১৬ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ০২:২৮:০৩ অপরাহ্ন


বিএনপির কৌশলে ধরাশায়ী আ.লীগ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১১-২০২২
বিএনপির কৌশলে ধরাশায়ী আ.লীগ


টানা তিনটার্ম ক্ষমতায় থেকে যে উন্নয়ন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তার প্রচার প্রচরণাটা দলের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সেভাবে হচ্ছে না। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দলটি দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এ ধারাবাহিকতায় থাকতে জনগণকে আবারো ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে উদ্বুদ্ধ করতে দলের নেতাদের মুখ্য ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে আওয়ামী লীগের এ টানা তিন টার্মের উন্নতিতে দেশের যোগাযোগ খাত থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য স্থানে অভূতপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু সে প্রচারটা হচ্ছে না এখন সেভাবে। খোদ আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্ব একধরনের ঝিম ধরে যাওয়া অবস্থা। এ ব্যাপারগুলোতে মুখে কুলুপ এটে অনেকেই। নড়ছেন না। কথা বলছেন না। অনেক আগ থেকেই তৃণমূলের বহু নেতা, সংসদ সদস্য রাজধানী বা কেউ বেশিরভাগ সময় বিদেশে সময় কাটাচ্ছেন প্রয়োজন অপ্রয়োজনে। কিন্তু দল ও দেশের স্বার্থে তাদের মাঠে থাকা বাঞ্ছনীয় যখন তারা নেই। 

সংসদে ২০১৪ ও ২০১৮ সনে সিংহভাগ আসনে জয়ী আওয়ামী লীগ। ২০০৮ এ ও একই অবস্থা। তাহলে তিন টার্মে যারা বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন তারা যদি নিজস্ব উদ্যোগে টেলিভিশন, ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল, টুইটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও মাঠপর্যায়ে তথা, নিজস্ব নির্বাচনী এলাকায় থেকে প্রতিটা গ্রাম, ওয়ার্ডে সভা, সম্মেলন করে প্রচারকার্য চালিয়ে যান তাহলে আওয়ামী লীগের তো পিছিয়ে যাবার কথা না। বরং প্রশাসনে তারা। প্রশাসনের সব সহায়তা তারা পাচ্ছেন। আছে পুলিশ প্রোটেকশন। তৃণমূলের ছাত্র লীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সংগঠনও খুবই শক্তিশালী। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো আওয়ামী লীগ বা যুবলীগ বা ছাত্রলীগ নেতা মুহূর্তে ফোন করে পুলিশের সহায়তা পেতে পারেন। থানাগুলো সে সহায়তা প্রদান করেও আসছে। এতোটা অ্যাডভান্টেজ থাকা সত্ত্বেও কেন তারা নীরব? এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। 

বিশেষ করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেয়া তথ্য মোতাবেক বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ লাখের ওপর মামলা। সেখানে তারা তো অনেকটা চুপিসারে, নীরব নিস্তব্দে। মাঠে প্রতিপক্ষ নেই। তাহলে আওয়ামী লীগ কেন মাঠে নেই। কেন তারা তিন টার্মের উন্নয়নগুলোর খুঁটিনাটি মানুষকে জানান দেয়া ও তাদের কাছাকাছি থেকে বোঝানো থেকে দূরে রয়েছেন।

বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও ভালো ঠেকেনি। ক’দিন আগেও তিনি দলের নির্বাহী কমিটির এক সভাতে বলেছেন, সর্বস্তরের জনগণের কাছে উন্নয়নের প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বোঝাতে হবে মানুষকে। তাদের কাছাকাছি যেতে হবে। কিন্তু তারপরও সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাদের ওই রকম প্রচার প্রচারণায় তেমন একটা নামতে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই নেতাদের জনগণের কাছাকাছি যেতে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। দলের কার্যক্রম। সরকারের কার্যক্রম প্রচার করতে বলেছেন। সরকারের মেগা প্রজেক্টসমূহের মধ্যে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর ছাড়াও বড় বড় অনেকগুলো সেতুর কাজ সম্পন্ন করে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছেন ঘরে ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কাজ সম্পন্ন করেছেন। মেট্রোরেল। উড়ালসেতু বিভিন্ন প্রজেক্ট শেষের পথে। এছাড়াও করোনা মহামারী অত্যান্ত দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করাও একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ করার স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু এতোকিছুর পরও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্রাইসিসের ছোঁয়া অন্যদেশের মতো যখন বাংলাদেশেও লেগেছে এর সব দায়ভার এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর। মানুষকে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বোঝানোর কেউ নেই। 

