১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০১:১৬:৩৭ অপরাহ্ন


জনমনে প্রশ্ন মানিক - তুরিনের ‘স্যাবটাজ’
ভেস্তে গেল গনকমিশনের প্রজেক্ট?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৫-২০২২
ভেস্তে গেল গনকমিশনের প্রজেক্ট?


গণকমিশনের ১১৬ জন আলেম ও এক হাজার মাদ্রাসাকে অভিযুক্ত করে দুদকে দেয়া শ্বেতপত্র-অভিযোগের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের যে প্রজেক্ট, সেটা কোন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে এটা নিয়ে জনমনে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে যেখানে ৭৪ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পাচার হয়ে যায় বলে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এর সেই প্রতিবেদনের কথা।

সেখানে যাদের কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে, সেখানে আলেম ওলামাদের একজনেরও নাম নেই। বাণিজ্য করার কোনো প্রমাণাদিও নেই সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসাসমূহের। ফলে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারকারীদের ব্যাপারে মানিক-তুরিন অন্ধ বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধি সেখানে কেন হঠাৎ করে দেশ বরেণ্য আলেম ওলামাদের নিয়ে মাথা ব্যাথা। 

কেন তাদের ওয়াজ বাণিজ্যের কথা এটা বোধগম্য নয়। তবে ধর্ম ব্যাবসায়ী বলতে যদি ইসকনের নেতা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদেরও দুই/একজনের নামও উল্লেখ থাকতো ওই তালিকায় তাহলেও সেটাকে কিছুটা গ্রহণযোগ্যহতে পারতো। শুধুই ইসলামপন্থী আলেমদের নিয়ে মানিক-তুরিনদের উঠে পড়ে লাগাতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিষয়টা খটকা লেগেছে। দুদকে অভিযোগ পত্র জমা দেয়ার পর থেকেই প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে সর্বত্র মানিক-তুরিনদের এটা কিসের প্রজেক্ট। এমন গবেষণা করতে শত শত কোটি টাকা খরচা হয়েছে। ওই অর্থের যোগান কার? কী সে উদ্দেশ্য। হঠাৎ করেই দেশের আলেম সমাজকে খেপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যটা কী? 

বাংলাদেশে এখন চলছে দ্বাদশ নির্বাচনের আবহ। এমনি সময় নানা সমীকরণ রাজনীতির মাঠে। কোনো দলই চাইবে না তার ভোটের মাঠে এমন কোনো কার্যকলাপ হোক, যা সরাসরি ভোটের উপর প্রভাব পড়ে। যেহেতু কথিত আছে ‘ঘাদানিক’ এর পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ যুক্ত। কিন্তু তারাও এ মুহূর্তে এমনটা যে চাইবেন না এটা স্পষ্ট। তাহলে ‘ঘাদানিক’ এর পৃষ্ঠপোষকতায় মানিক-তুরিন কাদের স্বার্থ হাসিলে এমন প্রজেক্ট নিয়ে মাঠে? কাদের অর্থ পকেটস্থ করে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির মিশনে সচেষ্ট হলেন? 

তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রজেক্ট আওয়ামী লীগের দিকে আঙ্গুল উঠলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরাসরি এর ‘ভিত্তি’ নেই বলে উড়িয়ে দেয়ায় প্রশ্ন আরো ঘনীভুত হচ্ছে। তাহলে এর পেছনে কারা? এ প্রশ্নটাই এখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

২০১৯ এর নভেম্বরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল যে পেশাগত অসদাচরণ, শৃঙ্খলা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। যেটা তুরিনের জন্য মোটেও কাম্য ছিল না। তিনি অনুধাবনই করতে পারেননি এমন কান্ডে এতবড় শাস্তি তিনি পাবেন। সে থেকেই তিনি বিভিন্নস্থানে উপেক্ষিত। এটাতে তিনি বেশ ক্ষিপ্ত। এবং সেটার প্রতিশোধ নিতেই সম্ভবত ‘স্যাবটাজ’ এর মিশনে নেমেছেন? 

অপরজন এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, যিনি বেশ কয়েকটি বিতর্কিত মামলার জন্য আলোচিত। অবসর গ্রহণের পরে মামলায় রায় দেওয়ার জন্যও তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত।

ইদানিং তাকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মিশনে তৎপর দেখা যাচ্ছে। এর আগে তাকে একবার প্রধান বিচারপতি হওয়ার তালিকাতেও বিবেচনাধীন রাখা হয়েছিলো। কিন্তু তার আওয়ামী লীগে ‘অতিভক্তি’ সম্ভবত পছন্দ হয়নি রাষ্ট্রপতির। তাই বাদ পড়েছেন। সে কষ্টটা তার আছে। বিভিন্ন টক শোতে তিনি যেভাবে যারতার সাথে যেভাবে অ্যাটাকিং মুডে কথা বলেন, একজন বিচারপতি কিভাবে এতটা উগ্র মেজাজের হয়- সেটা নিয়ে কথা উঠছে। 

একই সঙ্গে পেশাগতজীবনে তার সঙ্গে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীনদের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারছেন না। তবে তার চেষ্টার কমতি নেই। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে অতি ঘনিষ্ঠ হওয়ার ওই প্রচেষ্টার একটা মাধ্যম অনেকে মনে করেন। যদিও যা ভেস্তে যাবার উপক্রম। কারণ সার্বিক বিবেচনাতে নির্বাচনমুখর একটা দল কখনই সমাজের একটা শ্রেণীর লোকজনকে ক্ষেপাবে না। তাছাড়া আওয়ামী লীগ আলেম ওলামাদের বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসাকে অনেক কিছু দিয়েছেন সেই ২০১৩ সনের হেফাজতের শাপলা চত্বরের ঘটনার পর। তাদের বিরুদ্ধে কেন যাবেন তারা। বরং আওয়ামী লীগকে বিব্রত করতেই হয়তো মানিক-তুরিনদের ওই প্রজেক্ট সেটা এখন আওয়ামী পন্থী অনেক বুদ্ধিজীবীরাও বলছেন।    

