২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০৫:৩১:৩৫ অপরাহ্ন


রাজধানীতে বায়ুদূষণ, যানজট, জলজট, শব্দদূষণে অসহ্য যন্ত্রনা
বসবাসের অযোগ্য ঢাকা মহানগরীর মুক্তি কীসে?
খন্দকার সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৪-২০২২
বসবাসের অযোগ্য ঢাকা মহানগরীর মুক্তি কীসে? অসহ্য জানজট, বর্তমানে এটা এখন মহাসঙ্কট। গোটা রাজধানী যেন থেমে থাকে এমন দৃশ্যে : ছবি সংগৃহীত


বায়ুদূষণ, যানজট, জলজট, শব্দদূষণ, ডেঙ্গু এগুলো মহানগরী ঢাকায় বসবাসরত মানুষের নিত্যসঙ্গী। করোনার পর এখন মহানগরীর নবতম সংযোজন জলবাহিত ডায়রিয়া (অনেকে বলতেও পারেন কলেরা)। পবিত্র রমজান মাসে আবার যোগ হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট। দূষিত পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মহানগরবাসীর অনেকেই। একটি যুদ্ধজয়ী সংগ্রামী জাতির জীবনে- রাজধানী শহরের এতোা কলঙ্ক তিলক কিছুতেই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অথচ প্রতিদিনই ইলেকট্রনিক মিডিয়া বা প্রিন্ট মিডিয়ায় দেখবেন  মন্ত্রী এবং শাসকদলের পাতি নেতাদের আস্ফালন। তোতাপাখির বচন। কোথায় চলেছে ছায়া, সুনিবিড়, তিলোত্তমা আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী? এখনো কি সময় হয়নি। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মহানগরকে পতনশীল, পচনশীল, পতিত হবার পর্যায় থেকে উদ্ধারের জন্য জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের?

শেষ থেকেই শুরু করি। যান জটে স্থবির ঢাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পানি বাহিত ডায়রিয়া। চিকিৎসকবৃন্দ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সংক্রামক রোগটির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন ঢাকা ওয়াসা সরবরাহকৃত জলদূষণ এবং বাজারের নিম্নমানের খাবার। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা বাংলাদেশের সবচেয়ে উচ্চ বেতনধারী ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাছবিচার না করেই বলছেন, ওয়াসার জলে দূষণ নেই। দ্বিতীয় যে কারণটি চিহ্নিত, সেটির কারণ একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীর কা-জ্ঞানহীনতা। জনগণের একটি অংশ গ্যাস সংকটের কারণে এখন ঘরের উনোনে খাদ্য তৈরি করতে ব্যর্থ হয়ে বাজারের খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছে। ভেবে  দেখুন, কর্মজীবী- ঢাকাবাসী তীব্র যানজটের কারণে সড়কেই কাটাচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মূল্যবান লক্ষ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হবার অনুষঙ্গ বায়ুদূষণে নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা।  মহানগরীজুড়ে চলছে প্রয়োজনীয়-অপ্রোজনীয় তথাকথিত অপরিকল্পিত মেগা অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। বলা হচ্ছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট চালু হলে নাকি আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। যারা প্রতিদিন গাজীপুর বা টঙ্গী থেকে ঢাকা

রাস্তার দুরাবস্থার এমন চিত্র রাজধানী ঢাকার বহুস্থানেই : ছবি সংগৃহীত  


আসেন বা নিদেনপক্ষে উত্তরা থেকে ঢাকা শহরে আসেন, তাদের মুখে শুনবেন, মেগা প্রকল্পসমূহের মেগা জ্বালার কথা।  হয়তো জনগণের বিপুল অর্থ বিনিয়োগে বাস্তবায়নাধীন কিছু প্রকল্প- অনেক দুঃসহ যাতনার পর শেষ হয়ে কিছু মানুষকে কিছুদিনের জন্য স্বস্তি দিবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই অভিজ্ঞ নগরবিদদের বলতে শুনছি, বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই ডিটেইলড অ্যাকশন প্ল্যানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক? এ মুহূর্তে এসে এসব কথার যৌক্তিকতা কী?

