২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৭:৪৮:৫৭ অপরাহ্ন


বিষাদগারে ৩৯ মানবাধিকার সংগঠন
রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতির সমালোচনা
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৪-২০২২
রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতির সমালোচনা বাংলাদেশে অবস্থান রত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি পরিবার,ছবি/সংগৃহীত


রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতির সমালোচনায় মুখর হয়েছে আমেরিকার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল ও ৩৭টি অন্যান্য গ্রুপ। তারা কানাডা, ডেনমার্ক, ইউরোপিয়ান কমিশন, জার্মানি, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা রিফিউজি শিশুদের জন্য স্কুলে ভর্তি বন্ধ করার কারণে বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছে এবং বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনসমূহ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশুদের যাদের এখন কোনো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ দিতে চাপ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ৩৯টি সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়, ”রোহিঙ্গা মানবিক সংকটে ইউরোপিয়ান কমিশন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছে। কিন্তু এসব রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা এখন প্রচণ্ড রকম সংকটে।

আমরা সে জন্য মনে করি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশ সরকারকে স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান জানাবে। রিফিউজি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশুদের এখন স্কুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্যান্য একই মনোবৃত্তির সরকাররাও এই পদক্ষেপ নিতে পারেন। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে রিফিউজি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কমিউনিটি পরিচালিত স্কুলসমূহকে স্বীকৃতি দিতে এবং সেকেন্ডারি শিক্ষাসহ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে রোহিঙ্গা ছাত্রদের মানবিক ফান্ড সরবরাহ করার সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানাই। বর্তমান প্রতিবন্ধকতায় ইউরোপিয়ান ফান্ডিং শুধু অনানুষ্ঠানিক, অস্বীকৃত এবং ছোট শিশুদের মৌলিক জ্ঞান শেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। 

উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্র শিশুদের উন্নয়ন কর্মসূচি, অনানুষ্ঠানিক হোমবেজড শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ, যেখানে ২২ হাজার ছাত্র রয়েছে এবং মায়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী ৪০ হাজার পর্যন্ত ছাত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল তা কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে বন্ধ করে দেয়ার আদেশ দেয়। হোমবেজড ও শিশু বয়সে শিক্ষা ইইউয়ের সহযোগিতায় চলছিল। অন্যান্য দাতারাও তাতে সহযোগিতা দেয়। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে রোহিঙ্গা ছাত্রদের আনুষ্ঠানিক কারিকুলাম এবং সেকেন্ডারি লেভেল ক্লাসে নির্দেশ লাভে কমিউনিটি পরিচালিত স্কুলগুলিতে শিক্ষাক্রম চলছিল। কিন্তু বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এসব স্কুলকে বৈধ স্বীকৃতি আদায়ে কোনো সুযোগ দেয়নি। তারা কোনো মানবিক ফান্ডিংও লাভ করতে পারেনি। তাছাড়া ইইউ বা জাতিসংঘ এজেন্সি এই কমিউনিটি পরিচালিত স্কুলগুলো সম্পর্কে কোনো প্রচারণাও চালায়নি। ডিসেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক কমিউনিটি পরিচালিত স্কুলসমূহ ভেঙে দেয়। তাছাড়া স্কুল বন্ধ না করায় এক শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয় এবং হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় যে, যেসব পরিবার শিশুদের লেখাপড়া শেখাবে, তাদের পরিবারের ডাটাকার্ড ছিনিয়ে নেয়া হবে। এসব ডাটাকার্ড মানবিক সাহায্য ও সেবা লাভে জরুরি। তাদের বলা হয়, তাদের বন্যা উপদ্রুত ভাসানচর অঞ্চলে প্রেরণ করা হবে। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষার মাদরাসাও বন্ধ করে দেয়। রিফিউজি ও মানবাধিকার গ্রুপগুলো ভয় করছে যে, স্কুল বন্ধ করার নির্দেশ হচ্ছে ভাসানচরে রিফিউজি সরিয়ে নেয়ার জন্য বল প্রয়োগের অংশ। এই ভাসানচরে রিফিউজিরা চলাফেরার সমস্যায় রয়েছে। খাদ্য ও ওষুধ স্বল্পতায় ভুগছে। নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা প্রধান ভূখণ্ডে ফিরে যেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। 

বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা রিফিউজিদের স্থানীয়ভাবে মিশে যাওয়ার বিরুদ্ধে। ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার বিরুদ্ধে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো শুধু অনানুষ্ঠানিক মৌলিক পাঠ দিতে পারে। যা হোক কমিউনিটি পরিচালিত স্কুলগুলো মায়ানমারের কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ দেয়। যাতে তাদের প্রত্যাবাসন সহজ হয় ও মায়ানমারের মধ্যে সকল জীবন পরিচালনা করতে পারে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ মায়ানমার কারিকুলাম প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার ছাত্রকে সেকেন্ডারি লেভেল শিক্ষাদানে সম্মত হয়। ইইউ সমর্থিত শিক্ষা সেন্টার পরিকল্পনায় কমিউনিটি পরিচালিত স্কুলগুলো সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্কুল বন্ধ করা এই পরিকল্পনার পরিপন্থী।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জরুরি অবস্থায় শিক্ষার জন্য ফান্ডিংয়ের কথা বলে এবং শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে সহযোগিতা দেয়ার কথা বলে। তাছাড়া ইউরোপিয়ান আইনে বাংলাদেশকে প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড স্ট্যাটাস দেয়ার সঙ্গে মৌলিক মানবাধিকার বাস্তবায়নের ব্যবস্থা সম্পৃক্ত করা হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের চিঠিতে এই ট্রেড স্ট্যাটাসের সঙ্গে সকল শিশুর শিক্ষায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়। অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জাতিসংঘ কমিটি ২০১৮ সালে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের বৈধ স্ট্যাটাস দেয়ার বিরোধিতাকে রিফিউজি ক্যাম্পের বাইরে তাদের শিক্ষাবিরোধিতা বলে বর্ণনা করে। 

