২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৭:১৭:৪৪ পূর্বাহ্ন


দেশকে সাইফুল হক
গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০৫-২০২৩
গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই সাইফুল হক


বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে চলমান গণআন্দোলনকে বিস্তৃত করা। গণআন্দোলনকে একটা গণজোয়ারে পরিণত করা। এই গণজোয়ারের মাধ্যমে বাস্তবে একটা গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সাইফুল হক একথা বলেন। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদক সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ। 

দেশ : গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারে একটি জোট গঠন করেছেন। এই জোট নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছেন। এই জোটের মাধ্যমে যে যুগপৎ আন্দোলন করে যাচ্ছেন তাতে কি মনে হয় আপনারা রাজনীতিতে ভালো প্রভাব ফেলতে পারছেন। এর বিপরীতে এ ধরনের দাবি আদায়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারছেন? এর পাশাপাশি জনগণকে আপনাদের দাবির ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন কি না?

সাইফুল হক : এ ধরনের প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আপনি জানেন গত বছরের ৮ আগস্ট গণতন্ত্র মঞ্চ গঠন করেছি। প্রথমত সরকার ও এ ধরনের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে এবং আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের ভিত্তিতেই মঞ্চ গঠন করা হয়েছে এবং আমি এখন নিশ্চিত বলতে পারি মঞ্চ যে রাজনৈতিক আর্দশ হাজির করেছে, বিশেষ করে মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তার আগে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল এবং নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা। যে সরকার একটি অবাধ বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করবে। এ দাবিগুলো জনগণ গ্রহণ করেছে। যে জনগণ গত দেড় দশক থেকে তার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। যে জনগণ প্রতিনিয়ত বাজারের আগুনে পুড়ছে। বলতে পারেন সমস্ত ক্ষেত্রে জনগণকে একটি অধিকারহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছে। এ ধরনের জনগণের আকাংখাকেই ধারণ করে গণতন্ত্র মঞ্চ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে। আমরা সমাবেশ, অবস্থান, বিক্ষাভ, পদযাত্রাসহ অনেক ধরনের কর্মসূচি দিয়েছি। এগুলো জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করছি এবং একইভাবে ২৩ ও ২৮ মে পদযাত্রা আছে। এ পর্যায়ে জুন মাসের ৪ থেকে ৮ তারিখ ঢাকা থেকে দিনাজপুর অভিমুখে রোডমার্চের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এধরনের কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে চলমান গণআন্দোলনকে বিস্তৃত ও শক্তিশালি করা। গণআন্দোলনকে একটা গণজোয়ারে পরিণত করা। এই গণজোয়ারের মধ্য দিয়ে বাস্তবে একটা গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই। জনগণের মধ্যে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, মানুষ যে পরিবর্তনটা দেখতে চায়, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিরোধীদল জনগণের সে আকাক্সক্ষা ধারণ করছে এবং দেশের জনগণ মানুষ বুঝতেও পেরেছে। আপনারা লক্ষ্য করেছেন সরকারের এমন বাধা, দমনপীড়ন অত্যাচার থাকা সত্ত্বেও মানুষ ভয়কে জয় করে রাজপথে নামছে। আমরা বিশ্বাস করি, যেসব লক্ষ্য নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি তা আদায়ে জনগণ রাজপথে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো নামবে। আগামী এক থেকে দুই বা তিন মাসের মধ্যে আমরা সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবো। রাজনৈতিকভাবে আমরা পরাজিত করতে পারবো এবং তাকে পিছু হটাতে পরবো এবং জনগণের যে দাবি সে দাবি আদায়ে আমরা সক্ষম হবো। 

দেশ : আপনি এখন যা বললেন বা আল্টিমেটাম দিচ্ছেন তাতে কি মনে হয় সরকার খুব গুরুত্ব দেবে? সরকারের খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কি মনে হয় সরকারের অবস্থান খুব খারাপ। তারা কি আপনাদের এমন ধরনের বক্তব্য আমলে নেয়?

