২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৫:০৩:৪৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


সিনিয়র নেতাদের অনেকেই জড়িত
বিএনপি ভাঙার অব্যাহত ষড়যন্ত্র
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৪-২০২২
বিএনপি ভাঙার অব্যাহত ষড়যন্ত্র


বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ‘বিএনপি’। এই দলটি গত দেড়যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে। যাদের শীর্ষনেতা দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে রাজনীতি কর্মকাণ্ডেরই বাইরে। যাদের নেতা-কর্মীদের ওপর ৩৫ লাখ মামলার খড়গ ঝুলছে বিগত ১৪-১৫ বছর ধরে, তারা কেন হঠাৎই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। 

এর সবকিছু ঘিরেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। বিএনপি সর্বশেষ কোনো নির্বাচনেই অংশ নেয়নি। সেটা স্থানীয় পর্যায়েরও। বিশেষ করে বিগত নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থা এনেই ওই সিদ্ধান্ত। ফলে পরের নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য দেশ-বিদেশের প্রচণ্ড চাপ দলটির ওপর। দেশে অনেকেই মানেন না, বিএনপি বৃহত্তর এক রাজনৈতিক দল। কিন্তু সত্যটা তো ভিনদেশিরাও জানেন। জানেন বিএনপির জনপ্রিয়তা। হতে পারে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়ে যাওয়ায় বিএনপির জনপ্রিয়তা বা প্রয়োজনীয়তা বেড়ে গেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া হবে না এটা একরকম ফাইনাল ঘোষণা। বিএনপিও আগামী নির্বাচনে শর্ত দিয়ে বসে আছে। শর্ত না মানলে নির্বাচন বর্জন। 

বিএনপি অবশ্যই যেতে চায় নির্বাচনে- আর সে শর্তটা হলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিতকরণের। আর সেটা হতে হবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ একটা সরকারের অধীনে। বর্তমান যে প্রক্রিয়া বিদ্যমান নির্বাচনের ক্ষেত্রে- এ প্রক্রিয়ায় বিএনপি যাবে না, এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে দলটি। সমস্যার মূলেই এটা। কেন বিএনপি নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। নির্বাচনসংক্রান্ত আইন হয়েছে। সব প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা চলছে। ইসি সংলাপ করছে। পরামর্শ নিচ্ছে সর্বমহলের। একটা নির্বাচনী নির্বাচনী ভাব। স্বচ্ছতা আনার প্রাণান্ত চেষ্টা। তবুও বিএনপি এতে সন্তুষ্ট নয়। 

এখন প্রশ্ন, চলমান প্রক্রিয়া কী বদলে দেয়া যায়? সরকার ইচ্ছা করলেই পারে। বিএনপির দাবি চলমান প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হওয়ার অর্থ ২০১৪ ও ২০১৮ সনের নির্বাচন প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়াকে দেশ ও বিদেশের অনেক দেশই সমর্থন করে না। কারণ সরকার নির্বাচিত হবে সরাসরি জনগণের ভোটে। কিন্তু ওই সমস্ত নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি। বেশিরভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস। ফলে এটা গণতন্ত্রের সঙ্গার মধ্যে পড়ে না। এটাই গণতন্ত্র প্রত্যাশী দেশের মানুষ ও বিদেশিরাও প্রত্যাশা করে। 

ফলে এ পর্যায়ে প্রচণ্ড একটা চাপে পড়ে গেছে ক্ষমতাসীন সরকার। কারণ নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের আস্থা নেই। ফলে চলমান প্রক্রিয়ায় ভরসা। তাহলে কী করা যায়। কীভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে আনা যায়, সে প্রচেষ্টা তাদের ভেতরে ভেতরে। প্রকাশ্যে দলটিকে যতই তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক। বিএনপি দেউলিয়া হয়ে গেছে। সমার্থন নেই। জনবিচ্ছিন্ন একটা দল। যাদের শীর্ষ দুই নেতা দণ্ডপ্রাপ্ত। তারা সরকার পরিচালনা করবে কাদের নিয়ে- এমন হাজারো কথা।

