১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ১১:০৬:৩৮ অপরাহ্ন


সংসদে মেননের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড়
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৬-২০২২
সংসদে মেননের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় রাশেদ খান মেনন এমপি/ফাইল ছবি


জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপির বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় হচ্ছে। এটা নিয়ে তার নিজ দলে যেমন আলোচনার ঝড় বইছে, তেমনি চলছে ১৪ দলের প্রধান শরিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেও। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তিনি আসলে তার এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছেন? নিচে দেশ পত্রিকার পাঠকদের জন্য মেননের বক্তব্যের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। 

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভাপতি এবং ঢাকা-৮ আসনের সংসদ। জাতীয় সংসদে দেয়া গত ১৯ তারিখ রাতে তিনি তার বক্তব্যের একেবারে শেষে বলেছেন, ইতিমধ্যেই ‘রেজিম চেঞ্জের’ খেলা শুরু হয়েছে। মার্কিনিদের বন্ধুরা এমনভাবে কথা বলছেন, যে খোদ স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের পিছনে রয়েছে। সাতদিনের মধ্যে সরকার ফেলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। আমি বলি ষড়যন্ত্রের খেলা বন্ধ করুন। 

রাশেদ খান মেনন এমপি তার বক্তব্যের শুরুতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করতেও ছাড় দেননি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, বাজেট আলোচনায় সংসদের ভূমিকা কার্যত ‘শোনাউল্লাহ’ আর ‘বকাউল্লাহ’র। আর শেষে ‘হ্যাঁ’ বলার। বাজেটের সাথে সংসদের কমিটিসমূহের সংশ্লিষ্টতা নেই। ভারতের পার্লামেন্টে বাজেট পেশের পর দুই থেকে চারদিন সাধারণ আলোচনার পর বাজেট বিভিন্ন স্থায়ী কমিটিতে চলে যায়। তার রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকারি দল-বিরোধীদল স্থিরকৃত মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ওপর আলোচনা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত বাজেট প্রণয়নের আগে সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের সাথে আলোচনা করতেন, মাননীয় অর্থমন্ত্রী সেটাও তুলে দিয়েছেন।

মেনন অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে করে সংসদে দেয়া বক্তব্যে বলেন, বাজেট প্রস্তাবে তিনি সংসদ প্রণীত আইনও বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। সংসদ প্রণীত দুদক আইন ও মানিলন্ডারিং আইন দুটোতেই অর্থপাচার দণ্ডনীয় অপরাধ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৯ পৃষ্ঠায় অর্থপাচার সম্পর্কিত উপ-শিরোনামে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। দু’হাজার কোটি টাকার অর্থপাচারে অভিযুক্ত সাবেক স্থানীয় মন্ত্রীর ভাই খন্দকার মোহাতে মোনেম জামিনের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছে এটা এতো বড় অপরাধ যে জামিনও দেয়া যায় না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন,অর্থপাচার সংঘবদ্ধ অপরাধ। নৈতিকতার কথা বাদ দিলাম। কারণ পুঁজি যেখানে লাভ দেখে, সেখানে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতেও রাজি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেখানে সুখ আছে সেখানে টাকা যায়। তাই অর্থপাচারকারীদের ৭ শতাংশ সুদ নিয়ে সেই সুখের সুলক সন্ধান দিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী সেদিন বলেছেন তিনি এটা করবেনই, মাঝপথ থেকে ফিরে আসার লোক তিনি নন। কেবল সংসদ দিয়ে তিনি এটাকে বৈধ করে নিতে চান।

মেনন তার বক্তব্যে কয়েকজন অর্থনীতিবিদের বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন যার নোট পড়ে আমি অর্থনীতিতে জেলখানায় বসে এম.এ পাস করেছি, বলেছেন প্রস্তাবিত বাজেট বিত্তবান, ব্যবসায়ী, মুনাফাভোগী ও অর্থপাচারকারীদের স্বার্থ দেখা হয়েছে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার যেসব খাতে অগ্রাধিকার দিয়েছে সেটা তার ঘোষিত নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা দরিদ্রবান্ধব নীতি গ্রহণ সরকারের পঞ্চবার্ষিকী ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় থাকলেও বাজেট বস্তুত বৃহৎ ব্যবসাবান্ধব। তিনি বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর হ্রাস করার কথা বলা হলেও তা বড় ব্যবসায়ীদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু গত দুই বছরে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। এরা কোভিড পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় খুব বেশি সহায়তা পায়নি।