ক্ষুদ্র একটি মহানগরী প্রায় দুই কোটি নগরবাসীকে সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা দিতে ব্যর্থ হতে চলছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণ দীর্ঘায়িত হয়ে সময়, খরচ বেড়েছে বহুগুণ। পাশাপাশি জন দুর্ভোগ আছেই। এরই মাঝে- তোড়জোড় চলছে বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় পাতাল রেল নির্মাণ যোগ্যতা যাচাই। ঢাকা থেকে কিছু কিছু স্থাপনা ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিয়ে ঢাকার জন সংখ্যা সীমিত না করা হলে- কোনোভাবেই যানজট সামাল দেয়া যাবে না। কেন কেন্দ্রীয় সচিবালয়, পিলখানা বিজিবি স্থাপনা, ঢাকা সেনানিবাস ঢাকার বাইরে যেতে পারবে না? কেন আবাসিক এলাকাসমূহে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা গার্মেন্টসসহ শিল্পকারখানা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার বাইরে নেয়া যাবে না? এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কেন গড়ে উঠছে না আমার বোধগম্য নয়? ডিজিটাল বাংলাদেশে সরকারের কার্যক্রম কেন বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে না?  

গ্যাস, বিদ্যুৎ সমস্যা, সংকট সাময়িক এবং এখানেও আছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা। আমলা নিয়ন্ত্রণে সমন্বয়ের অভাব এবং দুর্নীতি। নগরজুড়ে জালের মতো জড়িয়ে থাকা গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারী সিন্ডিকেটের আগ্রাসনে ধর্ষিত, শতছিন্ন। ঢাকামুখী বহু গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে মাঝে মাঝে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল গ্যাস সরবরাহ করে সংকট হচ্ছে। একটি বিশাল অংশ অবৈধভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় বৈধ ব্যবহারকারীরা অসহায়। 

সর্বশেষ সংকট হয়েছে বৃহত্তম বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বিভ্রাটের কারণে। উৎপাদন পর্যায়ে পেশাদারিত্ব এবং নজরদারি থাকলে সংকট এড়ানো যেতো। গ্যাস সংকটের কারণে দেশব্যাপী ব্যাপক সংকট হয়েছে। তবে আশার কথা, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে পরিস্থিতি উন্নত হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি ‘ওয়েক আপ’ কল হিসেবে ধরে নিয়ে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারিগরি নিয়ম মেনে সীমার অধীন গ্যাস উৎপাদন করতে বলছেন, যাতে বিবিয়ানা গ্যাস সেক্টরটির পরিণতি বাখরাবাদ বা সাঙ্গুর মতো না হয়। একইসঙ্গে সমন্বিতভাবে দ্রুত গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়েও তাগাদা দেয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

ঢাকা মহানগরীর পানীয় জল  সরবরাহ বিষয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শুনেও শুনছে না, দেখেও দেখছে না ঢাকা ওয়াসা  আর একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক যিনি অধিকাংশ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, দেশে যান কালেভদ্রে। তার মতে, মহানগরীর জল সরবরাহ ব্যবস্থা এশিয়ার সেরা কীভাবে হয় সেটাই চিন্তার বিষয়। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, রিসাইকেল ওয়াটার ব্যবহার করার বিশ্বজুড়ে অনুসৃত টেকনোলজি গ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারে ঢাকাকে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। 

দুনিয়ার অধিকাংশ মহানগরীতে মেট্রোপলিটন গভর্ন্যান্স আছে। ঢাকা মহানগরীর দুটি অঞ্চলের মেয়র অফিস যেন ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার। কেন নগরের সব উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয়ের কেন্দ্র হিসেবে মেয়র কার্যালয় ক্রিয়াশীল হতে পারে না। 

সবশেষে বর্তমান আমলা নিয়ন্ত্রিত বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম। কখনো ঢাকা মহানগরীকে কলঙ্ক তিলক মুক্ত করে আদর্শ মহানগরীতে রূপান্তরিত করতে পারবে না। প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট স্বচ্ছ জনবান্ধব কার্যক্রম, জনসম্পৃক্ত দায়িত্বশীল বাস্তবায়ন ব্যবস্থা এবং সর্বক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পেশাদারদের সম্পৃক্ত করা। প্রয়োজন আরবান রুরাল রিভার্স মাইগ্রেশন। তাহলে হয়তো কিছুটা পরিত্রাণ মিলবে ঢাকাবাসীর। কিন্তু সেগুলো কে করবে, কবে?


শেয়ার করুন