১২ এপ্রিল ২০১২, বুধবার, ৬:১৭:১৬ পূর্বাহ্ন


পূর্বাভাস সত্ত্বেও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেল কী?
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৭-২০২২
পূর্বাভাস সত্ত্বেও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো গেল কী? সিলেটের স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের উদ্ধাররত সেনাবাহিনী/ফােইল ছবি


উজানে ভারতের উৎসে দেড় শতাব্দীর নিবিড়তম ভারী বর্ষণজনিত কারণে, ভাটিতে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় নজিরবিহীন বন্যায় কৃষি,পশুসম্পদ, মৎস্য সম্পদের মারাত্মক ক্ষতিসহ জীবনহানি হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। বন্যার জল এখন মধ্যাঞ্চল প্লাবিত করে দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে চলে যাবে সাগর সঙ্গমে। জল নেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, যেহেতু বিশ্ব আবহাওয়া মডেলে অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকেই বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের প্রদেশসমূহ এবং বাংলাদেশের হাওর এলাকায় প্রবল বর্ষণের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। তাহলে কেন বাংলাদেশ পরিস্থিতি যথার্থভাবে মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়নি। কেনই বা বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এই ধরনের প্রলয়ঙ্করী বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তুতি নেয়নি বা নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রেখেছিল। যেটা করলে হয়তো অনেক ক্ষতি কম হতো। 

সেটি যাই হোক, বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষপর্যায় অবস্থা টের পেয়ে বা ঘটনার ভয়াবহতায় সীমিত সামর্থ্য নিয়ে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়েছে। এতদসত্ত্বেও কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকায় পানিবন্দি মানুষের ক্ষয়ক্ষতি আর দুর্ভোগ কমানো যায়নি। সিলেট,সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এলাকায় বন্যার প্রকোপ এখনো অভাব রয়েছে। সেনা, নৌ, পুলিশ, প্রশাসনের সহায়তায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে সরকার। সরকারপ্রধান নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। গোটা জাতি অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে।

বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণেই বন্যাপ্রবণ দেশ। বলা হয় বাংলাদেশ নদীমাতৃক। বাংলাদেশের নদীগুলো একইসঙ্গে দেশের আশীর্বাদ এবং অভিশাপ। অসংখ্য নদীর উৎস উজানে ভারত, নেপাল, ভুটানের হিমালয় পর্বতমালা থেকে সৃষ্ট হয়ে রাজশাহী, রংপুর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মধ্যাঞ্চল,দক্ষিণ অঞ্চল দিয়ে সাগরে মিলিত হয় পদ্মায়। মেঘনা- যমুনাকে বাংলাদেশের ঠিকানা বলা হয়। এসব যদি বাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত বৃহৎ বদ্বীপ।  নদীবাহিত পলিমাটি বাংলাদেশকে করেছে দুর্বল এবং কৃষিপ্রধান। ঠিক তেমনি ফি বছর বন্যায় ভাসিয়ে নিচ্ছে ফসল, গবাদিপশু, ঘটাচ্ছে জীবনহানি। উজানে অনেক নদীতে বাঁধ দিয়ে দেশের বিশাল অঞ্চলে হয়েছে মরুকরণ।  প্লাবন মৌসুমে অতিবৃষ্টির সময় বাঁধগুলোর সøুইচগেট খুলে দেয়ায় ঘটছে বন্যা। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও অভিন্ন নদীগুলোর জল বণ্টন ব্যবস্থার সমস্য সংকটগুলোর সমাধান হয়নি দুই বন্ধু প্রতিবেশী ভারত-বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশসহ পশ্চিমবাংলা, আসাম, মেঘালয়বাসীর বন্যার সাথে বসবাস, ছাড়া গত্যন্তর আছে বলে মনে হয়না। তাই প্রয়োজন অন্তত দুটি দেশের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নদী ব্যবস্থাপনা। 