আসলে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নিয়ে এমন কথা কেন বলে? এর কারণটা উপলব্ধি করা গেছে সম্প্রতি কিছু কাজকর্মে। সেটাও বিএনপি ঘিরেই।  বিএনপির নেতৃত্বে একটা ভাঙ্গনের সুর বেশ কিছুদিন ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে। জিয়া পরিবারের সিদ্ধান্তে যদি বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে একটা গ্রুপ জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপির নামে আরেকটি দলে বিভক্তি হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে। এ ষড়যন্ত্র অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে এটাকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কেননা বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীদের ওপর মামলার খড়গ। নেতাদের মধ্যেও আছে মামলা। কিন্তু প্রশাসন চাইলে ওইসব রাজনৈতিক মামলা চলে নতুবা না। ফলে সুবিধাভোগী একটা গ্রুপ এ সরকারের অধীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থেকেও মন ভরছে না। বাসনা জেগেছে জীবনের শেষ বয়সে আবারো সংসদ সদস্য হওয়ার। সেখানে দলীয় সিদ্ধান্ত তুচ্ছ। প্রতিপক্ষের আনুকূল্য পেয়ে হয়ে যেতে পারলে মন্দ কী। 

এমন বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা সেটা নিয়ে চিন্তিত নন। সেটা নিয়ে তাদের হয়রানিও হতে হয় না। বরং ওই তালিকায় থাকা অনেকেই সুবিধাভোগী। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়-ইনকাম ভালোই চলছে। কোথাও সমস্যা নেই। এককথায় তারা এ সরকারের আমলে বেশ সুবিধাভোগী। তারাই মূলত এ পর্যায়ে এসে লম্ফজম্প দেয়ার চেষ্টায় মগ্ন। এ তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। বিশেষ করে খালেদা জিয়া গৃহবন্দি ও তারেক জিয়া দেশের বাইরে থাকায় এদের কন্ট্রোল করার আর কেউ নেই। এরা মূলত নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত। 

এর আগেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় মরহুম মান্নান ভুইয়া, সাইফুর রহমান, মেজর হাফিজদের নাম ছিল। এখনও বরিশালের নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার, খুলনার মঞ্জুসহ মাঠ পর্যায়ের অনেকের সঙ্গে কেন্দ্রের শওকত মাহমুদ, এহসানুল হক মিলন প্রমুখ ফ্রন্টলাইনে আসলেও ব্যাকসাইডে বেশ কিছু বড় ও অভিজ্ঞ বা সিনিয়র নেতা রয়েছেন। যারা খুব সক্রিয়ভাবে ষড়যন্ত্রে মগ্ন। 

খালেদা জিয়া রাজনীতিতে থাকাকালীন সময়েও গোপনে এরা সোচ্চার ছিলেন। শোনা গেছে, পরিস্থিতি এতোটাই জটিল ছিল, তার কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইনডোর মিটিংয়ে সবার মুঠোফোন কেড়ে নেয়া হয়েছিল। কারণ ইনফরমেশন পাসিং ছাড়াও সরাসরি ইনফরমেশন বা সিদ্ধান্ত তারা লাইভ করতেন বলে অভিযোগ ছিল। 

এখন খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত। এখন সে চক্র চুপচাপ থাকবে এটা বিশ্বাস করাও ঠিক না। চক্রান্তকারীরা দলের নীতিতে বিশ্বাসী হলে আন্দোলনের মাধ্যমে এতোদিন খালেদা জিয়াকে বের করে নিয়ে আসতেন। তারা চায় না খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠে ফিরুক। তাহলে তাদের সমস্যার কারণ হয়ে যাবে। এগুলো যদিও নতুন কথা না। 

আসলে ক্ষমতাসীনরা চাইবেই, তাদের প্রক্রিয়ায়ই নির্বাচন ও বিএনপির সবাই না এলেও একটা বড় গ্রুপ বিএনপি নামে নির্বাচনে আসুক। এটা রাজনীতির খেলা। এটা তাদের প্রত্যাশা বা লবিং দোষের নয়। কিন্তু সে লোভে পা দেবে দীর্ঘ ক্ষমতাবঞ্চিতরা? 

বিএনপি ভাঙার চেষ্টা পুরোনো। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, নাজমুল হুদা, কর্নেল অলি আহমেদ। এমন বড় বড় নামের মানুষ বিএনপি ছেড়ে একই আদর্শে আলাদা প্ল্যাটফর্ম গড়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাদের কী অবস্থা সেটা লিখে সময় নষ্ট করা ঠিক না।

আওয়ামী লীগেও এমনটা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনে বিএনপির মতো সংস্কারবাদী নামে একটা বড় গ্রুপ আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনাকে মাইনাস ফরমুলা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সে ষড়যন্ত্র টিকেনি। শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, দমন করেছেন। এখনো ওইকর্মে সক্রিয় থাকারা অনেক যোগ্য হয়েও দল বা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণস্থানে যথাযথ মর্যদা পাচ্ছে না।