 কী ছিল গণকমিশনের রিপোর্ট 

‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন প্রকাশিত শ্বেতপত্রের যে কপি দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তাতে এক হাজার মাদরাসা ও ১১৬ জন ধর্মব্যবসায়ী/ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ইসলাম,তথা কোরআন-হাদিস-ফেকাহ’র বয়ানকারীদের (ওয়াজেইন) সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়েছে। 

সম্প্রতিকালে মানবাধিকার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনে এই শ্বেতপত্রের কপি হস্তান্তর করেন গণকমিশনের চেয়ারপার্সন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, কমিশনের সচিবালয়ের সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, সদস্য শহীদ সন্তান আসিফ মুনীর তন্ময় ও ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী।

এই গণকমিশন সম্প্রতি ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১০০-এর বেশি।

ওইদিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে শ্বেতপত্র তুলে দেওয়ার পর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার শ্বেতপত্রের কপি দুদক চেয়ারম্যানের কাছে দিয়েছি। তিনি শ্বেতপত্র ভালো করে পড়ে দুদকের আইনের মধ্যে যতটুকু করা সম্ভব ততটুকু করবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। দুদকের আইনের বাইরে কিছু থেকে থাকলে সেটা করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা যেমন সিআইডি কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তা পাঠিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবেন বলে জানিয়েছেন। ’ 

তিনি বলেন, ‘মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতা কর্মকাণ্ডের ছবিসহ বিবরণ, ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি এবং এসব ঘটনার স্থায়ী সমাধানের জন্য শ্বেতপত্রে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। আমরা তদন্তে ধর্ম ব্যবসায়ী, হেফাজত, জামায়াত মানি লন্ডারিং করছে, এ ধরনের তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে বিশেষ করে যারা এসব ঘটনায় দায়ী তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করেছি। আশা করছি, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িকতার শিকড় উপড়ে ফেলতে এই শ্বেতপত্র অপরাধ দমন সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিশেষ করে ‘দুদক’কে সহযোগিতা করবে। ’

এ সময় ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘গণকমিশনের এই শ্বেতপত্রে ১০০০ মাদ্রাসা ও ১১৬ জন ধর্মব্যবসায়ী/ওয়াজকারীর ওপর তদন্ত করে তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করেছি। আশা করছি, আমাদের তদন্তের ওপর ভিত্তি করে দুদক তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারবে।’

গণকমিশনের সদস্যরা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই শ্বেতপত্র স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধদের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনুসন্ধান এবং এর উদ্দেশ্য অনুধাবনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সহায়তা করবে।

পরবর্তিতে গণকমিশনের আইনি কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘তাঁরা একটি বই প্রকাশ করেছেন, ২০০০ দিনের সন্ত্রাস। এটার ভেতরে কী লিখেছেন, তা জানি না। এগুলো দেখতে হবে।’  গণকমিশনের এই তালিকা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যাঁদের নামে তাঁরা দুর্নীতির দায় দিচ্ছেন, এগুলো আমরা তদন্ত করিনি। দেখিও নি। কাজেই এগুলো না দেখে বলতে পারব না। যে অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হবে না, সেই অভিযোগ কখনো আমলে নেওয়া হবে না।’

তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমীর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, জঙ্গি অর্থায়ন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ এনে ১১৬ দেশবরেণ্য ওলামা-মাশায়েখ এবং ইসলামি আলোচকের তালিকা করে তা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দিয়ে ‘তথাকথিত গণকমিশন’ চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।

গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে হেফাজতের আমির আরো বলেন, এসব বানোয়াট বক্তব্যের কারণে দেশে চরম অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।বিবৃতিতে হেফাজতের আমির বলেন, জঙ্গি অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে কাজ করছেন এমন অভিযোগ এনে সম্প্রতি ১১৬ ওয়ায়েজিনের (ধর্মীয় বক্তা) একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দিয়েছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমন্বয়ে গঠিত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে ‘গণকমিশন’।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। মুহিব্বুল্লাহ বলেন, ‘আমরা আজ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত গণকমিশনের করা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এই ভুঁইফোড় সংগঠনটি বরাবরের মতোই নিজেদের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে। তাদের এই শ্বেতপত্র যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং মিথ্যা তথ্যে ভরপুর, এটি সমগ্র দেশবাসীর সামনে দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার।’

দেশবরেণ্য ইসলামি আলোচকদের নামে অমূলক ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করে তথাকথিত গণকমিশনের দায়িত্বশীলেরা নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাই হারিয়েছেন বলে দাবি করেন হেফাজতের আমির। তিনি বলেন, বাস্তবতাবিবর্জিত এসব কথাবার্তা বলে নিজেদের জাতির সামনে চরম উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছেন তাঁরা।

মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব বানোয়াট বক্তব্যের কারণে দেশে চরম অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যারা এসব উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড করছে, সরকার যেন তাদের শক্ত হাতে প্রতিহত করে।’


শেয়ার করুন