বাংলাদেশের নীতি রোহিঙ্গা রিফিউজিদের ছেলেমেয়েদের ভালো ভবিষ্যৎ গঠনের বিরোধী। কমিউনিটি পরিচালিত স্কুল বন্ধ করার সাবেক ছাত্ররা ট্রাফিকিংয়ের পাল্লায় পড়বে। ছাত্ররা যারা স্কুল বন্ধ করেছে এখন তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করছে। ছাত্রীদের বিয়ে দিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সীমান্ত উন্মোচন করে অগণিত রোহিঙ্গার জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের স্কুল বন্ধ করা রোহিঙ্গাদের একটি জেনারেশনের জন্য সংকটের সৃষ্টি করছে। আর তা ক্যাম্পে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। এই সংকট নিরসনে আমরা হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”

উল্লেখ্য, উপরোক্ত চিঠি আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কাছেও পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য এতোকিছু করার পরও সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা, অনেকট যাতনার বিষয়।

ইতিমধ্যে স্কুলকে ঘিরে রিফিউজি ক্যাম্পে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মারামারি হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে অনেকেই। তাছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে সেখানে মার্কিন পরিবেশে ড্রাগ ট্রাফিক, বেশ্যাবৃত্তি ও ম্যান ট্রাফিকিংয়ের মতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এসবের প্রতি মানবাধিকার সংগঠনগুলো দৃষ্টি দেয়নি। তারা যে আজ স্কুল বন্ধ করার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বাংলাদেশ যে বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে তাকে স্কুলের সুযোগ সৃষ্টির সঙ্গে শর্তযুক্ত করে এতোদিনের বাংলাদেশের সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতাকে খাট করেছে। বাংলাদেশের কূটনীতি এ বিষয়ে ব্যর্থ হবার পথে।

 যেসব সংগঠন এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে সেগুলো হলো : ১. ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল; ২. আমেরিকান ফর রোহিঙ্গা; ৩. আরকান ইনস্টিটিউট যার পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস, ৪. আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস, ৫. আরকান আলট্রুইসম সোসাইটি অ্যান্ড এডুকেশনাল নেটওয়ার্ক, ৬. বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে, ৭. বার্মা টাস্কফোর্স, ৮. বার্মিজ রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন ইন জাপান, ৯. ক্যাম্পেইন ফর এ ফ্রি মায়ানমার, ১০. কানাডিয়ান রোহিঙ্গা ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, ১১. ক্রেইন সেন্টার ফর মাস এট্রোসিটি প্রিভেনশন; ১২. এডুকেশন ফর রোহিঙ্গা চিলড্র্রেন, ১৩. ফরটি ফাইভ রাইটস, ১৪. ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন, ১৫. ফ্রেন্ডস অব রোহিঙ্গা ইউএসএ, ১৬. গ্লোবাল মুভমেন্ট ফর মায়ানমার ডেমোক্রেসি, ১৭. হিউম্যান রাইটস ওয়ার্চ, ১৮. ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর দি রোহিঙ্গা, ১৯. জিউস রোহিঙ্গা জাস্টিস নেটওয়ার্ক, ২০. জাস্টিস ফর অল, ২১. জাস্টিস ফর রোহিঙ্গা ইউকে, ২২. এলচেইম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাফট ফর রোহিঙ্গা ওম্যান, ২৪. লস অ্যাঞ্জেলেস রোহিঙ্গা অ্যাসোসিয়েশন, ২৫. নেবার এগেইন কোয়ালিশন, ২৬. রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল, ২৭. রোড আইল্যান্ড বোর্ড অব বাবিস ২৮. রোহিঙ্গা কালচারাল সেন্টার ফর শিকাগো, ৩০ রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক কানাডা ৩১. রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক, ৩২. রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট ইউনিটি রাইটস, ৩৩. রোহিঙ্গা ওম্যান অ্যাসোসিয়েশন ফর এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ৩৪. রোহিঙ্গা ওম্যান ডেভেলপমেন্ট ফোরাম, ৩৫ রোহিঙ্গা ইউমথ ফর লিগ্যাল অ্যাকশন, ৩৬. সোসাইটি ফর হিউম্যানিস্টিক জুডাইজম, ৩৭. ইউএস ক্যাম্পেইন ফর বার্মা, ৩৮. ইউনিয়ন ইউনিভার্সেলিস্ট সার্ভিস কমিটি, ৩৯. ওম্যান পিস নেটওয়ার্ক। 


শেয়ার করুন