২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ১০:২২:৪৭ পূর্বাহ্ন


ক্ষমতার রাজনীতি
মাহমুদ রেজা চৌধুরী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৪-২০২২
ক্ষমতার রাজনীতি


ব্যক্তিগত একটা বিষয়ে জানতে গিয়ে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার একটা চিত্র পেলাম। সেটার একটা অংশ আপনাদের সাথে শেয়ার করি। এই ‘মাঠভিত্তিক’ তথ্যটা গত কালকেই পেয়েছি। (১০ এপ্রিল, ২০২২) তাই এটাকে সাম্প্রতিক একটি তথ্য ই বলা যায়।

দেশে একজন মানুষ মোটামুটি এক বেলা তার খেতে কত টাকা লাগতে পারে। আমার অনুসন্ধান ছিল এটা নিয়েই। বিশ্বস্ত এবং বাস্তব তথ্য দিয়েছে আমার বন্ধু শাওনের ওপর। তার হিসাবে একবেলা একজন লোকের খেতে খরচ হয়, ২৭৫ টাকা। এই খাবার তালিকায় ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ডাল, এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি, অন্তর্ভুক্ত। এই খাবারগুলি খুব উঁচু শ্রেণির মানুষের জন্য না। সাধারণ একজন মানুষের জন্য সাধারণ খাবার তালিকা। এটুকু খাবার সব নাগরিকের মৌলিক চাহিদার মধ্যেই পড়ে। সর্বমোট খরচ হতে পারে, ২৭৫ টাকা। তাহলে একজন মানুষের একার তিনবেলা খেতে খরচ ধরে নিচ্ছি ৯শ টাকা।

সকালের নাশতা থেকে শুরু করে রাতের খাবারসহ।

এর অর্থ একজন মানুষের প্রতিদিন খাবার খরচ বা ব্যয় হয় অথবা হতে পারে, এক হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে একটা পরিবারে যদি ন্যূনতম চারজনের সদস্য থাকেন গড়পরতা তাঁদের প্রতি মাসে খাবার খরচে ব্যয় হয় প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকার মতো। সাথে তার বাসস্থান, চিকিৎসা, বস্ত্র, ছেলে মেয়েদের ন্যূনতম শিক্ষা। এগুলোকে যোগ করলে দাঁড়াতে পারে আনুমানিক ৫০-৬০ হাজার টাকা, কম-বেশি একটু পার্থক্য ধরে নিলেও। এটা ‘নিম্ন-মধ্যবিত্তদের’ একটা আনুমানিক হিসাব। 

এটা একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত সিকিউরিটি বা নিশ্চয়তার অধিকারের মধ্যেও পড়ে। এই অধিকারকে সুনিশ্চিত করবার দায়িত্ব, সমাজ এবং রাষ্ট্রের। সাথে অন্য বিত্তবান নাগরিকদের। কোনো দেশেরই কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্র একাই কিছু করে না অথবা করতে পারেও না। সমাজের ‘বিত্তশালীদের’ অথবা সমাজে যাদের সামান্য এসব কিছুতে ‘কন্ট্রিবিউট’ করার সুযোগ থাকে, তাঁদের সেটা করা উচিত। যেটাকে বড় দাগে চ্যারিটি বলেও জানি।

আমার পরবর্তী অনুসন্ধানের বিষয়টা ছিল, বাংলাদেশের সর্বমোট জনসংখ্যা কত পারসেন্ট ‘দুর্নীতিমুক্ত’ হয়ে প্রতি মাসে ন্যূনতম এই আয় বা উপার্জন করতে পারেন। উত্তরে জেনেছি, করে তবে এর অংশ শতকরা এখনো ১৫-২৫ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ধরে নিচ্ছি, এটা হতেও পারে এর চাইতে একটু বেশি, যেমন বর্তমান বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত আয় ‘জীবন ধারণের জন্য’ শতকরা ৩০-৩৫ শতাংশ মানুষের আছে। বাকি ৭০-৭৫ পারসেন্ট মানুষের অবস্থা তাহলে কি হয়? শুধুমাত্র জীবন ধারণের জন্য বিভিন্ন সময়ে তখন তাঁদের কোনো না কোনো ‘দুর্নীতির’ পথ বেছে নিতেই হয়। বাঁচার জন্য তো সবকিছুই করা যায়।

