যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পুনঃপ্রবেশকারীর জন্য পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড


দেশ রিপোর্ট , আপডেট করা হয়েছে : 17-09-2025

যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পুনঃপ্রবেশকারীর জন্য পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে পাস হলো বিতর্কিত অভিবাসনবিরোধী বিল ‘স্টপ ইলিগ্যাল এন্ট্রি অ্যাক্ট অব ২০২৫ (এইচ আর ৩৪৮৬)’। অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ ও পুনঃপ্রবেশকে কেন্দ্র করে তৈরি এই আইনে অভিবাসীদের জন্য কঠোরতম শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ বিলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী, পুনঃপ্রবেশকারী, আশ্রয়প্রার্থী, কিশোর এবং পরিবারগুলোকে দায়মুক্তি ছাড়াই ফৌজদারি শাস্তির আওতায় আনা যায়। এটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির অংশ হিসেবে উত্থাপিত হয়। নতুন প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, যদি কেউ অনুমোদন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে এবং পরবর্তী সময়ে ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে তার জন্য ন্যূনতম পাঁচ বছরের বাধ্যতামূলক কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নির্ধারিত হবে।

১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ভোটে ২২৬-১৯৭ ব্যবধানে বিলটি পাস হয়। রিপাবলিকানদের পাশাপাশি নর্থ ক্যারোলিনার ডন ডেভিস এবং নিউইয়র্কের লরেন গিলেনসহ ১১ জন ডেমোক্র্যাটও এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা একযোগে বিরোধিতা করলেও কয়েকজনের সমর্থন রিপাবলিকানদের প্রস্তাবকে সহজে পাস করাতে সহায়তা করে। হাউস স্পিকার রিপাবলিকান মাইক জনসন বলেন, পুনরায় অপরাধী ও সহিংস অপরাধে জড়িত অভিবাসীদের লক্ষ্য করে কঠোর সাজা দেওয়ার মাধ্যমে এ বিল আইনের শাসনকে শক্তিশালী করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন ভাঙলে তার কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। এটি স্পষ্ট বার্তা।

আগে যুক্তরাষ্ট্রে অনুমতি ছাড়া পুনঃপ্রবেশ করলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হতো, কিন্তু এই আইনে সেটি বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথমবার ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অবৈধ প্রবেশ করলে ন্যূনতম পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বাধ্যতামূলক, বারবার বহিষ্কার হওয়ার পর পুনরায় প্রবেশ করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। তিন বা তার বেশি মিসডিমিনর অপরাধে জড়িত থাকলে সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড আর ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বহিষ্কৃত বা পুনঃপ্রবেশে বারবার ধরা পড়লে ন্যূনতম ১০ বছর বাধ্যতামূলক কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ আজীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এভাবে পূর্বের তুলনায় শাস্তির পরিধি অনেক বাড়ানো হয়েছে। মার্কিন সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নের আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অভিবাসন ব্যবস্থাকে প্রশাসনিক পর্যায় থেকে সরিয়ে সম্পূর্ণভাবে ফৌজদারি আইনের আওতায় নিয়ে যাচ্ছে।

বিলটি গত মে মাসে উত্থাপন করেছিলেন ওকলাহোমার রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান স্টেফানি বাইস। তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই ভবিষ্যতে অবৈধ অভিবাসন রোধ করতে হবে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সীমান্ত টহল কর্মকর্তাদের হাত শক্ত করতে হবে, যাতে তারা বিপজ্জনক অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেন। তবে মানবাধিকার সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন বিলটির তীব্র সমালোচনা করেছে। সংগঠনের জাতীয় নীতি ও সরকারি কার্যক্রম বিভাগের পরিচালক মাইক জ্যামোর বলেন, এ আইন ট্রাম্প প্রশাসনকে আরো ক্ষমতা দেবে অভিবাসীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করতে এবং ফেডারেল এজেন্ট ও সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে কমিউনিটিগুলোকে আতঙ্কিত করতে।

ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি মাইক লেভিন বলেন, তিনি এই বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন কারণ এতে ডাকা সুবিধাভোগীদের কোনো সুরক্ষা নেই, প্রসিকিউটরদের বিবেচনাধিকার উপেক্ষা করা হয়েছে, এবং হাজারো পরিবারকে আতঙ্কে ঠেলে দেওয়া হবে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ আইন কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে শাস্তিমূলক দিক আরো কঠোর হয়ে উঠবে। এতদিন অবৈধ প্রবেশকে মূলত প্রশাসনিক এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত বিষয় হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু নতুন এই আইন সেটিকে সরাসরি ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে আশ্রয়প্রার্থী বা নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা মানুষও কঠোর কারাদণ্ডের মুখে পড়তে পারেন। বিশেষ করে যাদের আগেই ছোটখাটো অপরাধের রেকর্ড রয়েছে, তাদের জন্য ন্যূনতম ১০ বছর বা তার বেশি সাজা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে এবং এই আইন অভিবাসন ব্যবস্থাকে আরো অমানবিক করে তুলতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিল রিপাবলিকানদের জন্য ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে শক্ত বার্তা বহন করছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার, এবং রিপাবলিকানরা এটিকে ভোটারদের সামনে আইনশৃঙ্খলার কঠোরতা হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, এই আইন শুধু কারাগারের ভিড় বাড়াবে এবং অভিবাসীদের অনিশ্চয়তা আরো গভীর করবে। ফলে বিলটির ওপর বিতর্ক কেবল আইনগত নয়, নির্বাচনী রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ।

গত ১৯ মে ওকলাহোমার রিপাবলিকান কংগ্রেসওম্যান স্টেফানি বাইস বিলটি উত্থাপন করেন। ২১ মে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে আলোচনা শেষে ১৪-১০ ভোটে এটি অনুমোদিত হয়। ১৫ জুলাই সংশোধিত আকারে হাউসে উপস্থাপন করা হয় এবং ইউনিয়ন ক্যালেন্ডার নং ১৬৩-এ স্থান পায়। এর রিপোর্ট নম্বর ছিল এইচ আর ১১৯-২০০১। ২১ জুলাই হাউস রুলস কমিটিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ ভোটাভুটি শেষে বিলটি পাস হয়।

অভিবাসী অধিকারকর্মীরা মনে করছেন, বরং কংগ্রেসকে পুনরায় শাস্তি বাড়ানোর পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ অভিবাসন সংস্কার নিয়ে কাজ করা উচিত। এতে আইনি পথ তৈরি হবে, আদালতের চাপ কমানো যাবে এবং মূল নিরাপত্তা হুমকির ওপর যেমন মাদক ও অস্ত্র পাচার ফোকাস করা যাবে। বিলের সমর্থকরা বলছেন, এটি সীমান্ত নিরাপত্তা শক্তিশালী করবে, পুনঃপ্রবেশ প্রতিরোধ করবে এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিরোধীরা বলছেন, এটি ব্যয়বহুল, মানবিক নয় এবং কার্যকর হবে না। তারা মনে করেন, এ আইন কেবল অভিবাসী কমিউনিটিগুলোকে নয়, সাধারণ সঠিক বিচার প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারের নীতিকেও হুমকির মুখে ফেলবে।

প্রতিনিধি পরিষদে বিল পাস হলেও এটি সিনেটে পাঠানো হয়েছে, যেখানে এর ভাগ্য অনিশ্চিত। অভিবাসন কঠোর নীতির সমর্থকরা বিলটি পাস করার জন্য চাপ দিতে থাকলেও অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা এটিকে থামাতে সোচ্চার। সিনেটে বিল পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি এবং ফৌজদারি ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ বিল মার্কিন অভিবাসন ব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে কঠোর এবং বিতর্কিত আইনগুলোর মধ্যে একটি হয়ে থাকবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আশ্রয়প্রার্থী, মানবপাচার শিকার এবং পরিবারগুলো সবচেয়ে বড় প্রভাবভোগী হবে। একই সঙ্গে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকরতা ও ফেডারেল কারাগারের চাপও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, এইচআর ৩৪৮৬ বা ‘স্টপ ইলিগ্যাল এন্ট্রি অ্যাক্ট অব ২০২৫’ এখনো আইন নয়, তবে প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়ার মাধ্যমে এটি ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সিনেটে এর পরবর্তী ভাগ্য নির্ধারণই ঠিক করবে, এই আইন কার্যকর হবে কি হবে না, এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি কোন পথে যাবে।


প্রকাশক: মঞ্জুর হোসেন

সম্পাদক: মিজানুর রহমান

House : 29, Road : 01 Sector : 02, Block :F Aftabnagar, Dhaka:1212 (Opposite China Building) E-mail : deshusdhaka@gmail.com (Advertising & News For Bangladesh)