২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০৭:৪২:০৪ অপরাহ্ন


ইউনিটি বনাম ইউনিফরমিটি
মাহমুদ রেজা চৌধুরী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৫-২০২২
ইউনিটি বনাম ইউনিফরমিটি


গত ৩০মে বিকালে কয়েকজন মিলে "জুমে" আড্ডা দিচ্ছিলাম। রোজার মাসে এবার কোথাও ইফতারেও যাই নাই। নানা কারণে যাওয়া হয় নাই। শারীরিক কিছুটা ঝামেলা, তারপর এখন নিউইয়র্কেও যানজট থাকে। তাই কোথাও গেলেই পার্কিং একটা বড় সমস্যা দেখা যায়। বেশ দূরে গিয়ে পার্কিং করলেও সেখানেও পারকিং স্পট কম। কে যেন একবার বলেছিলেন, নিউইয়র্ক শহরে মানুষ দুই কোটি, গাড়ি চার কোটি, আর পার্কিং স্পট মাত্র একটা। এটা হচ্ছে নিউইয়র্ক শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেটাই তো দেখছি এখন ক্রমান্বয়ে। পার্কিং সমস্যা এই শহড়ের সব সময়েই একটা বড় সমস্যাই বলা যায়। আগে "চারটা" কোয়াটার ঢেলে একঘন্টা পার্ক করা যেত। এখন সেটাতে লাগে "ছয়টা" কোয়াটার, মানে দেড় ডলার প্রতি ঘন্টায়।

আর যদি কোন পার্কিং গ্যারাজে পার্ক করা হয়, সেখানে প্রতি ঘন্টায় খরচ পড়ে প্রায় দশ ডলার। পাশাপাশি গ্যাসের মূল্য এখন অনেক। প্রতি গ্যালন গ্যাসের মূল্য যেটা ছিল ২:৫০-২:৭৫ ডলার, এখন সেটা প্রায় সাড়ে চার ডলার। কোন কোন জায়গায় এরও বেশি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলিতে এখনো অবশ্য সেরকম ভাড়া বাড়ে নাই, তবে সেটা ব্যবহার করা সব সময় হয়ে ওঠে না। অনেকক্ষণ লাইনেও দাঁড়াতে হয় আর পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনের গতি অনেক স্লো ইদানিং। এইসব টুকটাক কারণেও বাসা থেকে বের হওয়া আগের তুলনায় বেশ কমে গেছে অনেকেরই। পাশাপাশি পরিচিতজনদের সংখ্যাও অনেক কম এখন। 

সর্বত্রই নতুন প্রজন্মের ভিড়, এটাই তো স্বাভাবিক। এখন অনেকে যেমন বাসায় বসে অফিস করেন, সেরকমই বাসায় বসেই আড্ডাও হয় "জুম" মিডিয়াতে। শুধু আড্ডা কেন, এখন অনেক অনুষ্ঠান এখানে জুমের মাধ্যমেই হয়। গত দুই বছর থেকে এর প্রতি একটা ঝোঁক এবং চাহিদাও বাড়ছে বলেই মনে হয়। "আধুনিক সময়" বলেও যে কথা। মানুষ এখন সর্বত্রই "যন্ত্রনির্ভর" হয়ে যাচ্ছি আমরা। বিকল্প মাধ্যমগুলি এখন সংকুচিত তাই। 

প্রতি রোজার সময় স্থানীয় পত্রিকাগুলিতে কেউ না কেউ ইফতার করতে ডেকে নিয়ে যেতেন। অনেকবার ইফতার করেছি বিশেষ করে এখানকার "সাপ্তাহিক ঠিকানা"অফিসেও। গত দুই বছর সেখানেও যাওয়া হয় নাই। স্থানীয় আরেকটা পত্রিকা "দেশ" এর সম্পাদক অনুজ প্রতিম মিজান অনেকবার বলেছে ওর ওখানে গিয়ে একদিন ইফতার করতে। সেখানেও যাওয়া হয় নাই।

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে শরীরের উপর দুইটা অস্ত্রোপচার হওয়ার পর, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া দুইটাই এখন কিছুটা সীমিত বলা যায়। রোজার মাসে খুব জরুরী কিছু না থাকলে সাধারণত বের হই না। শুরুর দিকে রোজার মাসে একাধিক ইফতার পার্টিতেও যেতাম। সেটা কমে গেছে এখন অনেক প্যানডেমিকের সময় থেকেই। পাশাপাশি কমে গেছে পরিচিত মুখের সংখ্যাও এদিকে, সেদিকেও। এর একটা বড় কারণ, বয়স এবং সময়, দুইটাই যে পাল্টাচ্ছে। পুরাতনকে সরে যেতেই হয় নতুনদের জন্য।

