২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ৬:১৬:৩২ অপরাহ্ন


আন্দোলনের মাঠে বিএনপি কেন ঢিমেতালে?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৩-২০২২
আন্দোলনের মাঠে বিএনপি কেন ঢিমেতালে?


সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাঠটা কেমন যেন ঝিমিয়ে? নেই কোনো হৈ চৈ। এ কৃতিত্বটা আওয়ামী লীগ সরকার নিতেই পারে। কারণ জোরালো কোনো ইস্যু নেই। কেন শুধু শুধু বিরোধীরা মাঠে আন্দোলনের নামে মানুষকে কষ্ট দেবে? আসলেই কী তাই? দেশে কী কোনো ইস্যুই নেই, আন্দোলনের। উত্তরটা সহজ। থাকলে আন্দোলন হতো। বাজারে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিদ্যমান। মানুষ অসহায়, ছুটছে দিগি¦দিক। এটা উপলক্ষ করেই অনেকদিন পর আধাবেলার (২৮ মার্চ) একটা হরতাল দিয়েছিল বামপন্থীরা। পালিতও হয়েছে অনেকটা ঢিমেতালে।


ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে বিএনপি শীর্ষ নেতৃবৃন্দ : ফাইল ছবি 


কিন্তু সরকার যে একের পর এক ইস্যু তৈরি করছে বা ইস্যু হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোকে ক্যাশ করে বিরোধীদল যে মাঠে নামছে না, তার কারণটা কী। বিশেষ করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সঙ্গে থাকা জোটরা কেন ধীরে চলো নীতিতে? দীর্ঘ তিন টার্ম ক্ষমতার বাইরেই শুধু নয়, দলটি প্রায় ৩৫ লাখ মামলা হজম করে চলছে দলের নেতাকর্মী। তাহলে এতো ইস্যুর পরও সে দলটি চুপ করে থাকে কেন? এ প্রশ্নটা এখন মুখে মুখে। সরকার সমর্থকরা এ ব্যাপারে কথা বলেন। তারা বলছেন, ‘বিএনপিকে মানুষ পছন্দই করে না। অতীতে দলটি এতো দুর্নীতি করেছে, মানুষ সেগুলো ভুলতে পারছে না। যে দলের শীর্ষ দুইজন দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মানুষ তাদের কথা কেন শুনবেন। তাই বিএনপির কথায় কান দেয় না তারা।’ 

আসলেই কী তাই? এটা কী আওয়ামী লীগের নেতাদের বলার জন্য বলা, রাজনীতির মাঠের কথা, নাকি মনেপ্রাণেও তারা এটা বিশ্বাস করেন? এর আসলে কোনো ব্যাখ্যা নেই। কারণ বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই নেই আন্দোলনের মাঠে। সেই ২০১৪ সনের পর একেবারেই সাইডলাইনে, চুপচাপ। তাই বলে তারা বসে রয়েছে তা-ও না। দলের শীর্ষ পর্যায়ে সরাসরি, ভার্চুয়াল অনেক ধরনের বৈঠকই হয়েছে। অনেক সিদ্ধান্তও। সে অনুপাতে তারা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কিন্তু একটা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলকে তো ধীরে বা দুর্বল কর্মসূচি দিয়ে হটানো যায় না। বিএনপি নিজেও এটা জানে। তাহলে চুপ কেন তারা? 

এর বেশকিছু বিশ্লেষণ রয়েছে। অনেক কারণেই বিএনপি এখন শুধু মাঠের লড়াইয়েই বিশ্বাসী নয়। পরিস্থিতি অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায় বলে জানা গেছে। তাছাড়া এ বছরের গোড়ার দিকে সহযোগী বেশকিছু দলের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানেও তারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিএনপি তাকিয়ে আন্তর্জাতিক মুভমেন্টের দিকে। বলার অপেক্ষা রাখে না বর্তমান সরকার যেভাবে প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন, সে রকম অবস্থা গত ৫০ বছরেও হয়নি। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত এ তিনের সঙ্গে নানা ইস্যুতে কিছুটা কোণঠাসাই ছিল বাংলাদেশ, এখনো আছে। কারণ চীনের উত্থান ও প্রভাব ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ যখন এক, তখন বাংলাদেশ-চীনের বন্ধুত্বের স্বার্থে কিছুটা চীনমুখীই ছিল। দেশের মেগা কিছু প্রজেক্ট ও অবকাঠামো উন্নতিতে চীনের সহায়তার হাত ভুলতে পারবে না বাংলাদেশ। কিন্তু সমস্যা ভারত ও মার্কিনিদের একেবারে বিপরীত অবস্থানে চীন, এটাই সমস্যা। 

