করেছেন। তিনি খুব গর্বিত এবং ভারিক্কি গলায় বক্তব্য রাখছিলেন। প্রবীণ মানুষ, আবার অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, তাই সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আলোচনার বিষয়বস্তু এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বললেন: তার উচ্চারিত প্রতিটি ‘ওক্ষোর’ ছিলো সাহসী প্রকাশ। ‘অক্ষর’ শব্দটি এক প-িতন্মণ্য ব্যক্তির মুখে ‘ওক্ষোর’ উচ্চারণ শুনে আমার বন্ধুটি আর অনুষ্ঠানে টিকতে পারেনি, বেরিয়ে হন হন করে বাসার দিকে রওয়ানা দিয়েছে।

আরো দুটো অনুষ্ঠান আমাদের এই সচেতন বন্ধুর মনে কষ্ট দিয়েছে, আমরা খুব সংক্ষেপেই বলবো।

একজন নামকরা ও সুদর্শন এবং জনপ্রিয় কবির একক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান, বন্ধুদের অনুরোধে আমার বন্ধুটিও শ্রোতা। একপর্যায়ে কবি সাহেব ‘অস্পষ্ট’ শব্দটিকে উচ্চারণ করলেন ‘অয়স্পষ্ট’। এটা শুনে বজ্রাহতের মতো স্থির হয়ে গেলো আমার বন্ধুটি। এরপর কখন যে সে অনুষ্ঠান থেকে বাইরে চলে এলো তা নিজেও বুঝতে পারেনি।

আরেক অনুষ্ঠান ছিলো একটা মিটিং। সমমনা ও পরিচিত মানুষদের মিটিং, একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পুরস্কারপ্রাপ্ত এক আবৃত্তিকার বক্তব্য রাখার সময় ‘নির্দিষ্ট’ শব্দটাকে খুবই বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ‘নিদ্রিষ্ট’। ওরে আমার বন্ধু, ও তো পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা, কিন্তু বেরোতেও পারছে না।

আমাকে বললো, তোরা আমাকে আর কোনো অনুষ্ঠানে থাকতে বলিস না। আমি বললাম: ‘আঁই কিত্তাম?’

আর মাত্র একটা ঘটনার কথা বলবো আজ। এক পত্রিকার প্রকাশক আমার পরিচিত। ওনাকে ঘিরে একটা ঘটনা, যা বর্ণনা করতে কিছুটা গল্পের মিশ্রণ ঘটাতে হবে, আশা করি আপনারা মাইন্ড করবেন না। তিনি তাঁর পত্রিকায় কবিতা ছাপার ব্যাপারে কখনো আগ্রহী ছিলেন না। কবিতার চেয়ে কবিদের প্রতি তাঁর রয়েছে অনেক অভিযোগ ও বিরক্তি। তার মন্তব্য হলো: কী লেখে, এগুলো কি কিছু হয়? তারপরও সময়ের দাবি ইত্যাদি বলে ওনাকে দিয়ে কবিতা ছাপাতে সক্ষম হলাম। কবিগণ খুশি। একদিন ফোন করে বললেন: ওনার এক প্রভাবশালী বন্ধু চার লাইন কবিতা লিখে ওনাকে পাঠিয়ে বলেছেন, ওটা একটা হেডিং দিয়ে কবির আকর্ষণীয় একটা ছবি দিয়ে ছাপতে হবে, না হলে খবর আছে। কিন্তু প্রকাশক সাহেব কবিতাটার অর্থ বুঝতে পারছেন না। তাই তিনি ঠিক করেছেন, এই কবিতাকে কেন্দ্র করে এক বহুমুখী পরীক্ষা চালাবেন। অর্থ খরচ হলেও তিনি এর একটা শেষ দেখতে চান। তিনি আমাকে একটা তারিখ জানিয়ে বললেন, ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটবে, আসবেন, মিস করবেন না।

সঠিক তারিখে এবং সঠিক সময়ে আমি গেলাম, দেখলাম, বেশ কয়েকজন কবি হাজির হয়েছেন। প্রাথমিক চা পর্ব সারবার পর তিনি বললেন: আমরা আজ কবিতা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করবো, আপনাদের কাছ থেকে কাব্য বিষয়ে জ্ঞান নেবো। আপনারা অনুগ্রহ করে আমাকে সহযোগিতা করবেন। আপনারা আজ কবিতা আবৃত্তি করলে সেগুলো পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হবে। আজ বিদায়ের প্রাক্কালে আমরা একত্রে একটু ডালভাত খাবো। পরিকল্পনাটি কেমন? সবাই একমত হলো যে, ভাবনাটি চমৎকার।

বললেন, তাহলে আমরা শুরু করি। তিনি চার লাইন কবিতা সবার হাতে দিলেন, বললেন: আপনাদের কবিতা শুনবো আর আপনারা প্রত্যেকে নিজের মতো করে এই ছোট্ট কবিতাটির একটা হেডিং দেবেন আর কবিতাটির মধ্য থেকে পাঠক কি পেতে পারে তা সংক্ষেপে লিখে দেবেন। আপনাদের শরণাপন্ন হবার কারণ হলো, এই চার লাইনের মধ্যে আমি কঠিন ও বাস্তব জীবনকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই আপনাদের শরণাপন্ন হলাম। 

যে চার লাইন কবিতা তিনি সবাইকে দিলেন তা হলো-

‘আকাশের বিশাল উদারতা দেখে

হৃদয়ে ফুটলো এক গোলাপ ফুল,

সেই থেকে মন শুধু খুঁজে বেড়ায়

কোন এক রূপসীর স্বপ্নে ভরা চুল!’

প্রিয় পাঠকবৃন্দ, অনুষ্ঠানের বিস্তারিত লিখতে গেলে আপনারা অধৈর্য হয়ে পড়বেন, তাই সংক্ষেপে বলি। হাসিমুখেই অনুষ্ঠান সমাপ্ত হলো। প্রকাশক সাহেব তিরিশ জন কবিকে ফোনে দাওয়াত দিয়েছিলেন, এসেছে মাত্র ছয়জন। রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে বিদায়ের কালে তিনি ছয়জন কবির হাতে ছয়টা খাম তুলে দিলেন। প্রতি খামে একশ ডলারের একটা করে নোট ছিলো। অনুরোধ করলেন, সবাই চলে গেলেও আমি যেন থাকি। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে এক প্রশান্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন: কি বুঝলেন? তিরিশ জনকে ইনভাইট করেছিলাম, এসেছে ছয়জন। যারা আসেনি তারা বুঝুক। 

সব শেষে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন ওই চার লাইন কবিতা পড়তে। বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলেন ওই চার লাইন কবিতার মধ্যে জগত, জীবন ও সংসারের জন্য কোনো বস্তু আছে কিনা তা দেখানোর জন্য। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আপনারাই বলুন, এই অবস্থায় এখন ‘আঁই কিত্তাম?’

শেয়ার করুন