পক্ষান্তরে সরকারবিরোধী দলগুলো বৈশ্বিক (ইউক্রেন রাশিয়া) ক্রাইসিসের ছোঁয়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি সংকটে লোডশেডিং থেকে শুরু করে যে ক্রাইসিস এগুলো সরকারবিরোধী প্রচারণায় হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে ব্যাপক সফলতা দেখাচ্ছে। জনগণকে বুঝিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে ফেলছে। বিরোধীদলের এমন কৌশলের কাছে রীতিমতো মার খাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। 

রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। কোনো হরতাল নেই। নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। যাতে করে ফরিদপুরের মতো আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতেও বিশাল জনসমুদ্র বানিয়েছে তাদের বিভাগীয় জনসমাবেশকে। ওই সমাবেশে দূরদূরান্ত থেকে মানুষের উপস্থিতি বিশেষ করে সকল ধরনের যানবাহন দু’দিন আগ থেকে বন্ধ করে দেয়া সত্ত্বেও। ৭০ বছর বয়সের ক’জন বৃদ্ধা এসেছিলেন জনসমাবেশে প্রায় ৬০ কিলোমিটার হেঁটে এমন খবরও সংবাদ মাধ্যমে ছবিসহ প্রচারিত হয়েছে। মানুষ কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে বিএনপির বিভাগীয় এ সমাবেশগুলোতে তার প্রমাণ মিলছে। 

ফলে বিএনপির এ সমাবেশ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগের। দলটির রিসার্চসেল যে ব্যর্থ তা স্পষ্ট। তারা অনুমানই করতে পারেনি বিএনপি কীভাবে নীরবে ধীরে সুস্থে বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজ দলের প্রচার প্রকাশনার দায়িত্বে থাকা নেতাকর্মীদের ওপর ভীষণ চটেছেন। তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে আমাদের উপস্থিতি একেবারেই দুর্বল। তাহলে এতো সদস্য নিয়ে কেন উপ-কমিটি করি। ফেসবুকে প্রতিনিয়ত, আমি তো দূরের কথা, আমাকে গালি দিক। কিন্তু শেখ হাসিনাকে নিয়ে অশ্রাব্য প্রপাগান্ডা চলছে বাংলাদেশে। অপপ্রচার চলছে। এগুলোর জবাব আপনারা দেবেন না এটা কেমন কথা। ফেসবুকে আপনাদের তো উপস্থিতি দেখি না। এর কাউন্টার করবে কে? কাউন্টার করতে তো দেখি না। এ মিথ্যাচারের, বিষোদগারের জবাব দিতে হবে। এ কাজটা নিষ্ঠার সাথে করার জন্য কমিটি করা হয়েছে। যারা পারবে না তাদের সরিয়ে দিতে হবে। ফেসবুক এখন সবাই বোঝে। কিন্তু কাউন্টার দেয়ার মতো মেধা থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘টকশোতে তো অনেকেই যায়, শুনিও, মাঝে মাঝে সময় পেলে কাউন্টারটা যথাযথ না হলে মুশকিল। টকশোতে কেউ কেউ আছে অন্যস্থান থেকে চৌকস কাউকে আমন্ত্রণ জানিয়ে, আমাদের এখান থেকে দুর্বল কাউকে আমন্ত্রণ জানায়। এটাও কিন্তু চতুরতার সাথে করা হয়। এ টেকনিক অনেকে অ্যাপ্লাই করছেন। আমি অনুরোধ করছি এগুলো করবেন না।’ তিনি কাভারেজটা আওয়ামী লীগ যতটুকু পাবে সেটুকু দেয়ার অনুরোধ করেন। 

