হঠাৎ বদলে গেলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজে গড়ে উঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এনসিপি। তাদের এমন বদলে যাওয়া বড়ো ধরনের ঝাকুনি দিয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ঘুরপাক খাচ্ছে নানা-ধরনের প্রশ্ন।
কি করেছে এনসিপি
বিষয়টি হলো এনসিপি’র বাংলাদেশে মওদুদীপন্থী ইসলামী দল বলে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী ঘরনার কোনো দলের সাথেই আপাতত জোট গঠন করবে না। এর পাশাপাশি তাদের কোনো ধরনের কর্মসূচিতে এনসিপি’র সায় দিচ্ছে না। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দলের আন্দোলনে রাজপথে নেমেছে। এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সঙ্কটের পাশাপাশি নানান ধরনের আলোচনা স্থান পেয়েছে।
তারা যখন এই দাবি কর্মসূচি দিয়েছে এবং তা ঘটা করে পালন করেছেন, তখন ফ্যাসিবাদী অওয়ামী লীগ সরকারের পতনে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ছাত্রদের নিয়ে গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে থেকে এক বিবৃতি দেওয়া হয়। জামায়াত ও তার সাথে সমমনা বলে দাবিদারদের নিয়ে কর্মসূচিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি নেই বলে জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি তাদেরর অবস্থান সম্পর্কে ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আমরা নিম্নকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) চাই না, আমরা শুধু উচ্চকক্ষে পিআর চাই। এ ছাড়া আমরা মনে করি, এখনো সম্পূর্ণভাবে ঐকমত্য কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে যাওয়ার সময় আসেনি।’
আবার সর্বশেষ ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার বিকালে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তন এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত শীর্ষ চার নেতার নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও ত্যাগ নিয়ে জাতীয় কনফারেন্সের আয়োজন করে শায়খুল হাদিস পরিষদ। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারাও এই সম্মেলনে যোগ দেন। তবে এতেও একটি বার্তা চলে আসে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তা হলো, এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয় বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’র নেতারা। যদিও অন্য ইসলামী দল বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে এক মঞ্চে বিএনপি-এনসিপি-হেফাজত নেতারা একটি বার্তা দিয়ে দেয়।
এনসিপি কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিলো?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজকে ধারণা করে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুরুতে সবাই ধরে নিয়েছে এটি জামায়াতের হাতে গড়া ভিন্ন নামে আরেকটি রাজনৈতিক প্লান্টফরম। বিষয়টি এনসিপি নেতারা টের পেলেও তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ বা কৌশল নিতে পারেনি। তবে দলটির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে এনসিপি’র নেতারা একটি বক্তব্য দেন-যা বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ ছিলো। এতে নতুন রাজনৈতিক দলএনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্থানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না।
আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করব। নাহিদের এমন বক্তব্য বিশেষ করে জামায়াতকে একটি পরোক্ষ বার্তা দেয়া হয় যে এনসপিপি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কোনো দল বা মত-কে সাথে নিলে সর্বসাধারারণের সমর্থন মিলবে না। এনসিপি’র এমন সিদ্ধান্তে খোজ নিয়ে জানা গেছে জামায়াত সেদিন থেকেই ভেতরে ভেতরে এনসিপি’কে অন্য হিসাবে দেখতে থাকে, যদিও তারা বাহির থেকে প্রকাশ পায়নি।
তবে সাম্প্রতিককালে এনসিপি’র বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে জনসমাগম কমে যাওয়া বোঝা যাচ্ছে জামায়াত এনসিপি’কে বাগে আনতে না পেরে দলটির প্রতি সমর্থণ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার একটি অংশ হিসাবে। বিষয়টি টের পেয়ে এনসিপিও এখন ধীরে ধীরে জামায়াত থেকে দূরে অবস্থান করার কৌশল নিয়েছে। কারণ এনসিপি নেতারা মনে করেন জামায়াত তা আদর্শিক রাজনীতি থেকে তাদেরকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না।
ডাকসু’র আঘাত
ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদসমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলকে সমর্থন দিয়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে ভোটে এই প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। এ নিয়ে এনসিপির ভেতরে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ডাকসুতে বিপর্যয়ের জন্য দলটির নেতারা একে অন্যকে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন। এটা হচ্ছে গণমাধ্যমের খবর।
