দিল্লীর টনিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের আছেন বেশ ফুরফুরে। দলের নেতাকর্মীরাও এখন আগের চেয়ে বেশি চাঙ্গা। কিন্তু দিল্লীর কি টনিক পেলেন জি এম কাদের? তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। তবে জি এম কাদের দিল্লীর বিশেষ টনিক প্রাপ্তির পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের বেশ আস্থাশীল মনে করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে যে-ই যতো বড়ো প্লেয়ার হউন না কেনো জাতীয় পার্টিকে আগের চেয়ে যে আরো বেশি মূল্যায়ণ করতে হবে তা বোঝা যাচ্ছে। বোঝা গেছে, দাবার আসল চাল এখন জাতীয় পার্টির কাছেও চলে গেছে । দলটি এখন মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা ক্ষমতাসীন উভয়ের সাথে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতেই সমানতালে ব্যাটিং করতে পারবে-এমন শক্তিই দিল্লী থেকে নিয়ে এসেছে। এমন খবরই মিলেছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সাথে একান্তে কথা বলেন।
কোণঠাসা থেকে চাঙ্গা
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে জোট বেঁধেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দলে তার অনুসারিরা বেশ কয়েকবার বিপাকে পড়েছেন। পড়েছেন বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের রোষাণলে। এর কারণ হিসাবে বলা হয়ে থাকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীনদের অন্যতম শরিক হওয়ার কারণেই। কেননা ক্ষমতাসীনরা মনে করে আওয়ামী লীগের দয়ায় বা তাদের দেয়া ক্ষমতায় জাতীয় পার্টি এখনো রাজনীতিতে টিকে আছে। আর একারণে পান থেকে একটু চুন খসলেই নজর পড়ে জাতীয় পার্টির উপরে। অন্যদিকে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি ছিল কোনঠাসা। রাখা হতো ব্যাপক চাপে। বলা হয়ে থাকে বিএনপি আমলে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির কর্মকাণ্ড ছিল বেশ সীমিত ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেও অভিযোগ উঠেছে বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির নির্মম শিকার। এদিকে থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ ক্ষমতাসীনদের বেশ আস্থাভাজন। সেদিক থেকে জি এম কাদের দল চালাতে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়। সর্বশেষ নজির একদিকে জি এম কাদের যখন দিল্লী উড়াল দিলেন তখন খবর বের হয় জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়ে রওশন এরশাদ। যা নিয়ে জি এম কাদের বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। পরে অবশ্য দৃশ্যমান নাটকে ভুলবোঝাবুঝির অবসান হয়েছে বলে ধরা হয়। তবে জি এম কাদের ভারতে উড়াল দেয়ার আগে কেনো এমন ঘটনা ঘটলো তা আজও রহস্যাবৃতই থেকে গেলো। জি এম কাদেরের ওপর খড়গ আরো অনেক সময়ে দেখা গেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে জি এমন কাদের বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে গর্জে উঠলেই তার উপর মারাত্মকভাবে সুকৌশলে খড়গ নেমে আসে। কেননা তিনি হরহামেশাই বলতে থাকেন বর্তমান সরকার দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা তছনছ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। বর্তমান সরকার একদলীয় সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে চাচ্ছে। পেশাদার ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে এখন আর নির্বাচন হয় না, সিলেকশন করে দেয়া হচ্ছে। তিনি এ-ও বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা চাই নির্বাচন ব্যবস্থা সবসময় সরকারের আওতার বাইরে রাখতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা স্বাধীন জায়গায় রাখতে হবে। আর তার এধরনের বক্তব্য দেয়ার পর দফায় দফায় জাতীয় পার্টির বর্তমান নেতৃত্ব বিশেষ করে জি এমন কাদেরকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আর একারণে এক সময়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যেমন ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়ে নানান ধরনের আক্ষেপ করে বক্তব্য দিয়েছেন, আবার এমনটিই হচ্ছে জি এম কাদেরের বেলাতে। জি এম কাদের বর্তমানে কথা বা দল পরিচালনা করতে পারছেন নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত করে একাট রায় দেয়ার পর। এটি দিয়েছেন হাইকোর্ট।
কিন্তু অবস্থা পাল্টে গেছে
কিন্তু অবস্থা এখন অনেক বদলে গেছে জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টির। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ২০ আগস্ট ভারত সফরে গিয়েছিলেন জাপার চেয়ারম্যান ও সংসদ বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের। স্ত্রী শেরিফা কাদের ও চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মশরুর মাওলা এই সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ঢাকায় ফেরেন গত ২৩ অক্টোবর বুধবার। কিন্তু ঢাকায় বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকরা তাকে জেকে ধরেছিলেন। কি পেলেন দিল্লী থেকে? কি শুনলেন? এব্যাপারে অবাক করে দিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের বললেন, ‘বাংলাদেশে সময়মতো একটি সুন্দর নির্বাচন চায় ভারত; এবং তারা চায়, নির্বাচনের আগে এবং পরে বাংলাদেশে যাতে কোনো ক্রমেই সহিংসতা, অরাজকতা না হয়।’ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার যে চাপ, সেটি নিয়ে ভারত এক ধরনের নেগোসিয়েশন করছে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। তিনি বলেন, ‘এটা ভারতীয়রা, আমেরিকানরা বলতে পারবে। ওনাদের মধ্যে কী আলাপ-আলোচনা হয়েছে, আউটসাইডার হিসেবে এটা তো আমরা পক্ষে জানাও সম্ভব না।’ পাশাপাশি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থানের বিষয়ে ভারত কী বার্তা দিয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে গেলেন জি এম কাদের। শুধু বলেন, ‘না, বার্তা দেয়নি। আমাদের দল আমরা চালাব, ওনাদের বার্তা দেওয়ার কিছু নেই। একই সঙ্গে জি এম কাদের সাংবাদিকদের চমকে দিয়ে বলেন, ভারতে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কার কার সঙ্গে সে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং কী বিষয়ে হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি বিস্তাারিত কিছু বলতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এব্যাপারে জি এম কাদের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘কেননা, ওই আলাপগুলো ওইভাবেই করা হয়েছে। ওনারা যদি প্রকাশ করতে চান, করবেন। আমার পক্ষ থেকে ওনাদের পারমিশন (অনুমতি) ছাড়া কোনো কথা বলতে পারব না। এছাড়া আমি নিজের নৈতিক অবস্থান থেকেও কোনো বৈঠকের বিষয়ে বিস্তাারিত কিছু বাইরে বলি না।’ আর এমন নিরবতাতেই জি এম কাদেরের দিল্লী সফরের ফলাফল নিয়ে নানা গুঞ্জনের ডালপালা মেলছে।
দিল্লীর টনিক কী
জি এম কাদেরের দিল্লী সফর নিয়ে তার দলেই খোদ নানান জল্পনা কল্পনা। কেউ প্রকাশ্যেই কিছু বলছেন না। তবে বিভিন্নভাবে বেশ কয়েকজন জাতীয় পার্টির নেতা মনে করেন জি এম কাদেরের দিল্লী সফরের পর থেকে তাদের এই নেতা (জি এম কাদেরের) ও তার বেশ কয়েকজন আস্থাভাজনদের পার্টি অফিসে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই দেখেছেন। তাছাড়া তারা এটাও শুনেছেন যে, জি এম কাদেরের ওপর থেকে আর ক্ষমতাসীনরা সহজেই ছড়ি ঘুরাতে পারছে না। সামনের দিনে কথায় কথায় ক্ষমতাসীনদের নিজেদের লোক বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনাঢাসা করে রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। এমন বাস্তবতাই তারা জি এম কাদেরের দিল্লী সফরের পর থেকে লক্ষ্য করেছেন বলে দেশ প্রতিনিধিকে জানান তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাজন জাপা নেতা বলেন, সম্ভবত ভারত জাতীয় পার্টিকে এবং বিশেষভাবে জি এম কাদেরকে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ আস্থায় নিয়েছে। এমন বক্তব্যের সত্যতাও মিলে ভারতে সফর শেষে দেশে ফিরে জি এম কাদেরের একটি বক্তব্যে। জি এম কাদের বলেন, ’এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা জাতীয় পার্টিকে উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার কথাও বলেছেন। তিনি আরো তথ্য দেন, যেহেতু জাতীয় পার্টির সবার কাছে একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, তাই সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, সবাইকে একসঙ্গে করে, সুন্দর একটা নির্বাচন করতে পারলে তারা খুশি হবেন।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন দিল্লী আসলে আওয়ামী লীগ বিএনপি’র বিপরীতে বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি বিশেষভাবে বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বেশ আস্থায় নিয়েছেন- তা স্পষ্ট। কেননা ভারতেই একটি পত্রিকায় আভাস দেয়া হয়েছে কি কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর দেশটি গোস্বা। ওই রিপোর্টে বলা হয় যে, আওয়ামী লীগকে তার সকল চীন ও ইসলামপন্থী নেতাদের ত্যাগ করে অসাম্প্রদায়ায়িক এবং জনপ্রিয় প্রার্থীদেরকে বেঁচে নিতে হবে বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে পত্রিকাটিতে একিই রিপোর্টেই বলা হয়, “গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত কারণে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে এবং নয়াদিল্লি এখন সেসব উদ্বেগের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে এগিয়ে যেতে দেবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারর ব্যাপারে একটি আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক কারণে। তবে এক্ষেত্রে যে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি’র ব্যাপারে ভারত নমনীয় বা আস্থাশীল তা কোথাও কোনো রির্পোটে প্রকাশ পায়নি। কারণ বিএনপি’র বিরুদ্ধে এখনো ভারত আস্থাশীল না। কারণ বিএনপি’র সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধীতাকারী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি জামায়াতের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ব্যাপারটি ভারতের মাথায় এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই এমন শূন্য সন্দেহভরা রাজনীতির মাঠে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের ভারতের মনে কোনোভাবে রেখাপোত করেছে কি-না তা সময় বলে দেবে। তবে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমন বার্তা ও আস্থার জায়গাই তৈরি করে এসেছেন বলেই মনে করেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। আর একারণেই ঘরে বাইরে জাতীয় পার্টির পাশাপাশি জি এম কাদের আছেন বেশ ফুরফুরে।