২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০১:৩৫:৫১ পূর্বাহ্ন


অন্যরকম উত্তাপ বরিশাল-গাজীপুরে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৫-২০২৩
অন্যরকম উত্তাপ বরিশাল-গাজীপুরে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেছে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের


নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শুরু হয়েছে জটিলতা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় খোদ ক্ষমতাসীন দলে মনোনয়ন পেতে ও মনোনয়ন বঞ্চিতদের কর্মতৎপরতা কি হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। এবার বাস্তবে ফুটে উঠছে তেমন চিত্রই। 

বিশেষ গাজীপুর ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে ইতিমধ্যে বড় বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। গাজীপুরে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের নির্বাচন করার ঘোষণা ও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানের নমিনেশন প্রাপ্তির পর দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরনের বিভেদ তৈরি হয়ে গেছে। 

বরিশালেও ঠিক মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে বিভেদ বরিশাল আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র সেরনিয়াবাত ফ্যামিলিতে। এখানে সাবেক মেয়র সাদেক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ বা খোকন সেরনিয়াবাতকে নমিনেশন দেওয়ার পর থেকে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছে। প্রকাশ্যে চাচা-ভাতিজা মিল দেখা গেলেও কথাবার্তায় এদের মধ্যে যে বড় বিভেদ সেটা স্পষ্ট, যা ইতিমধ্যে বাইরেও চলে এসেছে। 

গাজীপুর সিটিতে আজমত-জাহাঙ্গীর 

গাজীপুর সিটি বরখাস্তকৃত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম অবশেষে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই প্রতিপক্ষ আজমত উল্লার ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম। কারণ জাহাঙ্গীর ব্যাপক জনপ্রিয় গাজীপুরে এবং তিনি ভোট পাবেন দলমত নির্বিশেষে। মেয়র হিসেবে ব্যাপক উন্নয়ন কার্মযজ্ঞ করায় তার প্রতিপক্ষরাও এখন জাহাঙ্গীরকেই মেয়র হিসেবে চাচ্ছে। তাছাড়া জাহাঙ্গীরকে নিয়ে আওয়ামী লীগে যে কা- ঘটার পর বরখাস্ত হয়েছিলেন, সেটাকে সাধারণ মানুষ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখে আসছে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে জাহাঙ্গীর ভোটে দাঁড়ানো অর্থ ব্যাপক ভোটে জয়লাভ। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পাস করা দুরূহ হয়ে যাবে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 

জাহাঙ্গীর বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন আগ থেকেই। তাইতো মনোয়নপত্র জমা দিয়েই তিনি বলেছেন, ‘হয়তো কালকের পর আমার পায়ে শিকল পরাতে পারে, অ্যারেস্ট করতে পারে, গুমও করতে পারে। ষড়যন্ত্র করে না সরালে আমি নির্বাচন থেকে সরব না। যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনারা আমার মায়ের পাশে থাকবেন।’

এর আগে জাহাঙ্গীর আলমের উপস্থিতিতে তার মনোনয়নপত্র রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলামের কাছে জমা দেন তিন সমর্থক। পরে জাহাঙ্গীর আলম নিজেই তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র জমা দেন। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার ও পরে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পাওয়া জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ঘটনাটি গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। 

মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খান বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখেছি জাহাঙ্গীর আলম ও তার মা নমিনেশন নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) প্রার্থী হিসেবে থাকবেন কি না তা দেখার অপেক্ষায় আছি। তিনি (জাহাঙ্গীর) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তাই বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি যদি তার আস্থা থাকে,  দেশের উন্নয়নের প্রতি তার আস্থা থাকে, তাহলে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।’

জাহাঙ্গীর আরো বলেন, ‘আমার জীবন না-ও থাকতে পারে। তবু আপনারা পাশে থাকুন। অনেকে মিথ্যাচার করতে পারে, আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে, অনেক কিছুই করতে পারে তারা। হয়তো আপনাদের সামনে আর না-ও আসতে পারি, এজন্য বলে যাই, এই নগরীকে রক্ষায় আমি এবং আমার সমর্থকদের পাশে থাকুন।’ জাহাঙ্গীর বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। আমি একা। আমার ওপর থেকে সব ধরনের ছায়া সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর ছায়া, মায়ের ছায়া এবং নগরবাসীর ছায়া আমার ওপর আছে।’ 

জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল 

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রির্টানিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম রোববার সকালে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করে বলেন, ‘উনি একজন ঋণখেলাপি হিসেবে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। উনি একজন জামিনদাতা হিসেবে ঋণখেলাপি।’ মেয়র পদে নিজের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মা জায়দা খাতুনের মনোনয়নপত্রও জমা দেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেছিলেন, তার ওপর হওয়া ‘এই অন্যায়-অত্যাচারের’ প্রতিবাদেই প্রার্থী হয়েছেন তার মা। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাচাই-বাছাই শেষে জায়েদা খাতুনসহ ৯ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, বাতিল করা হয় তিন জনের মনোনয়নপত্র।

এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। ব্যাংকের ইনস্টলমেন্ট জমা দেওয়ার কথা জানিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখিত ও মৌখিক জবানবন্দি দিয়েছে। তারপরও আপনারা যে কাজটি করলেন তাতে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে, আপনারা নিরপেক্ষতার মধ্যে ছিলেন না।’

রিটার্নিং কর্মকর্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমি আশা করি আপনাদের কাজে যেন নিরপেক্ষতা থাকে। সব প্রার্থীর সঙ্গে নিরপেক্ষ আচরণ করা হয়।’