তবে নেপথ্যের খবর হচ্ছে এনসিপি’র নেতারা ধারণা বা বিশ্বাস ছিল ডাকসু’র নির্বাচনে জামায়াত ও ও তার ঘরণার শিবির ডাকসু নির্বাচনে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দেবে। কিন্তু জামায়াত যে তার রাজনৈতিক আদর্শের বাইরে একচুল নড়বে না তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এনসিপি’র কোমলমতি নেতারা। জামায়াত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজকে ব্যবহার করে নিজেদের ফসল ঘরে তুলেছে, আর এনসিপি চেয়ে চেয়ে দেখেছে। বিষয়গুলো এখন এনসিপি’তে বেশ আলোচিত হচ্ছে।
আছে পশ্চিমাদের চাপ
আরেক সূত্র জানায়, নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে একেবারে শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউরোপের ৮টি দেশের রাষ্ট্রদূতের মধ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দেখা গেলো সর্বশেষ চার দিনের চীন সফরেও যান তারা। সফরের আগে এ উপলক্ষে এনসিপির এই প্রতিনিধিদলের জন্য এক সংবর্ধনার আয়োজন করে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস, যা ছিল বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ।
এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। সর্বশেষ এনসিপি’র প্রতিনিধি দলটি জাপানের রাজধানী টোকিওতে যান। যদিও বলা হয় যে এটি তাদের সাংগঠনিক সফর যদিও ভূ-রাজনৈতিক হিসাবে জামান একটি বিরাট ফ্যাক্টর। কেননা বলা হয় যে, এই সফরে তারা জাপানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর টোকিও এবং ওসাকাতে প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি এবং এনসিপির সমর্থকদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। কিন্তু জাপানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেখানে প্রবাসীদের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে-ও আলোচনা করার কথা, যা ইঙ্গিতপূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ও বৈঠক সফরেরর মধ্য দিয়ে এনসিপি’র এসব তরুণ নেতাদের বোধোদয় হয়েছে যে, পশ্চিমারা বাংলাদেশকে কোনোভাবেই একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেখতে চায় না।
কারো কারো মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আরেকটি ’প্রক্সি মওদুদীপন্থী দল’-এর প্রয়োজন নেই বলে যে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাতে এমন মনোভাবের পরিচয় মেলে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও যে পশ্চিমায় পা রেখে বুঝেছেন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কোনো দলের সাথে সম্পর্ক তাদের শুধু নয়, দেশের জন্যও ক্ষতিকর। অর্থাৎ প্রবাস সফরে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বোধোদয় হয়েছে পশ্চিমারা তরুণদের আর মৌলবাদী শিবিরে দেখতে চায় না। আর একারণে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসন হটাতে তার সহযোগিদের সাবধান করেছেন।
জামায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেই এমন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুক পোস্টে লেখেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি প্রক্সি-মওদুদীপন্থী দল আমরা চাই না। অর্ধডজন প্রক্সি দল তো আছেই। নতুন কিছু যোগ করবেন না! বরং নতুন করে সংজ্ঞায়িত করুন, পুনর্গঠন করুন এবং পুনরুদ্ধার করুন।
শেষ কথা
এনসিপি’র পক্ষ থেকে এমন ঝাঁকুনি দেওয়া নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে অনেক ধরনের বক্তব্য দাড় করানো হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপি’র এমন ঝাকুনির পিছনে রয়েছে জাতীয় আন্তর্জাতিক মেরুকরণ, যা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। একারণে দলটি এখন আর বাংলাদেশে একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের দাবা’র গুটি হিসাবে ব্যবহৃত আর চাচ্ছে না।
এনসিপি’র নেতারা এখন বুঝেছেন তাদের ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইমেজকে পুঁজি করে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সাথে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়। এর পাশাপাশি দেশের নীতিনিধারকমহলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে চায় এনসিপি’কে। এর পাশাপাশি এনসিপি’র পর্যবক্ষেন যে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাদের রাজনৈতিক আদর্শ এখন ধোয়াশার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এতোসব কারণেই এনসিপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মওদুদীপন্থী বলে পরিচতি ইসলামী দলটিকে এখন নিজেদের থেকে সরিয়ে নেয়া নিরাপদ বলে মনে করছে।