তাদের রেখে অনেক তরুণ, অনেক অনভিজ্ঞ দিয়ে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো পরিচালনা করছেন প্রধানমন্ত্রী। হয়তো এ জন্য বাড়তি পরিশ্রম করতে হয় তাকে। সবাইকে গাইড করতে হয়। তবু দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল টাইপের ফরমুলা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন।

এটা ঠিক, খালেদা জিয়া ওই দমননীতি পারেননি। এ জন্যই এসকল অলটাইম সুবিধাভোগীরা যুদ্ধের ময়দানে পিছুটান দিয়ে দলকে বিপাকে ফেলার চেষ্টায় মত্ত। তবে এটাও ঠিক, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুটি ব্র্যান্ড হয়ে গেছে। একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার। এ দুই পরিবারই নিয়ন্ত্রণ করবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর বাইরে যে যা-ই চেষ্টা করুক না কেন, তাদেরকে বাংলাদেশের সচেতন মানুষ ‘আগাছা’ মনে করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেএটা প্রমাডুত। 

সেটা না হলে কর্নেল অলি, বদরুদ্দোজা বা নাজমুল হুদারা সামান্য হলেও হালে পানি পেতো। কিন্তু বাস্তবে তাদের কী কোনো খবর আছে? তাদেরকে কেউ হিসেবে ধরে? 

ব্যক্তি দেখলে ড. কামাল হোসেনের মতো বিজ্ঞ মানুষকে আজ অবহেলার পাত্র হতো না। নিজের ছোট্ট একটা দল গণফোরাম। সেখানেই বিভক্তি। সর্বোপরি তার মূল্যায়ন কী তিনি পাচ্ছেন? আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে না গেলে তার অবস্থান কোথায় থাকতো। সে কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না? 

অবশ্যই। কিন্তু ব্র্যান্ড নামের পরিবারের অনুগত সহচর হতে হবে। নতুবা বিজ্ঞ, পণ্ডিত এগুলোর মূল্য নেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে। 

ঠিক বিএনপির এখন যারা লম্ফজম্প দানে অস্থির। সারাক্ষণ ষড়যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত। যতই গোপন বৈঠক করুক, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, লন্ডন, আমেরিকা, নেপাল বা যেখানেই হোক না কেন। যত বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচা হোক না কেন- তাদের অবস্থান একসময়ে আস্তাকুড়েই। কিছু সিদ্ধান্ত অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিচ্ছেন। যেমন সাবেক মন্ত্রী এহসানুল হক মিলন। শওকত মাহমুদ। এর আগে শোকজ খেয়েছিলেন এমন অনেকেই আছেন, এখনকার পরিস্থিতিতে সন্দেহজনক চলাফেরার তালিকায়। এর সঙ্গে রয়েছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা বা বিভাগীয় কমিটিতে নানা সমস্যা করার দরুণ সাংগঠনিকভাবে শাস্তিপ্রাপ্তরা। সব মিলে একটা জোট হওয়ার চেষ্টা চলছে এবং খুবই সক্রিয়ভাবে। স্বাভাবিকভাবে এদেরকে পেছন থেকে সহায়তাদানের অর্থ, সাহস, সহযোগিতার অভাব হবে না এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 

শুধু এখানেই সব শেষ নয়, বিএনপি জোটও জোটের বাইরেও অনেক দল রয়েছে যারা নামে বিশাল দল কার্যত মাঠে তেমন সামর্থটুকুও নেই। সবারই ইচ্ছা বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো দল টুকরা টুকরা করতে পারলে সবার লাভ। তখন সাধারণ সাপোর্ট ভাগবাটোয়ারা হবে। সেই ভাগবাটোয়ারাতে তারাও কিছু না কিছু উপকৃত হবেন। ফলে বড় দল ভাঙার চেষ্টা কম-বেশি সবারই থাকে। 

তবে সম্প্রতি বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সাংবাদিকদের এ পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেই বলেছেন, ‘অতীতেও এমন হয়েছে। বিএনপি দলের বাইরে যেয়ে কেউ টিকতে পারেনি। এর বাইরে যেয়ে কেউ যদি সংসদ সদস্য হওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাদের দলে না থাকাই উচিত। কেউ যদি দলের স্বার্থ বাদ দিয়ে ব্যক্তির স্বার্থকে বড় করে দেখে এখানে তো কিছু করার থাকে না। এসবরা জাতীয় বেইমান হিসেবেই চিহ্নিত হয়। তবে বিএনপির মাথা (শীর্ষস্থান) ঠিক থাকলে এসবে যায় আসে না কিছু।’


শেয়ার করুন