২৮ মার্চ ২০১২, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৪:৫৮ অপরাহ্ন


প্রধানমন্ত্রীর দৃঢতা ও গয়েশ্বরের সন্দেহের নেপথ্যে কি?
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৭-২০২২
প্রধানমন্ত্রীর দৃঢতা ও গয়েশ্বরের  সন্দেহের নেপথ্যে কি?


আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে দলের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে। আদৌ শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তে অপসহীন থাকবে কি-না সেব্যাপারে নেতাকর্মীরা এখন সন্দিহান। অর্থাৎ এসরকারের অধীনে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না বর্জন করবে সে ব্যাপারেই সন্দেহ অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। দলের একেবারে শীর্ষ পর্যায় থেকে নানান ধরনের বক্তব্যের পাশাপাশি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সন্দেহ- অবিশ্বাস।  

কি বলছে বিএনপি

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয় বলে এখন জোর গলায় প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশেষ করে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির বক্তব্য আগের চেয়ে অনেক কঠোরই বেশ কয়েকদিনের বক্তব্যে ঠাহর করা গেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি দলের এমন দৃঢ় অবস্থানের ব্যাপারে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা না ছাড়া পর্যন্ত তাদের দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনায় যোগ দেবে না। ফখরুল আরো বলেছেন, “আগামী নির্বাচনে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ না করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রশ্নই আসে না। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে আমরা নির্বাচনে যাবো না”।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব বক্তব্য এসেছে। সম্প্রতি দলের পক্ষ থেকে কয়েকটি শর্তও দেয়া হযেছে যা ফখরুলের বক্তব্যে ফুটে উঠেেেছ। তা হলো “বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে আনতে সরকারকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথম শর্ত হলো তাদের (সরকার) পদত্যাগ করতে হবে এবং তারপর একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হন্তান্তর করতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার জনমতের ভিত্তিতে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবে এবং এভাবে দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার ও সংসদ গঠিত হবে। এমন শক্ত অবস্থান দেখিয়েছেন দলের আরেক নেতা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, একটিই চ্যালেঞ্জ, এই সরকারকে বিদায় করতে হবে।  তিনি আরো বলেছেন ‘ইভিএম মেশিনে নয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ নিজের ভোট নিজ হাতে দেবে।’ অপরদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, আগে একবার নির্বাচন করেছিলাম, নির্বাচনে গিয়েছিলাম, বিশ্বাস করে গিয়েছিলাম। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার দিনের ভোট রাতে শেষ করে দিয়েছে। এখন ইভিএমের নিয়ম করছে। এখন আর রাতে সিল মারতে হবে না, ওখানে (ভোটকেন্দ্রে) বসে টিপেই সব ভোট দিয়ে দেবে। এরকম মোকারির নির্বাচনের মধ্যে বিএনপি যাবে না।

প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা ও গয়েশ্বরের সন্দেহের নেপথ্যে কি?

 বিএনপির শীর্ষনেতাদের আপসহীন মনোভাব আর কঠোর বক্তব্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার বক্তব্য ও দৃঢ়তায় জাতীয় রাজনীতিতে নানান গুঞ্জনের ডালপালা মেলেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান ধরনের আলাপ-আলোচনা চলছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিএনপি আসলে কি আপসহীন না-কি গোপনে সিট ভাগাভাগির রাজনীতিতে পা ফেলছে। কেননা বাজারে প্রচার আছে যে বিএনপি সরকারের সাথে গোপনে সিট ভাগাভাগি দফরফা করছে। রাজনৈতিক পর্যবক্ষেকমহল মনে করেন বিএনপি গোপনে যে সরকারের সাথে একটি সমঝোতাপূর্ণ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বক্তব্যে আভাস মিলেছে।

তা না হলে প্রধানমন্ত্রী কি করেএমন নিশ্চয়তা দিলেন যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবদলই আসবে। সে নির্বাচনও উৎসবমুখর হবে। কেননা সম্প্রতি বলেছেন যেসব রাজনৈতিক দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আশার কথা জানান।

তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ দলীয় কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করার পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে।আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও সংসদকে জানান প্রধানমন্ত্রী। এতে প্রধানমন্ত্রী এতটাই দৃঢ়তা দেখান যে বলেই ফেলেন বিএনপির উদ্দেশ্যে একটি দল নির্বাচনে অংশ নিতে আর মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে হলে দেখাতে হবে যে সেই দল নির্বাচনে জয়ী হলে কে হবে তাদের সরকার প্রধান। বিএনপি যে অংশ নেবে আগামী নির্বাচনে তারা কাকে দেখাবে?