গতকালকে কয়েকজনের উৎসাহে বিকালে একটা জুম আডডায় ছিলাম। নানান গল্প, এই নিউইয়র্ক শহরের সাম্প্রতিক অতীত ও বর্তমানকে নিয়েই। বেশ জমে ছিল সেই আডডাটা। একজন বললেন, সে ঢাকা থেকে আমার সম্প্রতি প্রকাশিত দুইটা বই সংগ্রহ করেছেন, একটা, "নিঃশব্দ শব্দাবলী", অপরটা, "ইছামতি থেকে ইস্ট রিভার"। দুইটা বই তাঁর পড়তে ভালো লাগছে বললেন। বলেন, " ইসামতি থেকে ইস্ট রিভার"

বইটা নাকি আমার নতুন ধরনের একটা বই। যদিও প্রথমদিকে এই বইয়ে বেশ কিছু বানান বিভ্রাট আছে, সেটা দৃষ্টিকটু হলেও, যেসব পাঠক আমাকে চিনে এবং আমার লেখা পড়েন, তারা বুঝতে পারবেন কি বলতে চেয়েছি। তবে তার একটা পরামর্শ আছে, এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের সময় ভুলগুলি যেন সংশোধন করে নিতে বলি প্রকাশককে। 

আমার পরবর্তী বই কোনটা, বিশেষ করে এখন যেটা লিখছি, অটোবায়োগ্রাফি, সেটা কবে বই আকারে বের করা হবে জানতে চাইলেন। আমার পরবর্তী বই ইনশাআল্লাহ আশা করি হয়তো এই বছরে বের হবে, নাম, " আশা আশংকর বাংলাদেশ" এই বইটা লেখা হয়েছিল আজ থেকে আরো তিন চার বছর আগে। কিন্তু বইটাকে সাজাতে, গোছাতে গিয়ে লম্বা একটা সময় নিয়ে নিলাম। এটাও একটা বিষয়কে কেন্দ্র করেই লেখা বলতে এটা "কলাম" সংকলন না। আমার সময়ে দেখা ১৯৬৯-২০২০ এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু বাস্তবতার কথা আছে বইটাতে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু অতীত ইতিহাস, কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অবদান, ইত্যাদি। জানিনা পাঠকের কাছে বইটা কেমন লাগতে পারে। এছাড়া বর্তমানে যেটা লিখছি "অটোবায়োগ্রাফি", এটাও ইনশাআল্লাহ, ২০২৩ অথবা এর আরেকটু আগে বের হতেও পারে। দেখা যাক। কোন চাওয়া অথবা ইচ্ছাই তো পূরণ হয় না, আল্লাহ্ না চাইলে।

কথা প্রসঙ্গেই একটা বিষয় উঠে আসে, বিষয় "ইউনিটি বনাম "ইউনিফরমিটি" নিয়ে আমাদের কথা বিনিময়। এই বিষয়ে একটা সংক্ষিপ্তত আডডাও বলা যায়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, "ইউনিটি" মানেই না এখানে "ইউনিফর্মটিও" থাকতেই হবে। কারণ ইউনিটি এবং ইউনিফর্মিটি সম অর্থ বহন করে না। একটা হল ঐক্য যেটাকে আমরা "ইউনিটি" বলি। আর ইউনিফর্মিটি বলতে সাধারণত একটা "সমতা" অথবা "অভিন্নতা" বুঝি। 

"বায়োলজিক্যাল" এবং "সাইকোলজিকাল" কোনো অর্থেই "অভিন্নতা" কথার বাস্তবতা কিন্তু চোখে পড়ে না ব্যাপক অর্থে। বরং এই অভিন্নতা না থাকার কারণেই বৈচিত্রতা বিরাজ করে সব বস্তু এবং মানুষের আচার-আচরনে। সেটা অভিন্নতার চাইতেও সুন্দর। একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের নানা দিকেই পার্থক্য থাকতেই পারে। সৃষ্টিকর্তাও তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে কোথাও একেবারে অভিন্ন করে সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিতেই একটা ভিন্ন বৈচিত্র আছে। সেটা মানুষের মধ্যেও আছে। 

তাই মানুষের প্রশ্নে আমরা "ইউনিফর্মিটি" খুঁজলে খুজে পাব কিনা সন্দেহ আছে প্রচুর। "ভিন্নতার" মধ্য দিয়েই অভিন্ন ঐক্য বা "ইউনিটি" হতেই পারে। আমরা শেয়ার করলাম যে, ইউনিটির জন্য একটা স্তম্ভ যথেষ্ট। সেটা, কোন দল বা গোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে একটা ঐক্যমত থাকা। সবাই মিলে সেই লক্ষ্যপথে বৃহত্তর স্বার্থে মিলিত হয়ে কাজ করা। যেমন, ধরা যাক আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং যুদ্ধের কথা। সেখানে কিন্তু ইউনিফর্মমিটি ছিল না, তবে "ইউনিটি" ছিল আমাদের মধ্যে। সেই ইউনিটিটা ছিল আমরা বৃহত্তর স্বার্থে একমত ছিলাম যে, আমাদের স্বাধীনতার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, আমাদের শোষণ মুক্তি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায্য অধিকার ভোগ করা। আমাদের মধ্যে অনেক রকমের ভিন্নতাও ছিল তবে একটা বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে সেই ভিন্নতাকে আমরা আমাদের ঐক্যের পথে বাধা করেও দেখিনাই তখন।