বাংলাদেশের নদীগুলো হলো ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে যমুনা (১৮০২ মাইল ভুটান, চীন,ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত, গঙ্গা যা বাংলাদেশে পদ্মা (১৫৬৯ মাইল ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ), সুরমা (৫৫৯ মাইল),আত্রাই (২৪২ মাইল), রাইডাক (২৩০ মাইল ভারত এবং ভুটানের সঙ্গে সংযুক্ত), মহানন্দা (২২৪ মাইল ভারত-বাংলাদেশের যৌথনদী), তিস্তা (১৯২ মাইল ভারত বাংলাদেশের যৌথ নদী), কর্তফুলী (১৬৮ মাইল), মেঘনা (১৬৪ মাইল), বংশী (১৪৮ মাইল)। এছাড়া এই সব নদী থেকে সৃষ্ট শাখা নদী, উপনদী জালের মতো ছড়িয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে। যদিও উজানে একতরফাভাবে জল সরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশের অনেক নদী এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। অনেকগুলো মৃতপ্রায়। যৌথ  নদী কমিশন আছে। কালেভাদ্রে আলাপ-আলোচনা হয়। তবে গঙ্গা জলবণ্টনে একটি চুক্তি হলেও তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর জলবণ্টনে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। বাংলাদেশের ইলিশ,আম নিয়মিত উপহার হয়ে যাচ্ছে সীমানা পেরিয়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জলের দেখা পাচ্ছে না সময় মতো বাংলাদেশ। অথচ অসময়ে জল এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। বন্যা অনিবার্য, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এড়ানো যাবে না। কিন্তু লাগসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অবশ্যই উদ্ধার কাজ, পুনর্বাসন দ্রুত করা যাবে। 

বাংলাদেশ কিন্তু কাজের কাজটিও করছে না বা করছে শম্ভুক গতিতে। নদী প্লাবন ভূমি গ্রাস করেছে ভূমি দস্যুরা বা অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে। পলি জমে নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। হাওর অঞ্চলে টেকসই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ হয়নি। কিছু কিছু এলাকায় অপরিকল্পিত উপায়ে সড়ক নির্মিত হয়েছে। ফলে প্রাকৃতিক উপায়ে জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিদারুণ বাধাগ্রস্ত। সামান্য বর্ষণেও জলমগ্ন হয়ে পড়ছে প্রধান শহরগুলো। হাওর অঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চলগুলোতেও শস্য উৎপাদন ধারা বা কৌশল লাগসই করা হচ্ছে না। এই কাজগুলো সমন্বিত করার কথা প্রতিবার শোনা গেলেও কাজের কাজ হচ্ছে খুবই কম। উন্নত বিশ্বে ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হয়। এলিভেটেড সড়ক নির্মিত হয়। দেখা যাচ্ছে, এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীসংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে কিছু সড়ক কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। প্লাবন এলাকা পুনরুদ্ধার, হাওর এলাকায় ডুবন্ত বাঁধ, উড়াল সড়ক পরিকল্পিত উপায়ে দ্রুত নির্মাণ না হলে আগামী বছরগুলোতে আবার দুর্যোগ আসবে। আমি মনে করি কাজগুলো মহানগরীতে পাতাল রেল নির্মাণ থেকেও জরুরি। 

এবার আসুন সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথায়। প্রথমত. ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসবিষয়ক পূর্বাভাস আরো উন্নয়ন, আরো বিজ্ঞানসম্মত করার সুযোগ রয়েছে। হাওর এবং প্লাবন সম্ভব এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আধুনিক উভচর যানবাহন, উড়োজাহাজ সংযোজন করা জরুরি। হাওর এলাকায় পশুপালনের জন্য উঁচু এলাকা নির্ধারণ, আরো আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনা বাড়ানো জরুরি।

বিশ্ব জলবায়ুতে পরিবর্তন আছেই এছাড়াও বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিবছর ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস অনিবার্য। বৈষয়িক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এটির প্রবণতা বাড়ছে, বাড়তে থাকবে।  বাংলাদেশকে সামর্থের সবকিছু নিবেদন করে পেশাধারী ভিত্তিতেই এগোতে হবে। এগুলো জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়। সমগ্র দেশবাসীকে সমন্বিত করেই এগোতে হবে।


শেয়ার করুন