সাইফুল হক : আমি আপনার প্রশ্নটা খুব বেশি উপযুক্ত মনে করিনি। তবু এটা ধরছি। আমি বলতে চাই ইতিমধ্যে সরকারের মধ্যে একটা নার্ভাসনেস দেখা দিয়েছে। একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে তিনটা দেশ সফর করেছেন।  সে সফর থেকে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য দিয়ে বলেছেন যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীদের দেশ থেকে তিনি কোনো পণ্য কিনবেন না। ...এটা তিনি আসলে আকস্মিকভাবে ঘোষণা দিয়েছেন..ধারণা করা হচ্ছে ওই তিনদেশ সফরকালে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি যে প্রটোকল বা সম্মান পাননি সে ক্ষোভ থেকে তিনি এধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। এরপরই আপনারা লক্ষ করেছেন গত কয়েক বছরে এদেশে ছয়টি দূতাবাসে প্রটোকল বা বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হতো, আকস্মিকভাবে সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে এটাও প্রধানমন্ত্রী রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে ঘটেছে। এদিকে বিবিসিতে প্রধানমন্ত্রী যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সবকিছুর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে যে, সরকারের শেকড় যে উপড়ে যাচ্ছে..তার যে গণভিত্তির জায়গা থাকছে না। তিনি কৃত্রিমভাবে আগে যে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, তাতে যে ধস নামছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে তাকে আর পছন্দ করছে না, অন্যদিকে এ সরকারের অধীনে যে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে-এটা যে বিশ্ববাসী বিশ্বাস করছে না, তা তিনি বুঝেছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তিন দেশ সফর করে তার সরকারের পক্ষে একটি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন-তা স্পষ্ট। আর এটাও পরিষ্কার যে তিনি এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ম্যানেজ করতে পারেননি। এতে সুবিধা...

দেশ : তা তো বুঝলাম, কিন্তু এতে আপনাদের লাভ কি? আপনাদের কি আমেরিকা, ইউরোপ বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে..

সাইফুল হক : আরে বাবা (একটু রেগে গিয়ে)..আমরা তো এখানে গণআন্দোলনে আছি। গণজাগরণে আছি। বাংলাদেশের কোনো পরিবর্তনে বাংলাদেশের মানুষ যদি রাজপথে না নামে সেক্ষেত্রে কি এখানে কেউ সরকারকে নামাবে? দুনিয়ার কেউ কি এখানে সরকার পরিবর্তন করবে? আমার পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তো সেকথা বলে না। সুতরাং মানুষ এখানে লড়ছে, মানুষের পক্ষে যদি আন্তর্জাতিক পক্ষ এসে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আমরা তাকে সাদরে গ্রহণ করবো। আমরাও বিশ্বাস করি নিশ্চয়ই কোনো দেশ এখানে এসে সরকার পরিবর্তন করবে না। কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপও আমরা চাইবো না। কিন্তু আমরা চাইবো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের মানুষে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়াবে। আমরা চাইবো সরকার যে ধারাবাহিকভাবে অপরাধ করে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসী দাঁড়াবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেনো একটা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হতে পারে তার পক্ষে বিশ্ববাসী দাঁড়াবে। বাংলাদেশে ভোটাধিকারের পক্ষে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে রাজপথে আমরা সে ধরনের জমিনটা আমরা তৈরি করতে চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি, আন্দোলনে এই জমিন যতো দ্রুত তৈরি হবে সরকারে পতনের পথ ততই তরান্বিত হবে। আগামী এক-দুই মাসে আমরা জনগণের পক্ষে আরো কয়েকটি কর্মসূচি নেবো। এতে সরকারের ভিত আরো কেঁপে উঠবে। এবার আন্দোলন সফল না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরবো না। দিন যতো যাচ্ছে, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য বিরোধী দলের ব্যাপারে আস্থা ততই বাড়ছে। 

দেশ : কিন্তু দেখা যাচ্ছে আপনাদের এই গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে একটি দল (গণঅধিকার পরিষদ) সরে গেছে। এতে কি আপনাদের ক্ষতি হয়নি। অথচ আপনারা যে বলছেন জণগণের মধ্যে একটা আস্থা তৈরি হয়েছে...