আরো শেয়ার করলাম যে, সম্প্রতিককালে আমাদের বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইউনিটি বলতে কেবল Uniformity কে ই অগ্রাধিকারে দেখতে চাই অথবা গুরুত্ব দিই বেশি। যে কারণে আমাদের মতামতে কোন ভিন্নতাকে গ্রাহ্য করিনা, কেয়ার করি না, তাই শ্রদ্ধাও করি না। অথবা মেনে নিতেও চাইনা। পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থেকে অথবা সহনশীল না হলে কোন রকমের "ইউনিটি" সমাজে সৃষ্টি হতেও পারে না। তাই বড় ঐক্যে ফাটল ধরে যায়। এই ব্যাপারটা কিন্তু ব্যক্তিগতভাবেও লক্ষ্য করেছি ১৯৭২ থেকে বেশি বেশি করেই। এখন পর্যন্ত সেটাই আছে সমাজের বিভিন্ন সংগঠন এবং নানান ক্ষেত্রে। 

আমাদের আলোচনাতে আরেকটা বিষয় উঠে আসছে সেটা বাঙালী জাতির রূপান্তর প্রশ্ন। বাঙালীরা সামরিক জাতি না, এটা হয়তোবা একাত্তরের পর সে ভাবে বলাও সম্ভব না। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে আমরা সামরিকভাবে যুদ্ধ করেই তাড়িয়ে ছিলাম। তবে এটা এখন অনেকেই মনে করেন, বাঙালীরা সামরিক জাতি হয়েছে এটা বলতেও একটু চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। সামরিক জাতি বলতে কী বোঝায়? 

পৃথিবীতে এমন বহু মানবগোষ্ঠী আছে যারা সমাজ হিসাবে সর্বদাই সশস্ত্র, ব্যক্তিগত পারিবারিক অথবা গোত্রীয় কারণে কথায় কথায় অস্ত্র ব্যবহারে এবং পরস্পর হানাহানিতেও অভ্যস্ত। যুদ্ধে তারা নির্ভয় ও নিপুন যুদ্ধ তাদের পেশা। স্বদেশ রক্ষায় এরা বীর সৈনিক, অন্য রাজ্য গ্রাসে এবং নিরস্ত্র জনসমাজকে দমনে নিষ্ঠুরতম যন্ত্র।  অনেকেই মনে করেন সাধারণত এদেরই বলা যায় সামরিক জাতি।

সেই অর্থে বাঙালী সামরিক জাতি নয়, উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবই তার জীবনে অনুপস্থিত। যুদ্ধ তাদের পেশা নয়। তবে বাঙালি জাতি যুদ্ধ করতে পারে না, যুদ্ধ কে ভয় পায়। এই কথাটাও আজকে সত্যি না।

পাশাপাশি একাত্তরে আমরা প্রমাণ করেছি, অসামরিক জাতি বলতে যা বোঝায় সেটাও আমরা নই। 

প্রসঙ্গটা আসে যখন আমরা অনেকে মনে করি যে, ইদানিং আমরা খুব বেশি "সামরিক" একটা মনস্তত্ত্বকে ধারণ করতে যাচ্ছি অথবা ধারণ করছি "প্রতিপক্ষের" প্রশ্নে। আমরা এখন সপক্ষ বা Unity বলতে যা বুঝি সেখানে কেবল Uniformity খুঁজি। সমাজ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে পরমত সহিষ্ণুতার চাইতেও বেশি পরমতকে মাটিচাপা দিতে, প্রয়োজনে ধারালো অস্ত্র হাতেও কৃত্তিম ইউনিটি ধরে রাখতে। তা কি সম্ভব! এই কারণেও আমাদের মধ্যে প্রায় প্রতিদিন নানান সংঘাত বাড়ছে ঐক্য কমে যাচ্ছে।

আমাদের এই আডডা শেষ হবার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম একটা "হুবার" গাড়িতে কিছু "ইফতার বক্স" পাঠালেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা। ছোট্ট একটা নোট দিলেন, তাঁর নামটা যেন কোনোভাবেই কোথাও প্রকাশিত না হয়। "জুম আডডা" হলেও ইফতারের এরকম আপ্যায়ন সাধারণত দেখা যায় না। এরকমের আডডা আরো কিছুদিন আগে শুরু হলে আরো ভালো হতো। আড্ডাতে আরো মানুষ উপস্থিত থাকতেন, আলোচনাও আরো বেশি জমে উঠত। পরে শুনেছি, এই আডডায় যতজন উপস্থিত ছিলেন, প্রত্যেকের বাড়িতেই "ইফতার বক্স" পৌঁছে গেছে। চমৎকার একটা আয়োজন ছিল বলতেই হবে। 


লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মে, ১, ২০২২ নিউইয়র্ক


শেয়ার করুন