রিটার্নিং কর্মকর্তার ফোকাল পয়েন্ট (সহায়ক) কর্মকর্তা মো. মঞ্জুর হোসেন খান জানান, অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা ওয়াসা শাখা থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার নিউ টাউন নিটওয়্যার কোম্পানি লিমিটেডের একটি ঋণের গ্যারান্টার হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। কারখানা কর্তৃপক্ষ ঐ টাকা পরিশোধ না করায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি শাখা ২৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়েছে। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, কোরিয়ান মালিকানাধীন ঐ কম্পোজিট কারখানায় তার কোনো শেয়ার নেই, কোনো লভ্যাংশও তিনি নেন না। তারপরও হাজার হাজার শ্রমিককে বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে তিনি ‘নিজের সম্পদ’ তাদের দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর বলেন, ঋণখেলাপির যে অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে, সেই কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা ঋণ পরিশোধেদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘তারপরও আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছে। কোনো অদৃশ্যের চাপে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা থেকে সরে গেছেন কি না জানি না। তবে আমি ন্যায়বিচার পেতে আপিল করবো। প্রয়োজনে আমি সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টে যাবো। আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চাই।’ 

বরিশালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে হাসানাত পরিবার 

বরিশালে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ নতুন প্রার্থী দেবে এটা কল্পনাও করেনি কেউ। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে বর্তমান মেয়র সাদেক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে করে বরিশালের আওয়ামী লীগের মূল লালন কর্তা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে। যদিও নতুন প্রার্থী তারই ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ বা খোকন সেরনিয়াবাত। প্রথমত. এটা নিয়ে তেমন কথা বলেনি কেউ। বিস্ময়ের সঙ্গে অবলোকন করেছে সবাই। কিন্তু মনোনয়ন প্রাপ্তির পর খোকন সেরনিয়াবাদের এক বক্তব্যে স্পষ্ট হয় ভেতরে ভাই ভাতিজার সঙ্গে তার দূরত্বের বিষয়। ১৫ এপ্রিল খোকন সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে বরিশালে কোনো উন্নয়ন হয়নি। (অর্থাৎ সেরনিয়াবাত সাদেক আবদুল্লাহর সময়ে) নগরবাসী আমাকে নির্বাচিত করলে তাদের প্রত্যাশা পূরণে শতভাগ স্বচ্ছ থেকে কাজ করার চেষ্টা করবো এবং প্রধানমন্ত্রী যে বিশ্বাসে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো।’ তিনি বলেন, ‘দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন। তার অনুমতি নিয়ে তিনি দলীয় মনোনয়নপত্র ফরম জমা দিয়েছি। আমি জেলা শহর পটুয়াখালীতে গিয়েছি। সেখানকার উন্নয়ন দেখে আমার কষ্ট লেগেছে। যার ছিটেফোঁটাও বরিশালে হয়নি। এ কারণে বরিশালের উন্নয়নে আমাকে প্রয়োজন বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই প্রয়োজন এবং এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নগরবাসী। তারাও চাচ্ছেন, আমি সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়ে তাদের উন্নয়নে শতভাগ স্বচ্ছ থেকে কাজ করি।’ 

এদিকে খোকন সেরনিয়াবাতের মেয়র মনোনয়নপ্রাপ্তির পর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল-৫ (সদর) আসনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি জাহিদ ফারুক। তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমরা চার বছর উপেক্ষিত ছিলাম। বরিশালবাসী আজ নিঃশ্বাস নিতে পারছে। আমাদের ছেলেরা যেখানে গিয়েছে, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমি তাদের বলেছিলাম কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে যাবো না, কিন্তু কেউ এলে তাকে ছাড় দেওয়াও হবে না।

বরিশালের মানুষ এত দিন ধরে ভয়ে ছিল, আগামীতে আর ভয়ে থাকতে হবে না। রাতে ডেকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসায় বসিয়ে রাখা হতো। রাত ১২টার পর কেউ চলে গেছে তাকে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। গত শনিবার (২৯ এপ্রিল) বরিশালে সন্ধ্যায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বরিশাল মহানগরের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে সিটি নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

এ সময় তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের একটি ভদ্র মানুষ উপহার দিয়েছেন। বরিশালের উন্নয়নে নৌকার মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত যেসব প্রতিশ্রুতি দেবেন তা তিনি বাস্তবায়ন করবেন এটাই আমাদের দাবি। খোকন সেরনিয়াবাতকে বিজয়ী করে তার মাধ্যমে উন্নয়ন করে বরিশালকে পাল্টে দিতে হবে। নৌকার প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ সবাই মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করবে।

মঞ্চে উপবিষ্ট খোকন সেরনিয়াবাতকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি আপনার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করবো। আমরা যদি আপনাকে নির্বাচিত করতে না পারি, তাহলে সেই হায়েনা আবারও বরিশালে আসবে। আপনার আর আমার মধ্যে অনেকে মিষ্টি কথা বলে বিভেদের চেষ্টা করবে, এগুলো আপনি শুনবেন না। আপনি নিজে বিচার করবেন কে আপনার ভালো চায়, আর কে খারাপ চায়। এ সময় নগরবাসী শান্তিতে থাকতে চায় বলে দাবি করেন তিনি। সভায় ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গ সংগঠনের কেউ কেউ উপস্থিত থাকলেও অনেকে অনুপস্থিতও ছিলেন। 

উল্লেখ্য, মনোনয়ন না পেয়েও সাদেক আবদুল্লাহ চাচা খোকন সেরনিয়াবাত যাতে বিজয়ী হন সে ব্যাপারে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।  

যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেয়ে কাজ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি গ্রহণ করা হবে।

শেয়ার করুন