সাইফুল হক : হ্যাঁ, আমাদের জোট থেকে একটি দল চলে গেছে। এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। তবে আপনারা জানেন এধরনের বড় আন্দোলনে নানা ধরনের শক্তি থাকে। আপসকামী শক্তি থাকে। নানান ধরনের শক্তি থাকে। তাই এধরনের প্রেক্ষাপটে কেউ সরে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা না। আপনি স্মরণ করতে পারেন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে, এমনকি ৮৬ কিংবা ৮৭ সালে বিশাল আন্দোলনের মধ্যেও বিকালবেলায় আমাদের সঙ্গে রাজপথে থেকে সন্ধ্যাবেলায় ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে শপথও নিয়েছে। আওয়ামী লীগের কোরবান আলীর মতো অনেকে কোরবান হয়ে গেছিল। কিন্তু এতে করে কোনো ধরনের গণজোয়ার ঠেকানো যায়নি। এরশাদের পতন হয়েছে। সুতরাং এধরনের আন্দোলনে বহু ধরনের শক্তি থাকে। নানা কারণে তারা সটকে পড়তে পারে। কিন্তু মানুষ যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, গণআন্দোলন যখন গণজোয়ারের দিকে যায়, তখন সেখান থেকে কে কখন কোথা থেকে ছিটকে পড়ে তাতে কিছু যায় আসে না। গণতন্ত্র মঞ্চ এখন অনেক সংগঠিত হয়েছে। গত ১২ মেতে তার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ করেছে। গণতন্ত্র মঞ্চ মানুষের মন জয় করেছি। আমি মনে করি, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ সামনের দিকে আরো এগোবে। 

দেশ : সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে বলতে হয় আপনারা বলছেন রাজপথ কাঁপাবেন। আন্দোলন করবেন। সরকারও হার্ডলাইন নেবে, তো এতে শেষমেশ কী হবে? এসব বিবেচনায় এনে সরকারকে আপনারা কি পরামর্শ দেবেন?

সাইফুল হক : আমার পরামর্শ হচ্ছে সংকটটা হচ্ছে রাজনৈতিক। আওয়ামী লীগ যদি সমস্যার সমাধান যদি রাজনৈতিকভাবে করতে চায়, সে সময়টা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। আমি বলেছি দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নে সরকার কীভাবে পদত্যাগ করবে? এবং নির্বাচনকালীন কীভাবে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। নীতিগতভাবে সরকার ও সরকারি দল এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেয়, বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সেক্ষেত্রে সংকটের সমাধানের সুযোগ এখনো আছে। একবিংশ শতাব্দীতে রাজপথে সহিংসতা তো কারো জন্য কাম্য নয়। নিশ্চয় আন্দোলন-সংগ্রামই হচ্ছে বিরোধী দলের শেষ বিকল্প। সরকার যদি সেপথে না হাঁটে, তাদের যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয়, তাহলে এখন যে গণআন্দোলন ও গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকার রেহাই পাবে না। এদের বিদায় দেওয়া ছাড়া জনগণের আর কোনো পথ থাকবে না।  

দেশ : সরকারের সর্বশেষ অবস্থা দেখে কি তাই মনে হয় যে, তারা আপনার এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নেবে?

সাইফুল হক : আমি মনে করি সরকার পিছু হটতে শুরু করেছে। 

দেশ : তাহলে কি মনে করেন সরকার আলোচনায় আগ্রহী?

সাইফুল হক : আমি মনে করি সরকার পিছু আরো হটবে। কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া শুরু হয়েছে। 

দেশ : এমন ইঙ্গিত কি পেয়েছেন?

সাইফুল হক : হ্যাঁ, আমি মনে করি এ ধরনের ইঙ্গিত হাতের কাছেই আছে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছেন। এটাই মনে হয় তাদের প্রথম কার্ড না। আরো কিছু কার্ড তাদের জামার পকেটে বা শাড়ির আঁচলে আরো কিছু কার্ড আছে। আন্দোলন যতো তীব্র হবে তারা তাদের সেফ এক্সিট কীভাবে হবে, আমি আশা করবো তাদের সেই কার্ডগুলো সহসা সাবমিট করবেন। সেক্ষেত্রে আমরা একটা দায়িত্বশীল বিরোধী দল হিসাবে নিশ্চয়ই আমরা গণমানুষের আকাক্সক্ষার দল হিসাবে গণতান্ত্রিক মঞ্চ সরকারের সেফ এক্সিট বিষয়ে আলোচনা করবো।

শেয়ার করুন