 আবার বাজেটে করপোরেট করে যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা এদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বাস্তবতা হলো এই খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কাজ করেন। অর্থনীতিবিদ এই এইচআর মনছুরও এমনই কথা বলেছেন। মেনন স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি সিপিডির কথা বললাম না। তাতে অর্থমন্ত্রীর গাত্রদাহ হবে। তবে সব অর্থনীতিবিদের মতামতকে উড়িয়ে দেয়াটা যে গোয়ার্তুমি হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাজেট বরাদ্দে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানকেও অবাক করেছে। তিনি বলেছেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা যাতে বাজেট বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। বাজেটের শতাংশ হিসেবে এটি ১৯ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশ হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চাপে থাকা এই বরাদ্দ অবাক করেছে। বিশেষ করে ওএমএস-এ বরাদ্দ ২২৩ কোটি টাকা কমে যাওয়া এবং অতি দরিদ্রের কর্মসৃজন কর্মসূচির বরাদ্দ ৯৫ কোটি টাকা কমে যাওয়াটা এ সময়ের জন্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অতি দরিদ্রের ১০ টাকা কেজির ৩০ কেজি চালের দাম বাড়িয়ে কেজিতে ১৫ টাকা করা হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফিতীর প্রেক্ষাপটে সম্ভবত এটা করা হয়েছে। তবে এ সমন্বয়টি এখনই না করাটা কাম্য ছিল, কৃষিমন্ত্রী বলেছেন মোটা চালের দাম বাড়েনি। তাহলে প্রশ্ন গরিবের চালে এই মূল্যবৃদ্ধি কেন। 

মেনন আরো বলেন, শেখ হাসিনা জানেন তার ক্ষমতার ভিত এই গরিব-নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ। ক্ষমতার পরিবর্তনের সামান্যতম সম্ভাবনা দেখলেই বড়লোকেরা আমলাগোষ্ঠী মুহূর্তের মধ্যে রঙ বদলাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাই দেখা গিয়েছিল। অর্থমন্ত্রী ল্যাপটপের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছেন। কোভিডের সময় ছাত্ররা অনলাইনে ক্লাস করেছে। ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের অসুবিধা সে ক্ষেত্রে গরিব-মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বিপদে ফেলেছিল। অর্থমন্ত্রী ল্যাপটপের আমদানি শুল্ক ও ইন্টারনেট সেবার  করারোপ এই ডিজিটাইল ডিভাইসকে আরো বাড়াবে। তিন দফার বাজেট অর্থমন্ত্রীর মেডিটেশনকে মানসিক স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বিধায়, একে করের বাইরে রেখেছেন। কোভিডের প্রতিক্রিয়ায় যখন মানুষের মনের প্রশান্তি বিপর্যস্ত, সেখানে মেডিটেশনের আশ্রয় নিলে তাকে বেশি মূল্য দিতে হবে কেন? 

তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গে মেনন বললেন, আমরা যখন আলোচনা করছি তখন সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রামের ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে। বলা হচ্ছে উজানে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি বেড়ে গেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনই কি এর জন্য দায়ী। ভারতের সাথে ৫৪টি নদীর সমস্যা সমাধানে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দীর্ঘদিন না হওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতাশা প্রকাশ করেছেন। বছরের পর বছর তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। আবার তিস্তা নদী খননের যে সমীক্ষা সরকার করেছে তার বাস্তবায়ন হতে পারছে না। কি কারণে? কি সেই ভূ-রাজনৈতিক বাধা? সুরমা নদী শুকনো মৌসুমে হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে। এখন সুরমার পানি সিলেট শহরের বাড়িতে বাড়িতে?

 

শেয়ার করুন