এদিকে দেশের বর্তমান ক্রাইসিস মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলছেন, ২০২৩ সনে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে। সবাইকে কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে। উন্নত বিশ্বেও এখন টানাপড়েনের মধ্যে। বাংলাদেশেও এমনটা হতে পারে। সবাই সতর্ক হোন। এরপর তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সবাই সচেতন হলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসবে না। রিজার্ভ প্রসঙ্গে বলেছেন, দেশের টাকা দেশেই রয়েছে। রিজার্ভের অর্থ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে কাজে লেগেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন এ কথাগুলো সাধারণ মানুষদের কাছে ক্লিয়ারভাবে বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা কাদের। প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে তো সব স্থানে যেয়ে বলা সম্ভব না। তাহলে সংসদ সদস্য যারা রয়েছেন, যারা ভবিষ্যতে হবেন, তৃণমূলে যারা নেতা রয়েছেন তাদের কাজটা কী। তারা কেন এগুলো বলছেন না। এসব নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। 

এমনিতেই তৃণমূলে বিভিন্ন কারণে রয়েছে দ্বন্দ্ব। প্রধানমন্ত্রী বারবার দলের চরম ক্রাইসিস মুহূর্তে যে সকল নেতাকর্মীর ত্যাগ-তিতীক্ষা রয়েছে, তাদের খুঁজে বেড়ান, কিন্তু সেটা তিনি একাই। বিভিন্ন কারণে তরুণ বা বিভিন্ন প্রেক্ষাপট চিন্তা করে সংসদ সদস্য নমিনেশন দেয়া হয়েছে, পাস করেছেন। তারা এমন একটা গ্রুপ মেইনটেইন করে চলেছেন, যারা তাকে তোষামোদ করে এলাকার কাজগুলো করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কিন্তু সিনিয়র সিটিজেন যারা আওয়ামী লীগের পলিটিক্সের সঙ্গে সারাজীবন জড়িয়ে, তারা তো ওভাবে করতে পারবেন না। এতে করে এ ত্যাগীরা পেছনের সারিতে চলে গেছেন অভিমানে, ক্ষোভে। তাদের প্রতিও সম্মানবোধ ও খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। এ নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে তৃণমূলে। একইসঙ্গে এলাকার উন্নয়ন কাজে শরিক হওয়ার প্রতিযোগিতাতেও রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, এটা থাকবে। তবে দীর্ঘ তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকার জন্য এ পরিমাণটা একটু বেশিই। এতে করে সম্প্রতি কুমিল্লা ও সিলেটে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দু’পক্ষের মারামারিটা যেভাবে হয়েছে, এটা দলের জন্য অশনিসঙ্কেত। ধারণা করা হচ্ছে আগামী জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এ পাল্টাপাল্টিটা আরো বাড়বে। 

শীর্ষ পর্যায়ের দিকে তাকলেও দেখা যাবে দীর্ঘ মন্ত্রিসভার ক’জন প্রকাশ্যে কথা বলছেন। যারা বলে যাচ্ছেন তাদের মধ্যেও রয়েছে জাতীয় সম্মেলনে যে পদ লড়াই। বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রার্থী। তারাই কিছুটা নড়েচড়ে কথা বলছেন। অন্যদের সেভাবে চোখে পড়বে না, খুঁজেও পাওয়া যাবে না। অথচ তারা যথযথ দায়িত্বে রয়েছেন। সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। 

সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায়ই প্রকাশ্যে বলছেন, ‘কে কী করছেন। কে কী করেছেন, সেসব এসিআর শেখ হাসিনার কাছে রয়েছে। বেশি লম্ফঝম্প দিয়ে লাভ নেই। সময়মতো সবার আমলনামা দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।’

শেয়ার করুন