এই দৃষ্টিকোণ থেকেও বাংলাদেশে দুর্নীতি এক ধরনের জীবনযাপনের ‘সংস্কৃতি’ হয়ে গেছে এখন। এর থেকে মুক্তির সহজ পথ খুবই কণ্টকাকীর্ণ। ভবিষ্যতে এই সংকট আরো বাড়বে বলেই মনে হয়, ন্যায়নীতির অবয় বৃদ্ধি পাবে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা অর্জন পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটা বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্র হিসাবে আমরা একটা ‘কল্যাণমূলক অর্থনীতি’ এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই। এটা আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতার একটা অংশ। ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা থেকে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় শ্রেণিস্বার্থকে রা করতে গিয়েও আমরা দেশের প্রান্তিক লেভেলের মানুষ ও শ্রেণিকে দুর্নীতির পথে ঠেলে দিতেই বাধ্য করছি। 

দেশে এখনো শিতি এবং আধাশিতি যুবসমাজের বেকারত্ব ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। সংকটের মুখে শিাব্যবস্থা। নানান সংকটের মুখে রাজনীতি এবং মানুষের জীবনযাপনের ‘নৈতিকতাবোধ’। এতো সংকট থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির প্রসার ঘটা খুবই স্বাভাবিক। উন্নত রাষ্ট্রসমূহে সরকারি কিছু ‘নাগরিক কল্যাণমুখী’ কর্মসূচি থাকার কারণে সেই রাষ্ট্রগুলি ‘পুঁজিবাদী রাষ্ট্র’ হলেও সেখানে সাধারণ নাগরিকের দুর্নীতিমুখী হওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু আমাদের মতো সমাজ এবং রাষ্ট্র যেখানে আমরা না পুঁজিবাদী, না সাম্যবাদী, না কল্যাণমুখী। এর কোনোটাকেই আমরা রাষ্ট্রপরিচালনা এবং সমাজ বিনির্মাণে সুনির্দিষ্ট করে তুলতে পারি নাই। চর্চার প্রশ্ন তাই ভিন্ন। দিন যত যাচ্ছে, ততই আমরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছি, কোথাও পরিকল্পিতভাবে কোথাও বা বিচ্ছিন্নভাবে। যেভাবেই হই না কেন, অধিকাংশ েেত্র বাধ্য হয়েই তো হচ্ছি।

সে কারণেই মনে হচ্ছিল, সমাজ এবং রাষ্ট্র যে সমস্ত সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবয় এবং দুর্নীতি আমরা দেখছি এর সহজ সমাধান আনতে আমাদের বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সমাজ এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া জরুরি। সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে। কেবলই নিজের এবং ‘নিজেদের’ মতার রাজনীতি এবং এর সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে গিয়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজ এবং রাষ্ট্রকে প্রতিদিন একটু একটু করেই ধ্বংস করছি। 

আজকের বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সমাজে যত রকমের দুর্নীতি এবং অন্যায় দেখি তার মূল কারণ সেই ‘মতার রাজনীতি’ প্রাচীনকালেও যা ছিল। এটাকে যেভাবেই হোক ধরে রাখার চেষ্টাই চলছে। বিপরীত প্রান্তের শক্তি সেই তুলনায় বেশ দুর্বল, ঐক্যবদ্ধ না। আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রে একজন সাধারণ মানুষ তার ন্যূনতম রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির দিন আর কতো দূরে দেখবে, বলা কঠিন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এপ্রিল ১১, ২০২২ নিউইয়র্ক

শেয়ার করুন