ভারত কিছুটা অসহায়ও। বাধ্য হয়ে চীন ঠেকাতে মার্কিনিদের পক্ষে তারা। অপরদিকে ভারতের আশীর্বাদের কথা কার না জানা। ফলে বাংলাদেশ দোটানায়। এরপর মার্কিনিদের স্যাঙ্কশন ইস্যুটা বেশ ভাবিয়ে তোলে বেশ অসহায় হয়ে যায়। এরপর থেকেই অস্তিত্ব রক্ষায় আবারো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির চেষ্টা। সমস্যাটা তৈরি করেছে আরেক বন্ধুপ্রতিম রাশিয়া। ইউক্রেনে তাদের হামলার জেরে বিশ্বরাজনীতিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য, যেটা চাইলেই কিছু করা সম্ভপর হচ্ছে না। জাতিসংঘের অধিবেশনে একবার শান্তি ভোটে নীরব থাকার পর কম জল ঘোলা হয়নি। প্রচণ্ড রাগান্বিত হয় মার্কিনি ও তার মিত্ররা। যার ফলশ্রুতিতে লিথুনিয়া করোনা টিকা বরাদ্দ বাতিলও করে দিয়েছে। 

এরপর বাংলাদেশে মার্কিন এক কর্মকর্তা নুল্যান্ডের সফর ও  তার সঙ্গে সংলাপ। এরপরই জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে আরেক বন্ধু দেশ রাশিয়ার বিপক্ষে যেয়ে মানবতার কথা বলে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশ। প্রথমবার নীরব থেকে এবার আবার ভোট প্রদানটা যে একটা চাপের মধ্যে থেকে সেটা অবশ্য সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা কোনো মানবতাবিরোধীকে সমার্থন করি না। এখানে কেন, কী- এ ব্যাখ্যা এখন নয়। প্রসঙ্গ কেন বিএনপিসহ বিরোধীদল রাজনীতি ও আন্দোলনের মাঠে চুপ।  

আসলে সরকার একবার ভোটদানে বিরত থেকে রাশিয়াকে সমর্থন, আবার ভোট দিয়ে রাশিয়ার আগ্রাসীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়াটা কেন? এ নিয়ে তুমুল আলোচনা। বিএনপি বিশ্ব পরিমণ্ডলের এ পলিটিক্সটাই উপভোগ করছে, দৃষ্টি রাখছে। বিএনপি আন্দোলন করে যে প্রেশার তৈরি করতো, সেটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলই করছে। ফলে একটা নিরপেক্ষ ও জনগণের ভোটের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইউএ ও মার্কিনিদের চাপ সামাল দিতেই সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে আন্দোলন করে শুধুই মানুষদের কষ্ট দেয়া কেন- সম্ভবত এটাই ভেবে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। তাই বিএনপি এ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের যে চাপ বাংলাদেশের ওপর সেটা সরকার কীভাবে সামাল দেয় সেটা পর্যবেক্ষণ করছে। 

বিএনপি যখন আন্দোলনে নামা নামা ভাব করছিল গত দেড় বছর থেকে। তখন বেশ শক্ত টোন ছিল সরকারের। কিন্তু মাঝে মার্কিনিদের স্যাঙ্কশনসহ বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণে বেশ কোণঠাসা। এর প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতেও। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এখন আর অ্যাটাকিং মুডে কথা বলছে না। টোন নামিয়ে কথা বলছে। সহনশীল রাজনীতি করছে এখন তারাও। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। বাইডেনের গণতান্ত্রিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ার পর থেকে দেশে গণতন্ত্র রয়েছে এটা দেখাতে হলে অবশ্যই বিরোধী মতকে সম্মান, তাদের রাজনীতি করতে দিতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে বিরোধী মতের ওপর আর দমন পীড়ন নয়। তাদের মতকে সম্মান জানাতে হবে। সে চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। মাঠে প্রচণ্ড আন্দোলন করার সুযোগ বিএনপির। তবু চুপ, হয়তো শুধু পরিস্থিতি অনুধাবনে অথবা নতুন কোনো চিন্তাভাবনা মনে চেপেই চুপচাপ এগোচ্ছে বিএনপি। একেবারেই যে চুপ তা নয়। আউটডোরে অল্প-বিস্তর মিটিং বা জনসভাতে কথাবার্তা আর ইনডোর সভা সেমিনারে বক্তব্য, এটুকুই। তবে এটা ঠিক বিএনপির এ ধীরে চলার রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কেন তাদের এ নীরবতা (প্রয়োজনীয় আন্দোলন না করা) কোনো রহস্য রয়েছে কিনা সেটাও খোঁজার চেষ্টা করছে পর্যবেক্ষক মহল।  

 


শেয়ার করুন