উল্লেখ্য, ২০১৮সালেও প্রধানমন্ত্রী এমন দৃঢ়তা দেখিয়ে বলেছিলেন যে,‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে (২০১৮) সব দল অংশ নেবে, নির্বাচন হবে। দেশের মানুষ ভোটও দেবে। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল। নির্বাচনে কোন দল আসবে আর কোন দল আসবে না, সে সিদ্ধান্ত তো আমরা নিতে পারি না, তবে আমাদের আশা, সব দলই নির্বাচনে আসবে। তবে কেউ নির্বাচনে না এলে আমাদের কিছু করার নেই তার এমন বক্তব্যের পর দেখা গেছে যে, বিএনপি ২০১৮ সালে ঠিকই অংশ নিয়েছে নির্বাচনে ড.কামাল হোসেনের নেতৃত্ব ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয় গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে।

গয়েশ্বরের উৎকণ্ঠা কীসে?

এদিকে গত শুক্রবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আর নানান প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। তাদের প্রশ্ন দাদা ‘গয়েশ্বর চন্দ্র রায়’ হঠ্যাৎ এমন বক্তব্য কেন দিলেন? বিএনপিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও দলের বর্তমানে দলেল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির এ সদস্য তার  বক্তব্যের মাধ্যমে আসলে কি বোঝাতে চান? কেননা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সন্দেহ প্রকাশ করেই আহ্বান জানিয়েছেন, আ.লীগের অধীনে নির্বাচনের ফাঁদে পা না দিতে। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়-এ সিদ্ধান্তের প্রতি দেশের সব রাজনৈতিক দলকে অটল থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে তিনি তার বক্তব্যে বলেননি কোন দল?  গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, আমরা যদি অতীতের মতো নির্বাচনের ফাঁদে পা না দিই, আমরা যে কথা বলেছি, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন নয়, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়-এ সিদ্ধান্তে যদি শেষদিন পর্যন্ত থাকতে পারি, তাহলে শেখ হাসিনা সরকার নেই। তার নির্বাচন করার ক্ষমতা নেই নেই নেই...। তাই সব রাজনৈতিক দল সবাইকে বলবো, আপনারা একটি জায়গায় অটল থাকেন-এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এমন সময়ে এধরনের বক্তব্য দিলেন কেন? তিনি কি বিএনপি না অন্য কোনো দলকে উদ্দেশ্য করে বললেন? কেউ কি গোপনে দল বা জোট করে সটকে পড়তে পারেন সরকারের আশীর্বাদ পেয়ে। কিন্তু দেখা গেছে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় তা তার বক্তব্যে এসব কিছু বলেনি। 

শেষকথা  

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এর আগেও তার বক্তব্যের জন্য দলে নানাভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তিনি একবার অভিযোগ করেছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ নেতাদের দ্বিমুখী বক্তব্যে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। গয়েশ্বর বলেছিলেন, ‘দলের উপরের নেতারা একটা বলে, নিচের নেতারা আরেকটা বলে, আবার আমার পাশের নেতা আরেকটা বলে- এটা হলো সমন্বয়হীনতা। আমি একটা বললাম, আবার একই মঞ্চে আরেক নেতা আরেকটা বললো। সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত আসলে বিএনপি চায় কী।’ ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, কেউ বলছে আন্দোলন ছাড়া পথ নেই, এক নেতা বলছে ফয়সালা হবে রাজপথে, আবার আমি বলছি আরেকটা।’

প্রশ্ন হচ্ছে, তাই  যদি হয়ে থাকে তাহলে সারা দেশে যখন একটাই রব তোলা হয়েছে যে, এসরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, তখন তিনি (গয়েশ্বর চন্দ্র রায়) কেন এমন কথা বললেন? তিনি কি জানেন বা আঁচ করতে পেরেছেন যে, কেউ কি অতীতের মতো সরকারের নির্বাচনের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যে বক্তব্য দিয়েছেন সে ব্যাপারে দলের ভেতরে বাইরে পরিষ্কার করতে হবে। তবে তিনি তার বক্তব্যে আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিষ্কারভাবে তার মাধ্যমে না এলেও এর রহস্য দৃশ্যমান হতে আগামী দুই-একমাস বা আরো সময় লাগবে। তবে ভেতরে ভেতরে যে কিছু একটা হচ্ছে তা হয়ত অনেকের চোখে পড়ছে না, কিন্তু দলের বিচক্ষণ এ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নজরে এসেছে, যা তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় প্রকাশ করে ফেলেছেন।


শেয়ার করুন