২৮ মার্চ ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:৫৮:৩৩ অপরাহ্ন


মুজিনগর দিবস আরেক পলাশী প্রান্তর
সত্য প্রতিষ্ঠায় সোহেল তাজ একা কেন?
খন্দকার সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৪-২০২২
সত্য প্রতিষ্ঠায় সোহেল তাজ একা কেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজ উদ্দিন আহমেদ ছবি/সংগৃহীত


পলাশীর আমবাগানে বাংলার সূর্য অস্তাচলে গিয়েছিলো ১৯৫৭ সালে নবাব সিরাজদৌলা বাহিনী ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের কূটচালে আর স্বদেশি মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে। পলাশী থেকে খুব দূরে নয় কুষ্টিয়ার মেহেরপুর আমবাগান। আবারো স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সূর্যোদয় হয়েছিল ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় মাইলফলক স্থাপনের দিন। দিনটিতে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের নিভৃত বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্থানটির নাম এখন মুজিবনগর। ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতের পর, দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামের গণহত্যা সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিল। মুক্তিকামী আবালবৃদ্ধবণিতা অবশ্য ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশিত ভাষণের পর থেকেই নানাভাবে প্রস্তুত ছিল যুদ্ধ মেজাজে। 

তিন দফা দাবী নিয়ে গনভবনমুখী সোহেল তাজের পদযাত্রা, ছবি/সংগৃহীত


তবে রাতের আঁধারে গণহত্যা শুরুর হলে গুছিয়ে নিতে একটু সময় প্রয়োজন ছিল। প্রধান জাতীয় নেতৃত্ব নানাভাবে ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিজেদের সংগঠিত করছিলেন। পরিকল্পনার নীলনকশা বঙ্গবন্ধু সহচরদের আগেই বলেছিলেন। ভারত কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। বিদ্রোহী সেনা অফিসারদের কয়েকজন ভারত সেনাবহিনীর কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে তেলিপাড়া ছায়া বাগানে মিলিত হয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা করেছিলেন। 

সংশ্লিষ্ট ভারত কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ছিল ১৯৭০ নির্বাচনে নির্বাচনী গণপরিষদ সদস্যদের নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের, সেই উদ্দেশে ১০ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার বিশেষ আয়োজনে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বর্তমান মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে। 

আরো একবার আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্যোদয় হয়। যে বাংলার সূর্য ১৭৫৭ সালে অদূরে থাকা পলাশীর আমবাগানে অস্তাচলে গিয়েছিলো। দেশি, প্রবাসী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান- স্মরণ দুঃখজনকভাবে সেভাবে হয় না। সে সময়ের বিজয়ী বীরদের কথা সেভাবে স্মরণ করা হয় না। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামে এই ঘটনাটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। বিশ্বের বুকে এইদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্পূর্ণ সময়টি এই সরকার সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা, বাধার বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীনতা অর্জনে মুখ ভূমিকা পালন করেছিল। 

দিনটির কথা মনে আছে। এই দিনে বাগেরহাট ছিলাম। আগে থেকেই শুনেছিলাম বিশ্বস্ত সূত্রে ওইদিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আমবাগানে মুক্তাঞ্চলে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করবে। কয়েকজন যোদ্ধা বন্ধুসহ একজন বিদেশি সাংবাদিক নিয়ে খান জাহান আলী (রহ.) মাজার শরিফের পুকুরপাড়ে অধীর আগ্রহে বসেছিলাম। খাদেমের হাত থেকে নিয়ে কুমিরদের খাবার দিলাম। দেখলাম আগ্রহ খাবার খেলো কুমিরগুলো। আমার সেই ওই সময়ের সারাক্ষণের সাথী দুই ব্যান্ডের রেডিওতে মৃদু কণ্ঠে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান শুনলাম। ইতিমধ্যে খবর পেলাম আমাদের স্থান পরিবর্তন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ নেত্রী আমার ভাবী আর ৪ মাসের শিশু মালাকে নিয়ে আবার নদীতে ভাসলাম। সেদিনের স্মৃতি এখনো আপ্লুত করে। পরে সেই অনুষ্ঠানে প্রবাসী সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী দলের নেতা এসপি মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। আমাদের আত্মীয় প্রয়াত নুরুল কাদের খান এবং শ্রদ্ধেয় ডক্টর তাওফিক এলাহী চৌধুরী মহোদয়ের লেখা থেকেও জেনেছি। মনে পড়ছে, জেলখানায় নির্মমভাবে নিহত চারনেতা শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সৈয়দ তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান মহোদয়ের কথা। খুনি মোস্তাক এবং খুনি সেনা অফিসারদের ভয়ভীতি সত্ত্বেও এই চার মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি দেশের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি। 

পলাশী আর মুজিব নগরের ঘটনা দুটির অদ্ভুত মিল খুঁজে পাই। ওইদিন ওই শপথ অনুষ্ঠানে মুজিবনগরের মীরজাফর খন্দকার মোশতাক ছিলেন। পলাশীর আমবাগানের মীরজাফর। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা পলাশীতে বাংলার নবাব সিরাজদৌলার পতন হয়েছিল। ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লিবের কূটচালে। 

মুজিবনগরের আমবাগানে আবারো জন্ম নিয়েছিল। ঠিক তেমনি খন্দকার মোশতাকের কূটচালে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এবং সৈয়দ তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে মতের অমিলটাকে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। পরিণতি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। পরিণতি ৩ নভেম্বর ১৯৭৫। 

দুঃখ হয়। এখনো বঙ্গ তাজ প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র সোহেল তাজকে সড়কে শোভাযাত্রা করে ১৭ এপ্রিলকে স্মরণ করতে দাবি তুলতে হচ্ছে। সত্যিই কষ্ট হচ্ছে সোহেল তাজের জন্য। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে লড়াই করতে হচ্ছে। পাশে কেউ আছে কি না জানি না। সময় কিন্তু নিষ্ঠুর, ইতিহাস কিন্তু কাউকে ক্ষমা করে না। দাবি করছি- মুজিবনগরের প্রবাসী সরকারের কার্যক্রমকে যেন যথাযথভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়। ইতিহাসের চিরন্তন শিক্ষা হলো- কাউকে ছোট করে কেউ কোনোদিন বড়  হতে পারে না।

ইতিহাসের কি পুনরাবৃত্তি।


শেয়ার করুন